কুমিল্লা সিটি নির্বাচন: সন্ত্রাস ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচনের পথ দেখাবে
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হলো আলোচিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের (কুসিক) নির্বাচন। বেসরকারিভাবে ঘোষিত ফলাফলে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত স্বতন্ত্র প্রার্থী, সদ্য বিদায়ী মেয়র মনিরুল হক সাক্কু।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেছেন, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনসহ ৫টি পৌরসভা ও ১৭৬টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে।
কুসিক নির্বাচন ঘিরে একটি নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত প্রশাসন নিশ্চিতে সংসদ সদস্যের এখতিয়ার, দায়িত্ব ও আচরণ নিয়ে অনভিপ্রেত এক বিতর্কে জড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। যার কারণে প্রার্থীদের হারজিতের ফলাফলের চেয়ে দেশজুড়ে আলোচনা ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নতুন নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা ও আস্থা অর্জনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। ১৩ জুন প্রথম আলোতে ‘কুমিল্লায় যিনিই জিতুন, নির্বাচনটি যেন না হারে’ শীর্ষক নিবন্ধে সোহরাব হাসান লিখেছেন ‘কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে নির্বাচন কমিশনকে। কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের এটাই স্থানীয় সরকার সংস্থার প্রথম বড় নির্বাচন। কুমিল্লা তো বটেই, সারা দেশের মানুষ দেখতে চাইবে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে কি না। সিইসির ভাষায়, ভোট জালিয়াতদের ‘ব্ল্যাকআউট’ করে দিতে পেরেছে কি না। আর নির্বাচনের প্রতি ভোটারদের আস্থা ফিরিয়ে আনা হবে ক্ষমতাসীনদের জন্য কঠিনতর পরীক্ষা। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোতে যে একতরফা ও জবরদস্তির ভোট হয়েছে, তাতে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতিই মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। আমরা যদি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের আগে দুটি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করি, দেখা যাবে সেখানে দলীয় প্রতীকের চেয়ে প্রার্থীর ইমেজ জয়ে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।’
কুমিল্লা সিটির রাজনৈতিক মেরুকরণ ভোটের মাঠে তিন প্রার্থীর (রিফাত-সাক্কু-কায়সার) প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস ও ভোটপূর্ব আলোচনা ছিল নগরজুড়ে। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনাকে উপেক্ষা করে সিটি করপোরেশন এলাকা ছেড়ে যাননি কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তথ্যমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেছেন, ‘প্রথমত আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যিনি ওই এলাকার সংসদ সদস্য, ওই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, যিনি ওই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ভোটার, তাঁকে নির্বাচন কমিশন এলাকা ছাড়ার কথা বলতে পারে কি না। এটি কি তাঁর মৌলিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ নয়? তাহলে তো ঢাকা শহরে যখন সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে, তখন ঢাকা থেকে নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য, মন্ত্রীদেরও ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে।’
একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে বহুপ্রতীক্ষিত গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে সর্বাগ্রে যে আস্থা তৈরির পরিবেশ গঠন সরকারের অগ্রাধিকার ছিল, তা শুরুতেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল। নির্বাচনী পরামর্শদাতা সু নেলসন ‘নির্বাচন অখণ্ডতা’র প্রধান লেখক। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনী আইন ও প্রবিধানের প্রয়োগ অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য নির্বাচনের একটি অপরিহার্য উপাদান, সেগুলো যেখানেই অনুষ্ঠিত হোক না কেন। ভালো প্রয়োগ নিশ্চিত করে না যে নির্বাচনের জন্য আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামো প্রয়োগ করা হয় এবং সম্মান করা হয়, তবে ভোটারদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতা নিশ্চিত করে। এটি জবাবদিহিকে উৎসাহিত করে, প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, স্বচ্ছতা বাড়ায় এবং নির্বাচনী ফলাফলে আস্থা তৈরি করে। নির্বাচনী আইন প্রয়োগের জন্য ভোটার, প্রার্থী এবং অন্যদের প্রক্রিয়ার সন্দেহজনক অংশগুলোকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এবং তাদের অভিযোগগুলো তদন্ত ও সমাধান করার জন্য একটি ব্যবস্থার প্রয়োজন। অনেক নির্বাচনী বিরোধ জালিয়াতি বা নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে। প্রতিটি সিস্টেম নির্বাচনী বিরোধগুলো পরিচালনা করা এবং সেই বিরোধগুলো সমাধানের সময় পাওয়া যেকোনো অবৈধ পদক্ষেপ প্রক্রিয়াকরণের নিজস্ব উপায় তৈরি করেছে। বিভিন্ন প্রয়োগকারী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের প্রয়োগকারী শাসনব্যবস্থাগুলোর মধ্যে মিলগুলো লক্ষণীয়। তাদের একই মৌলিক উদ্দেশ্য রয়েছে এবং বৃহৎ পরিমাপে, একই মৌলিক কাজগুলো অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা প্রায় উচ্চ চার্জযুক্ত এবং রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে নিরপেক্ষ, সময়োপযোগী এবং কার্যকর প্রয়োগ প্রদানের একই সমস্যার সম্মুখীন হয়। পার্থক্যগুলো প্রতিটি দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তারা সবচেয়ে প্রত্যক্ষ হুমকি হিসেবে তা বিবেচনা করে। ঐতিহাসিক এবং সম্ভাব্য হুমকির ওপর এই ফোকাস প্রতিষ্ঠানের পছন্দ, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া ক্ষমতার পরিমাণ এবং নিষেধাজ্ঞার তীব্রতা প্রতিফলিত হয়। এনফোর্সমেন্ট সিস্টেম প্রতিটি এখতিয়ারের আইনি এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোর অংশ গঠন করে। যাহোক, যদি না একটি এনফোর্সমেন্ট সিস্টেমকে সম্মান করা হয় এবং যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে এর মূল্য প্রশ্নবিদ্ধ। আইন লঙ্ঘনকারীদের জন্য ব্যাপক দায়মুক্তি বা পক্ষপাতমূলক উদ্দেশ্যে প্রয়োগকারীর ব্যবহার জনগণের আস্থা নষ্ট করে এবং নির্বাচনের ফলাফলের বৈধতাকে মেঘে পরিণত করতে পারে।’
বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ, এ চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে বর্তমান নির্বাচন কমিশন কুমিল্লায় যে নির্বাচনটি সম্পন্ন করেছে, তার জন্য তাদের সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া না গেলেও সম্পূর্ণ ব্যর্থতার দায়ভার চাপানোর কোনো সুযোগ নেই। এ নির্বাচনে বিএনপি দলীয়ভাবে যদিও অংশ নেয়নি তারপরও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর সম্মিলিত ফলাফল তাদের শক্তির জানান দেয়। ইভিএমের ধীরগতির পরও ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং কোথাও কোনো সন্ত্রাস সহিংসতা ঘটেনি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের সময় কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা দৃশ্যমান, সেখানে কোনো ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সিইসির অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার অব্যাহত চেষ্টার অংশ হিসেবে প্রয়োজনে কিছু নির্বাচনী আইনের সংস্কার করতে হবে। সন্ত্রাস ও সহিংসতামুক্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন আগামী জাতীয় নির্বাচনের পথ দেখাবে, এ প্রত্যাশা সবার।