কে তুমি?

—সরি এত রাতে আপনাকে বিপদে ফেললাম। পরিষ্কার বাংলায় বলল মেয়েটি।
—আপনি বাংলা জানেন!
—না জানলে বলছি কীভাবে?
—কিন্তু আপনাকে দেখেতো বাঙালি মনে হচ্ছে না!
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম।
—মনে হচ্ছে না কারণ আমি বাঙালি নই তাই।
—তাহলে বাংলায় কথা বলছেন যে।
—শুধু বাংলা না, আমি পৃথিবীর সব ভাষায় কথা বলতে পারি।
—সব ভাষায়!
—জি, এমনকি এলিয়েনদের ভাষাতেও কথা বলতে পারি। শুনবেন?
—না শুনতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা আমি কি আপনার জাতীয়তা জিজ্ঞেস করতে পারি?
—অবশ্যই পারেন।
—আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
—রেড প্ল্যানেট। মানে মার্স থেকে এসেছি।
—কি বললেন!
—নিনো ভুমিছা মার্স। নিনে ফুমা মারেদু।
—বুঝলাম না।
—এর অর্থ আমি মার্স থেকে এসেছি। আপনি কেমন আছেন? এটা আমাদের মার্সের উত্তর অংশের ভাষা।
—মজা নিচ্ছেন না?
—নিনো জুমা বুরুনু। নিনো তুসু লুকিছা।
—এর মানে কি?
—এর অর্থ হলো, আমি মজা করছি না। আমি সত্য বলছি।
—দেখুন আমি এখন অফিস থেকে ফিরছি। প্রচণ্ড টায়ার্ড। এখন এই মধ্য রাতে এই বাজে ওয়েদারের মধ্যে আপনার নিনো নিনে নানা শোনার বা ফান করার কোনো ইচ্ছেই আমার নেই। তার চেয়ে বলুন আপনি কোথায় নামবেন, আপনাকে নামিয়ে দিই।
—আপনি বিরক্ত হচ্ছেন কেন? ঠিক আছে আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। আপনার সাহায্য আমার লাগবে না।
হঠাৎ করেই সুন্দর মুখটা অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে গেল।
—সরি, আমার হয়তো এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি।
—অবশ্যই ঠিক হয়নি।
—কিছু মনে করবেন না।
—আচ্ছা করলাম না। কিন্তু আপনি এমন স্বপ্নময় একটা রাতকে বাজে বলছেন কেন? দেখুন বৃষ্টির মতো স্নো পড়ছে। ফাঁকা রাস্তা। এমন একটা পরিবেশে আপনি গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে আমার মতো একটা সুন্দরী স্মার্ট তরুণী বসা। আর আপনি বলছেন বাজে রাত।
—সরি আমার ভুল হয়েছে। এটা বাজে রাত না, খুবই সুন্দর একটা রাত। এখন বলেন আপনার বাসা কোথায়? নামিয়ে দিয়ে আসি। প্লিজ মার্সে নামিয়ে দিতে বলবেন না। অত দূর যাওয়ার গ্যাস কিন্তু আমার গাড়িতে নেই। আর আমার জিপিএস মনে হয় না মার্সে যাওয়ার রোড ডিরেকশন দিতে পারবে।
—দেখেছেন এখন আপনিও আমার সাথে ফান করার চেষ্টা করছেন। এটা অবশ্য ভালো লক্ষণ। যদিও আমি জানি আপনি ভেতরে ভেতরে কিছুটা ভয় পাচ্ছেন। হয়তো ভাবছেন, আমি ভূত অথবা কোনো ক্রিমিনাল।
—আপনার কি তাই মনে হচ্ছে? আপনি হয়তো খেয়াল করেননি আমার গলায় নিউইয়র্ক সিটির পুলিশের শিল্ড ও আইডি কার্ড ঝুলছে। আর জানেন হয়তো নিউইয়র্ক সিটির পুলিশ কোনো কিছুকেই ভয় পায় না।
—তাই নাকি!
