কে?
মধ্যরাত। ঘুমন্ত পৃথিবী। শব্দহীন চারপাশ। আকাশে আলোর খেলা। কোথাও কেউ নেই। শুধু নৈশব্দের ছোঁয়া। যা কানে শোনা যায় না, চিত্ত কেবল তা অনুভবে সক্ষম। দোতলার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে সুরভী। দৃষ্টি সামনের ফাঁকা রাস্তায়।
ল্যাম্পপোস্টের আলো। জনমানবহীন। তবুও সুরভীর চোখ সরে না। পলকহীন চেয়ে থাকা। বুঝি এই কেউ এলো! সময় বয়ে যাচ্ছে। কেউ আসছে না। কেউ কি আসার কথা ছিল? এটি কেবল সুরভী জানে। ওর জেগে থাকা, রাস্তার দিকে চেয়ে থাকা, রেলিং–ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা প্রমাণ করে কারও আসার কথা। কেউ আসবে ওকে দেখতে, কেউ আসবে ওকে ছুঁতে, কেউ আসবে ওকে গান শোনাতে।
চাঁদের আলো আরও উজ্জ্বল হলো। মৃদুমন্দ বাতাস সুরভীর শরীর স্পর্শ করল। সুরভী ভুরু কুঁচকে ভাবছে, কেউ তার আশপাশে আছে। সে সুরভীকে ডাকছে। যার জন্য সুরভী মধ্যরাতে অপেক্ষা করছে। এদিক–ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখে কেউ নেই। একটু দূরে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় একটি সাদা কুকুর দেখা যাচ্ছে। সেটি কুকুর নয়, সুরভীর ভালোবাসা। দোতলা থেকে এক দৌড়ে নিচে নেমে এলো সে। গেটে দারোয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। সুরভী গেট খুলতেই দারোয়ান বলে উঠল, কে?
চু...প, একদম চুপ! বলেই একটি ধাক্কা দেয় মুহিতকে। দারোয়ানের নাম মুহিত। পরিপক্ব মানুষ। মধ্যরাতে সুরভী যাচ্ছে কোথায়? সেটি ভেবে ভয় পাচ্ছে মুহিত।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কেউ নেই। কুকুরটা গেল কোথায়? মনে হচ্ছে আরেকটু সামনে গেলে পাওয়া যেতে পারে। সুরভী হাঁটছে। হেঁটেই চলেছে। কাউকে সুরভী দেখছে না। সুরভীর মনে হচ্ছে, কেউ একজন আশপাশে আছে। হাঁটতে হাঁটতে সুরভী অনেক দূর চলে এসেছে। তার মনে হচ্ছে, সে এখনো ল্যাম্পপোস্টের আলোর নিচেই আছে। আসলে চাঁদের আলোর প্রাচুর্যের কমতি ছিল না। সুরভী এখন আর রাস্তায় নেই। সে প্রবেশ করেছে বিশাল অরণ্যের ভেতরে। সুনসান নীরবতা। ঝিঁঝিঁর ডাক কানে আসছে। হালকা বাতাস সুরভীকে ছুঁয়ে দেয়। ঠিক তখনই কাউকে দেখতে পায় সুরভী। সাদা শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরে আছে সে। মুখে কী যেন পরা। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। সুরভী ঘামে ভিজে একাকার। লোকটি বলে ওঠে, ‘কে?’
লোকটি সুরভীর কাছে আসে। সুরভীকে জড়িয়ে ধরে। ভিজে যাওয়া সুরভীকে আরও ভিজিয়ে দেয়।
কেন যে বারবার এমন হয়, তা সুরভী বোঝে না। মুহিত এসে শেষ মুহূর্তে রক্ষা করে। সুরভী অন্তঃসত্ত্বা। এক অচিহ্নিত শিশুকে পেটে ধারণ করছে সে। কে তার বাবা? এটা নিয়ে ভাবনার শেষ নেই। কাকে বলবে সে। বড় বোন অহনার বিয়ের আলাপ চলছে।
আজ বিকেলে লোকজন আসবে অহনাকে দেখতে। মুহিত সবকিছু অ্যারেঞ্জ করছে। একটি বিষয় নিয়ে সুরভী চিন্তিত। মুহিত এ বাড়ির কাজের লোক। কিন্তু সে মাঝে মাঝে সুরভীর দিকে অন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যে মানুষটি সবার আড়ালে থেকে আমাকে ভোগ করে চলেছে, ওই মানুষটি মুহিত নয় তো! আজই সেটি প্রমাণ করতে হবে।
এক বিকেলে মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে সুরভী ওই জঙ্গলে গেল। দিনের বেলা। পুরো জঙ্গল নীরব। কোথাও কেউ নেই। শুধু মুহিত ও সুরভী। মুহিত বলছে, এখানে নিয়ে এলেন কেন মেমসাহেব?
এই জায়গা কি তোমার কাছে অপরিচিত?
না মানে!
আমি যখন গভীর রাতে এখানে আসি, তখন তুমিও আসো।
আপনাকে বাঁচাতে আসি।
মুহিতকে অনেক কথা শোনায় সুরভী। আসলে যে মানুষটি আমাকে ভোগ করে, সে কি তুমি? সুরভীর এমন কথা শুনে মুহিত তার পায়ে এসে পড়ে।
এক রাতে সুরভী মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছিল। বুকের কাপড় ঠিক ছিল না। মুহিত দারোয়ানের পোশাক বদল করে গেটের সামনে এসে রিকশা থেকে সুরভীকে ধরে নামায়। রিকশাচালক চলে গেলে মুহিত সুরভীকে নিয়ে জঙ্গলে যায়। সেই সময় সুন্দরী সুরভী মুহিতের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। কিন্তু মুহিতকে সে চিনতে পারে না।
সুরভী বলেছিল, তুমি কে?
মুহিত বলেছিল, ‘আমি তোমার অনাগত ভালোবাসা।’
‘আমি তোমাকে দেখতে চাই?’
‘ভালোবাসা তো দেখা যায় না। ভালোবাসা অনুভব করতে হয়।’
‘আমি তোমাকে কোথায় পাব?’
‘যখন আমাকে কাছে পেতে ইচ্ছা হবে, ওই ল্যাম্পপোস্টের আলোতে চলে এসো, আমাকে পাবে।'
মুহূর্তে মুহিতের প্রস্থান। সুরভী অন্ধকারে একা। খুব বেশি ভয় পাচ্ছে। কোথায় যাবে, কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। কেন তার সঙ্গে এমন হলো। হঠাৎ কোনো পায়ের শব্দ কানে এলো সুরভীর। সুরভী বলে,
কে?
মুহিত কাছে এসে বলেছিল, 'মেমসাহেব আমি মুহিত।'
*লেখক: এম হৃদয়, সিঙ্গাপুর।