রাহুলের বয়স এখন নয় চলছে। ক্লাস ফোরে পড়ে। পড়াশোনায় কোনো এক কারণে ছেলেটির মনোযোগ নেই। বারবার ফেল করছে। রাহুলের বাবা একই বিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে এত দিন গোঁজামিল দিয়ে ছেলেকে ওপরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করিয়েছেন। কাল হেড মাস্টার রাহুলের বাবাকে ডেকে নিয়ে সরাসরি বলে দিয়েছেন, এভাবে আর হবে না।
রাহুলের বাবা শরীফ উদ্দীন পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মা গৃহিণী। একটাই ছেলে তাদের। কত স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বড় হলে ডাক্তার বানাবেন! কিন্তু কাল হেড মাস্টারের কথায় যেন তাদের সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
রাহুল পড়াশোনায় অমনোযোগী ছোট থেকেই। শরীফ উদ্দিন ছেলের জন্য কিন্ডার গার্টেন থেকেই প্রাইভেট মাস্টারের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি নিজেও ছেলেকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না! প্রতিটা শব্দ ধরে ধরে পড়াতে হয় রাহুলকে, তবু শব্দের মানে বুঝতে অসুবিধা হয় তার। দাঁড়ি, কমা, প্রশ্নবোধক চিহ্ন ইত্যাদির মানে বুঝতে পারে না। প্রায় সময় ভুল উচ্চারণ করে এবং পড়তে পড়তে লাইন বাদ দিয়ে যায়। এ নিয়ে শরীফ উদ্দিনের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
রাহুল পড়াশোনায় মনোযোগী না হলেও অঙ্কনে তার দারুণ উৎসাহ। স্কুল থেকে ফিরেই সাদা কাগজ-কলম টেনে খুব আগ্রহের সঙ্গে অঙ্কন করতে বসে। এ নিয়ে প্রায়ই তার মায়ের বকুনি খেতে হয়। কাল হেড মাস্টারের কথায় রাগে কষ্টে রাহুলকে খুব মেরেছেনও তিনি। তারপর সব অঙ্কন ছিঁড়ে ফেলেছেন। রাহুল মায়ের ভয়ে কাল থেকে আর কাগজ-কলম ধরেনি।
কী করবেন রাহুলের বাবা-মা? একটাই সন্তান, কে না দেখে ছেলেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন! এত চেষ্টা করার পরও যদি সন্তান পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়, ফেল করে, তবে রাগ তো হওয়ারই কথা। রাগ হয়ে সন্তানকে বোঝাবে, বকবে, মারবে, এটাই আমাদের সাধারণ বাবা-মায়ের অভিন্ন প্রতিক্রিয়া।
এমন রাহুল আমাদের পরিবারে শুধু একজন নয়, শতক, হাজার রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, সন্তানকে নিজে সময় দিচ্ছি, টাকা খরচ করে প্রাইভেট মাস্টার রাখছি, তবু কেন রাহুলরা পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে? সমস্যাটা ঠিক কোথায়?
এর নাম Dyslexia ডিসলেক্সিয়া বা Learning disability (শেখার অক্ষমতা)। এটি একটি ব্যাধি, যা হলে একটি শিশু বুদ্ধিমত্তা ঠিক থাকা সত্ত্বেও পড়তে ও লিখতে সমস্যায় পড়ে। ডিসলেক্সিয়া একটি শিশুকে তখনই আক্রমণ করে, যখন শিশুটির অসামঞ্জস্য ব্রেইন তার চোখ ও কান দ্বারা পাওয়া তথ্যগুলো পড়তে ব্যর্থ হয়। এই সমস্যার সঙ্গে কানে কম শোনা, চোখে কম দেখা বা ব্রেইন ড্যামেজের কোনো সম্পর্ক নেই।
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা সাধারণত পড়া, লেখা, বানান, নতুন শব্দ উচ্চারণ, অঙ্ক এবং কোনো সমস্যার সমাধান দিতে হিমশিম খায়। তারা পড়াশোনা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে খুব মেধাবী হয়। যেমন, খেলাধুলা, অঙ্কন, মিউজিক ইত্যাদি। তারা সাধারণ শিশুদের থেকে অনেক বেশি কৌতূহলী, কল্পনা প্রবণ ও অন্তর্জ্ঞান সম্পন্ন হয়। তারা শব্দের চেয়ে ছবির মাধ্যমে এবং সৃজনশীলতায় ভাবতে পছন্দ করে।
একটি শিশুর মধ্যে বিভিন্ন কারণে ডিসলেক্সিয়া দেখা দিতে পারে। শিশুর মস্তিষ্কের যে স্থানটি পড়ালেখার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, শিশুর জন্মের সময় বা অন্য কোনো কারণে সে স্থানে আঘাত পেলে এই রোগ হতে পারে। আবার কখনো কখনো কোনো কারণ ছাড়াই শিশুর মস্তিষ্কের বাম দিকের অংশটি কাজ না করার কারণে শিশু ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বংশগত কারণকে দায়ী করা হয়। আবার, শিশু গর্ভে থাকা অবস্থায় হরমোনজনিত কারণেও এ সমস্যা হতে পারে।