বলেই মেয়েটি মুচকি একটু হাসল। আমার হয়তো এখন প্রচণ্ড রাগ করা উচিত। কারণ ভেতরে ভেতরে আমার খুবই রাগ হচ্ছে। কিন্তু কেন জানি মেয়েটির ওপর রাগ করতে পারছি না।
রাস্তায় স্নোর জন্য গাড়ির গতি বাড়ানো যাচ্ছে না। গাড়ি চালাতে হচ্ছে খুবই সাবধানে। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, মেয়েটি গাড়িতে ওঠার পর থেকেই গাড়ির ভেতরটা সুন্দর পারফিউমের গন্ধে ভরে গেছে। ঠিক করলাম এই পারফিউমটা ঋতুর জন্য কিনতে হবে।
—যদি কিছু মনে না করেন, আপনি যে পারফিউমটা ব্যবহার করেছেন, তার নামটা কি জানতে পারি?
—কেন বলুন তো?
—এত পাগল করা গন্ধ আমি আগে কখনো পাইনি।
—তাই? কিন্তু আমি তো কোনো পারফিউম ব্যবহার করিনি।
—তাহলে এই সুগন্ধটা আসছে কোথা থেকে? আপনি গাড়িতে ওঠার পর থেকেই আমি গন্ধটা পাচ্ছি।
—এটা আমার শরীরের গন্ধ।
—আচ্ছা থাক নাম বলতে না চাইলে বলার দরকার নেই।
—সত্যি বলছি, আমি পারফিউম ব্যবহার করি না।
—আচ্ছা যান বিশ্বাস করলাম।
—তা আপনি যে বললেন পাগল করা গন্ধ, তার মানে কি এই গন্ধ আপনাকে পাগল করে দিয়েছে?
-না মানে, এখানে পাগল বলতে আমি বোঝাতে চেয়েছি, আমি মুগ্ধ। লজ্জিত হয়ে উত্তর দিলাম।
-আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন। এটা হতেই পারে। সত্যি করে বলুন তো, শুধু গন্ধে পাগল হয়েছেন নাকি আমাকে দেখেও।
কথাটি বলেই হাসতে শুরু করল। পৃথিবীর প্রতিটা মেয়ের হাসি সুন্দর হয় তা জানতাম, কিন্তু এতটা সুন্দর হয়! আমি অবাক হয়ে দেখতে লাগলাম।
-হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? সামনে দেখে গাড়ি চালান। না হলে অ্যাকসিডেন্ট করবেন।
-সরি।

-সরি বলার কোনো দরকার নেই। আমার মতো এমন সুন্দরী একটা মেয়েকে হা করে দেখবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। না হলে সুন্দরী হয়ে কি লাভ বলেন।
বলেই আবার শব্দ করে হাসতে লাগল। হাসির শব্দ শুনে মনে হলো কে যেন টুং টাং শব্দে পিয়ানো বাজাচ্ছে। ঋতু হাসলেও আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। ঋতু হাসলেই মনে হয় পৃথিবীর সবগুলো ফুল একসঙ্গে হাসছে। কিন্তু পিয়ানোর শব্দ কী শুনি? কখনো তো খেয়াল করিনি। এরপর খেয়াল করতে হবে।
-আচ্ছা বলুন তো আপনি এমন খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে কেন বের হয়েছেন?
-এই সুন্দর রাতটাকে মন ভরে দেখার জন্য।
-তা একা বের হলেন কেন? আপনার বয়ফ্রেন্ড কে নিয়ে বের হতেন।
-আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।
-এত সুন্দর একটা মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নেই, অবাক করলেন।
-অবাক হওয়ার কী আছে। আমার বয়ফ্রেন্ড নেই কারণ আমি স্পেশাল কারও জন্য অপেক্ষা করছি।
-আচ্ছা বুঝলাম। এখন বলুন আপনার বাসা কোথায়?
-আপনি কেন বারবার কৌশলে আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাচ্ছেন? আপনি তো এখন অফ ডিউটিতে। প্লিজ বাসার ঠিকানা জানার জন্য পুলিশের মতো গোয়েন্দাগিরি করবেন না। কারণ আমি এখন বাসায় যাব না। আজ সারা রাত আমি বাইরে থাকব।
-ঠিক আছে আপনি সারা রাত বাইরে থাকুন। কিন্তু আমাকে তো বাসায় যেতে হবে। প্লিজ বলুন আমি আপনাকে কোথায় নামিয়ে দেব।
-আমাকে ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার মেরিনার সামনে নামিয়ে দিন।
-কিন্তু ওটা তো এখন বন্ধ। ওখানে গিয়ে আপনি এখন কি করবেন?
-আমি ওখানে গিয়ে নদীর পাড়ে সারা রাত বসে থাকব। আচ্ছা আপনি কি কখনো রাতে নদীতে স্নো পড়তে দেখেছেন? শুনেছি সেটা নাকি এক অলৌকিক দৃশ্য।
-মানে কি! এই ঠান্ডায় আপনি এখন নদীর পাড়ে বসে থাকবেন! আপনি তো ঠান্ডায় মারা যাবেন। সরি আমি আপনাকে ওখানে নিতে পারব না।
-তাহলে আপনি আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে চলে যাব।
এত দেখি ভালো মসিবতেই পড়লাম। বিপদে সাহায্য করতে গিয়ে এখন তো নিজেই বিপদে পড়লাম। এমনিতেই অফিস থেকে বের হতে হতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছে। অবশ্য এটা এখন প্রায়ই হয়। মাঝে মাঝে ভাবি দুনিয়ায় এত চাকরি থাকতে কেন যে পুলিশের চাকরি নিলাম। যে অফিস ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে, সেখানে চাকরি নেওয়াটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। প্রায়ই ডবল শিফট ডিউটি করতে হচ্ছে। আজও ডবল শিফট ডিউটি করেছি। শরীরটা খুবই দুর্বল লাগছে। গতকাল থেকেই কেমন জানি জ্বর জ্বর ভাব। তার ওপর আজ আবার আবহাওয়ার অবস্থা খুবই খারাপ। অঝোরে স্নো পড়ছে। রাস্তাঘাট সব স্নোতে ঢাকা পড়ে গেছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ। রাস্তায় কোনো মানুষজন নেই। সিটি মেয়র জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সব জনসাধারণকে বাসায় অবস্থান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। ঋতু অবশ্য ফোন করে বলেছিল এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে বাসায় না ফিরে অফিসেই রাতটা কাটাতে। কিন্তু ঋতুকে বলেছি, তোমাকে পুরো একদিন না দেখে থাকা সম্ভব না। আমি আসছি তুমি খাবার রেডি করো।
অফিস থেকে বের হয়ে এস্টোরিয়া বুলুভার্ট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল একটি মেয়ে বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছে। হাত তুলে লিফট দেওয়ার জন্য ইশারা করল। অন্য সময় হলে দাঁড়াতাম না। কিন্তু এই আবহাওয়ায় একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে না দাঁড়িয়ে পারলাম না। গাড়ি থামাতেই মনে হলো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ডানাকাটা পরি। যেহেতু আমি কখনো পরি দেখিনি, তাই জানি না তারা দেখতে কেমন হয়। ঋতুকেই আমি এত দিন পরি ভাবতাম। কারণ ঋতুই হলো আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। তবে এই মেয়েটিকে দেখে মনে হলো পরিরা বোধ হয় এমনই হয়।
-শুনুন আমি আপনাকে নদীর পাড়েও নামিয়ে দেব না, আবার এখানেও নামিয়ে দেব না। আপনি যদি আমাকে আপনার ঠিকানা না বলেন, তবে আমি আপনাকে এখন থানায় নিয়ে যাব। সকালে আবহাওয়া ভালো হলে আপনাকে ছাড়া হবে।
-থানায় নিতে হবে না। আমাকে কাগজ কলম দিন, নাম ঠিকানা লিখে দিচ্ছি।
-লিখতে হবে না। আপনি মুখেই বলুন।
-না মুখে বলব না। মুখে বললে আপনি ভুলে যাবেন। আপনি কাগজ কলম দিন।
গাড়িটা একটু থামিয়ে অফিসের ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে দিলাম। কাগজে কী জানি কী লিখল, তারপর কাগজটি ভাঁজ করে গাড়ির সানগ্লাস কেবিনেটে রেখে দিল।
-ওখানে রাখলেন কেন? আমাকে দিন।
-শুনুন, আপনি নাম ঠিকানা জানতে চেয়েছেন, আমি নাম ঠিকানা লিখেছি। কিন্তু এখন দেখা যাবে না। কাগজটি দেখতে হলে আগে আমার একটা অনুরোধ রাখতে হবে।
অনুরোধ রাখব কিনা সেটা পরের কথা। আগে বলুন কি আপনার অনুরোধ।