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের প্রাথমিক কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন শিশুর বয়স যখন ১ থেকে ৩ বছর তখন দেরিতে কথা বলা এবং কানে প্রায় সময় ইনফেকশন হয়।
শিশুর বয়স যখন ৪ থেকে ৫ বছর, সে সময় লেখার সময় বারবার হাত বদল করা, লিখতে সমস্যা হওয়া, জুতার ফিতা বাঁধতে না পারা, বড় কোনো শব্দ উচ্চারণ করতে না পারা, লেটার M-N-L-R উচ্চারণ করার সময় জিহ্বায় আটকে যাওয়া। শিশুর বয়স যখন ৬ থেকে ১২ বছর তখন রিডিং পরতে সমস্যা হওয়া, অঙ্কে দুর্বলতা, ভুল শব্দ উচ্চারণ করা, খারাপ হাতের লেখা, বানানে ভুল করা, লাইন স্কিপ করা, ফোন নম্বর মনে রাখতে না পারা।
শিশু থেকে যখন কিশোর বয়সে পৌঁছে তখন শুদ্ধ করে রিডিং পড়তে না পারা, লেখার সময় বানান ভুল করা, লাইন স্কিপ করা, লেখার বিষয়-বস্তু গুছিয়ে লিখতে না পারা ইত্যাদি।
ডিসলেক্সিয়ায় মারাত্মক কোনো জীবননাশক ব্যাধি নয়। এটি জন্মের সময়ে উপস্থিত একটি ব্যাধি এবং একে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ বা নিরাময় করা যায় না, তবে বিশেষ নির্দেশনা ও সহায়তার সঙ্গে এই ব্যাধিকে সাধারণভাবে পরিচালিত করা সম্ভব। পৃথিবীর বহু বড় বড় ব্যক্তি এক সময় এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং সাফল্য অর্জন করেছেন। যেমন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন, পৃথিবীখ্যাত নায়ক টম ক্রুজ, বিখ্যাত ভাস্কর্য ‘দ্য স্কাল্পচার’ তৈরিকারক আগস্তে রবিন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখক, শিল্পী ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল, বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ওয়াল্ট ডিজনি, টেলিফোন আবিষ্কারক আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল, ফনোগ্রাফ বিখ্যাত থমাস এডিসন, বিখ্যাত থিওরিস্ট আলবার্ট আইনস্টাইন—তাঁরা সবাই ডিসলেক্সিক ছিলেন।
ডিসলেক্সিক শিশুর সহায়তায় প্রাথমিক হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মাকে অবশ্যই বুঝতে হবে, ডিসলেক্সিয়াযুক্ত শিশুরা সাধারণভাবে শিখতে পারে। তবে তাদের জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে হয়। এসব শিশুর জন্য শিক্ষাদান পৃথক করতে হবে এবং শিশুকে অক্ষর ও শব্দ শেখাতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। সম্ভব, সুবিধা ও সামর্থ্য থাকলে শিশুর জন্য ইনডিভিজুয়্যালাইজড এডুকেশন ইন্টারভেনশন, অকুপেশনাল থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, নিউরোলজিস্ট, ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও স্পেশাল এডুকেশন সিস্টেমের ব্যবস্থা করতে হবে।
একটি শিশু বারবার চেষ্টা করেও যখন পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে পারছে না, তখন অনেক বাবা-মা-ই তার সমস্যাটা না বুঝে, রাগের মাথায় বকাঝকা করেন, কখনো মারধর করেন। এতে করে কী হয়? শিশুটি হীনম্মন্যতায় ভুগে, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।
শিশুটি আপনার, তাকে জানুন, বুঝুন। সমস্যা কোথায় খতিয়ে দেখুন। তার সহায়ক হোন। পড়াশোনায় দুর্বল হলে তাকে সহায়তার পাশাপাশি তার বিকল্প মেধাকে খুঁজে বের করুন। তাকে উৎসাহিত করুন। হয়তো আপনার সন্তান আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারল না, কিন্তু সে যেন তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সৃজনশীল কিছুর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে, সেটার জন্য সন্তানকে সমর্থন করুন।
যদি একটি শিশু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ধরনে শিখতে না পারে, তবে শিশুটি যেভাবে শিখতে পারবে, সেভাবেই আমাদের শেখাতে হবে। ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন,
‘Logic will get you from A to B. Imagination will take you everywhere. Imagination is more important than knowledge. Knowledge is limited. Imagination encircles the world!’