-প্লিজ আমাকে একটু নদীর পাড়ে নিয়ে চলুন। মাত্র ত্রিশ মিনিট থাকব। প্লিজ। আর ফেরার পথে কাগজটি দেখতে পাবেন।
মনে হলো কষে একটা থাপ্পড় দিই। এই বয়সের মেয়েগুলো কেন যে এতটা পাগলা কিসিমের হয় বুঝি না। এরা সবকিছুতেই ফ্যান্টাসি খোঁজে। কিন্তু মেয়েটার বলার ধরনে এমন একটা আকুতি ছিল যে না বলতে ইচ্ছে করছে না। আবার যেতেও ভয় করছে। কারণ ঋতু যখন জানবে আমি এই মধ্য রাতে একটি মেয়ের সঙ্গে নদীর পাড়ে স্নো পড়া দেখতে গিয়েছি, স্রেফ খুন করে ফেলবে। আমি ঋতুর কাছে কখনো কিছু গোপন করি না। দেখা যাবে এ কাহিনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রেগে গিয়ে বলবে, ‘তোমাকে না কত বার বলেছি, রাস্তায় অপরিচিত কাউকে গাড়িতে ওঠাবে না। আমার কোনো কথাই তো তুমি শোনো না। তোমার মতো বেকুব মানুষ আমি কখনো দেখিনি। মানুষ কে না বলতে শেখো। আচ্ছা তুমি পুলিশে চাকরি করো কীভাবে? তুমি তো এই চাকরির যোগ্য না। তুমি বরং এই চাকরি ছেড়ে ঝাল-মুড়ি বিক্রি করা শুরু করো।’
ঋতুর এই এক সমস্যা, কিছু একটা হলেই আমাকে ঝাল মুড়ি বিক্রি করতে বলবে। আসলে ঝাল-মুড়ি ওর খুবই প্রিয়। তাই ছোটবেলায় ঠিক করেছিল বড় হয়ে একজন ঝাল-মুড়ি বিক্রেতাকে বিয়ে করবে।
-চুপ করে আছেন কেন? কি ভাবছেন?
-না কিছু ভাবছি না।
-তা হলে কি আমরা নদীর পাড়ে যাচ্ছি? জানেন আমার খুব ইচ্ছে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে স্নো পড়া দেখব।
-কিন্তু আপনার ভালোবাসার মানুষ তো এখানে নেই।
-সেটা অবশ্য একটা সমস্যা। আচ্ছা আপনি কি আমার সাথে একটু দাঁড়িয়ে স্নো পড়া দেখবেন?
-প্রশ্নই আসে না। প্রথমত আমার ঠান্ডা একদমই সহ্য হয় না। দ্বিতীয়তো আমি আপনার...।
থাক আপনার কঠিন কারণগুলো শুনতে চাচ্ছি না। আপনাকে কষ্ট করে নামতে হবে না। এখন চলুন।
-ঠিক আছে যাচ্ছি। তবে ত্রিশ মিনিট না, মাত্র দশ মিনিট থাকবেন। দশ মিনিট পর আপনার বাসার উদ্দেশে রওনা হব।
-সময়টা আর একটু বাড়ানো যায় না?
-না। দশ মিনিট মানে দশ মিনিট। দশ মিনিট এক সেকেন্ডও না।
রেগে গিয়ে বললাম।
-ঠিক আছে দশ মিনিট মানে দশ মিনিট। দশ মিনিট এক সেকেন্ডও না। রাগ করার দরকার নেই।
এস্টোরিয়া ব্লুভার্ট থেকে নর্দান ব্লুভার্ট তারপর বায়ে মেরিন রোড ধরে ওয়ার্ল্ড ফেয়ার মেরিনার সামনে গিয়ে গাড়ি থামালাম।
-শুনুন এই ঠান্ডায় গাড়ি থেকে নামার দরকার নেই। গাড়িতে বসেই দেখুন।
-বলেন কী! এখানে এসে গাড়িতে বসে থাকব। মোটেই না।
বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। নদীর পাড়টা রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিং ঘেঁষেই ওয়াকিং ওয়ে। কিছুদুর পরপর বসার জন্য চেয়ার পাতানো। স্নো পড়ে এলাকাটিকে স্বপ্নপুরীর মতো লাগছে। মেয়েটি গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে রেলিংয়ের কাছে গেল। রেলিং ধরে পানির দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মনে হলো প্রকৃতির রূপে মুগ্ধ হয়ে নড়াচড়া করতেও ভুলে গেছে। একটু পরই হঠাৎ করেই মাথার ওপর দুই হাত তুলে বাচ্চাদের মতো লাফাতে শুরু করল। লাফিয়ে লাফিয়ে স্নো ধরতে লাগল। মনে হলো কোনো স্নোকে মাটিতে পড়তে দেবে না, সবগুলোকে শূন্যেই ধরে ফেলবে। মাঝে মাঝে নিচ থেকে স্নো নিয়ে ওপরের দিকে ছুড়তে লাগল। আবার কখনো নিজের গায়ে ছিটাতে লাগল। মুগ্ধ হয়ে মেয়েটির এই পাগলামি দেখতে দেখতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। একটু পরেই গাড়ির জানালায় অনবরত টোকায় ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলেই অবাক হয়ে গেলাম। সারাটা শরীর তার ঢেকে আছে শুভ্র স্নোতে। মনে হলো তার পুরোটা শরীর সাদা তুষারে গড়া। ইশারাতে গাড়ির ডোর খুলতে বলল। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত পৌনে দুটো বাজে।
দরজা খুলতেই বলে উঠল, আপনার গাড়ির হেডলাইটটা বন্ধ করুন তো প্লিজ। এই সুন্দর পরিবেশে গাড়ির হেডলাইটটাকে কেন জানি ভিলেনের মতো মনে হচ্ছে।
আমি গাড়ির হেডলাইট বন্ধ করে দিলাম। আবারও বাচ্চাদের মতো দৌড়ে রেলিংয়ের ধারে চলে গেল। দুই মিনিট যেতে না যেতেই আবারও গাড়ির জানালায় টোকা। দরজা খুলতেই দুহাত করজোড় করে বলল, প্লিজ একটু নামুন না, প্লিজ।
-সরি, আমি নামছি না। আপনাকে আমি আগেই বলেছি আমার ঠান্ডা সহ্য হয় না। আর তা ছাড়া আমি ভীষণ ক্লান্ত, দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।
-আপনাকে দাঁড়াতে হবে না। আপনি শুধু পাঁচ মিনিট আমার পাশে বসবেন। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। একটু নামুন।
মেয়েটি বাচ্চাদের মতো আবদার করতে লাগল। ঋতুও মাঝে মাঝে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের মতো আবদার করে। জানি না কী হলো। হঠাৎ করেই মনে হলো মেয়েটি নয়, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ঋতু। আর ঋতুই আমাকে অনুরোধ করছে, গাড়ি থেকে নামার জন্য। ঋতুর কোনো অনুরোধ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি জানি না কখন, কীভাবে আমি গাড়ি থেকে নেমে মেয়েটির সঙ্গে চেয়ারে গিয়ে পাশাপাশি বসলাম। আকাশ ভেঙে অঝোরে স্নো ঝরছে আমাদের ওপর। আস্তে আস্তে আমার শরীরও ঢেকে যাচ্ছে স্নোতে। কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে আছি। আমার খুবই ঠান্ডা লাগছে। মনে হচ্ছে ঠান্ডায় সমস্ত শরীর জমে যাচ্ছে। শরীর কাঁপছে। বুঝতে পারছি জ্বরটা সম্ভবত বাড়ছে। দুই চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছি না। রাজ্যের ঘুম আমার দুই চোখে। মনে হচ্ছে আমি ঠান্ডায় মারা যাচ্ছি। একটু উষ্ণতার জন্য আমি মেয়েটির হাতটি ধরতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না। আমার হাত-পা কিছুই নড়ছে না। আমি কথা বলতে চাচ্ছি কিন্তু ঠোঁট দুটো নড়াতে পারছি না। অনেক কষ্টে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম।
-ঋতু আমার হাতটা একটু ধরো প্লিজ। আমার খুব ঠান্ডা করছে। আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো, প্লিজ।
মনে হলো পাশ থেকে নয় অনেক অনেক দূর থেকে ঋতুর কণ্ঠ ভেসে আসছে, ‘এই তো আমি তোমার পাশে বসে আছি। তোমার হাত ধরে রেখেছি। তুমি চোখ খোল। চোখ খুললেই আমাকে দেখতে পাবে।’
আমি চোখ খুলতে চাচ্ছি, কিন্তু পারছি না। চোখের পাতা দুটোকে খুব ভারী মনে হচ্ছে। অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। দেখি আমি ফ্লাশিং হসপিটালে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে শুয়ে আছি। আমাকে স্যালাইন পুশ করা হয়েছে। ঋতু আমার হাত ধরে বিছানার পাশে বসে আছে। ওর দুই চোখ পানিতে ভেজা, অথচ হাসছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ঋতু তুমি এত সুন্দর করে হাসো কীভাবে?
-তোমার জন্য।
বলেই জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে লাগল। ঋতুর চোখের জল আমার বুকে গড়িয়ে পড়তে লাগল।
-এই বোকা মেয়ে তুমি কাঁদছ কেন?
-তুমি জানো না, কাল সারাটা রাত আমার কীভাবে কেটেছে। একবার মনে হয়েছিল আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলছি। নিজেকে এতটা অসহায় কখনো মনে হয়নি। তোমার বাসায় ফিরতে দেরি দেখে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তার ওপর তুমি ফোনও ধরছিলে না।
সাধারণত আমি যখন ড্রাইভ করি ঋতু কখনই আমাকে ফোন করে না। কিন্তু কাল বাসায় ফিরতে দেরি দেখে রাত দুটোর পর থেকে ঋতু আমাকে ফোন করতে থাকে। বহুবার রিং করার পরও সাড়া না পেয়ে ভয় পেয়ে যায়। আর ভয় পেয়ে কল দেয় ৯১১। পরে ফোনের জিপিএস ট্র্যাকিং করে পুলিশ এসে দেখে আমি জ্ঞান হারিয়ে নদীর পাড়ে চেয়ারে শুয়ে আছি। আমার ফোন গাড়ির মধ্যে চার্জে দেওয়া।
ডাক্তারের পরামর্শে অফিস থেকে এক সপ্তাহ ছুটি নিলাম। বাসায় ফিরে ঋতু আমাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি। একবারও জানতে চায়নি, আমি ওতো রাতে কেন ওখানে গিয়েছিলাম। তবে আমি ঋতুকে সবকিছু খুলে বলেছি। সবকিছু শুনে প্রথম দিকে একটু ভড়কে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে হাসতে লাগল।
বলল, এসব কিছু না। সব তোমার মনের ভুল। সম্ভবত এটা হ্যালুসিনেশন। কারণ ওই দিন পুলিশ ওখানে আর কাউকে পায়নি। শুধু তুমিই ছিলে। আসলে একটানা কাজ করতে করতে তুমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। ডাক্তার বলেছে কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হবে হয়তো। আসলেই আমার বিশ্রাম দরকার।
হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার তিন দিন পর হঠাৎ একদিন বিকেলে ঋতু বলল, চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
-কোথায় যাবে?
-ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার মেরিনা।
-ওখানে কেন? অন্য কোথাও চলো।
-ওখানে সমস্যা কি? অন্য মেয়েকে নিয়ে তো যেতে পারো, তা আমাকে নিলে সমস্যা কি? শোনো ওই মেয়ের সঙ্গে তুমি যে চেয়ারে বসেছিলে, সেই চেয়ারটায় আমি তোমার সঙ্গে বসতে চাই।
বলেই রিনিঝিনি করে হাসতে লাগল। খেয়াল করে দেখলাম ঋতু হাসছে কিন্তু পিয়ানোর টুংটাং আওয়াজটা হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত ঋতুর জোরাজুরিতে বের হলাম। নদীর পাড়ে গাড়ি পার্ক করে সেই চেয়ারটায় গিয়ে বসলাম। কোনো কথা না বলে দুজনে চুপচাপ বসে আছি।
অনেকক্ষণ পর পানির দিকে তাকিয়েই ঋতু বলল, আচ্ছা ওই মেয়েটি কি আমার থেকেও সুন্দর?
-এ প্রশ্ন কেন করছ?
-মেয়েলি কিউরেসেটি। আবার জেলাসিও বলতে পারো। বল না কে বেশি সুন্দর? মেয়েটি না আমি?
কোনো উত্তর দিলাম না। কারণ একজন মেয়ের সামনে অন্য মেয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে নেই। স্ত্রীর সামনে তো প্রশ্নই আসে না।
-আমি জানি ওই মেয়েটি বেশি সুন্দর। তাই চুপ করে আছ। ঋতুর কণ্ঠে অভিমানের সুর।
-ঋতু, তুমি কি শক্ত করে আমার হাতটা একটু ধরবে? কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম।
ঋতু দুই হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাত ধরে বলল, তুমি কি ভয় পাচ্ছ? ভাবছ মেয়েটা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে? শোনো যত বড় সুন্দরী হোক না কেন, আমার কাছ থেকে তোমাকে কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এই জীবনে তুমি শুধুই আমার।
-শুধু এই জীবনে?
-না, সব জীবনেই। আমি কোনো জীবনেই তোমাকে ছাড়ব না। কারও সঙ্গে তোমাকে শেয়ার করব না। হ্যালুসিনেশনেও না।
বলেই হাসতে লাগল। অথচ ওর চোখের কোণে পানি। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমি এখন ঋতুর হাসিতে পিয়ানোর টুং টাং আওয়াজটা পাচ্ছি।
-আচ্ছা তুমি কিন্তু মেয়েটার নাম আমায় বলনি।
বলেই ঋতু আবারও হাসতে লাগল।
-কেন ফাজলামি করছ। তুমিই তো বললে সব মনের ভুল, হ্যালুসিনেশন।
-হ্যালুসিনেশনে এত কিছু হলো আর নামটা শোনোনি! কপট রাগের ভঙ্গিতে বলল।
-নাম তো বলেনি।
-মনে করার চেষ্টা করো। হয়তো বলেছে কিন্তু ভুলে গেছ। নাকি বলতে ভয় পাচ্ছ।
ঋতু আবারও হাসল। আমি এবারও পিয়ানোর আওয়াজটা শুনলাম। এখানে আসার পর থেকেই ঋতু হাসলে আমি পিয়ানোর টুং টাং আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছি।
-ঋতু তুমি একটু বসো, আমি আসছি।
বলেই হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। একদমই ভুলে গিয়েছিলাম। হঠাৎ করেই মনে পড়ল। অবাক হলাম কেন এই কয়দিন একবারও মনে পড়ল না।
-কি হয়েছে? কোথায় যাচ্ছে?
ঋতু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
-কিচ্ছু হয়নি। বসো আমি আসছি।
বলেই গাড়ির দিকে দৌড় দিলাম। গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসলাম। চোখ বন্ধ করে কাঁপা কাঁপা হাতে সানগ্লাস কেবিনেটের ভেতরে হাত দিলাম। বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম, ‘ওটা ছিল একটা হ্যালুসিনেশন, মনের ভুল। সেদিন রাতে কিছুই ঘটেনি। আমার সঙ্গে কোনো মেয়ের দেখা হয়নি। অতএব মেয়েটির লেখা ওই কাগজটি এখানে থাকার কথা না। প্লিজ কোনো কাগজ যেন না থাকে। প্লিজ প্লিজ।
কিন্তু আমার সব প্রার্থনা ব্যর্থ করে দিয়ে হাতে কাগজের ছোঁয়া পেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে বের করলাম ভাঁজ করা একটি কাগজ। হাত পা ঘামতে লাগল, কেমন জানি অসুস্থ ফিল করতে লাগলাম। কম্পিত হাতে কাগজের ভাঁজ খুললাম। খুলে দেখলাম সুন্দর করে বাংলায় লেখা-
‘প্রতিটি স্নো ঝরা রাতে আমি তোমার কাছে ফিরে আসব। নিনো সুসুতা মিনো। এর অর্থ আমি তোমাকে ভালোবাসি। নিতু, রেড প্ল্যানেট মার্স।’
কাগজটি হাতে নিয়ে বোকার মতো বসে রইলাম। গাড়ির কাচ ভেদ করে সামনে তাকালাম। দেখি ঋতু চেয়ারে বসে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।
বি. দ্র: ঋতুকে এই কাগজের লেখার কথা এখনো বলিনি। সম্ভবত কখনোই বলব না। বললে খামাখা টেনশন করবে। হয়তো ভয় পেয়ে যাবে। বলা যায় না ভয় পেয়ে হয়তো বলবে, ‘দরকার হলে বাংলাদেশে গিয়ে তুমি ঝালমুড়ি বিক্রি করবে, তবুও যে দেশে স্নো পড়ে সে দেশে থাকব না।’ হয়তো দেখা যাবে পরবর্তী স্নো পড়ার আগেই আমাকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবে। ওকে কে বোঝাবে ঝালমুড়ি বিক্রি একটা টেকনিক্যাল কাজ। ওই কাজ করার যোগ্যতা আমার নেই।
ইমদাদ বাবু: নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। ইমেইল: <[email protected]>