কিসিঞ্জারের প্রতি অন্যরকম কৃতজ্ঞতা

হেনরি কিসিঞ্জার

বিশ্ববিখ্যাত বিটলস গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন ও তাঁর মতো আর একজন বিশ্বনন্দিত সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শংকরের কথা আজীবন মনে রাখবে বাংলাদেশ। বিশ্বের মানুষকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তহবিল সংগ্রহে তাঁরা একটি কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। একাত্তরের ১ আগস্টে নিউইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কয়ারে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ওই ঐতিহাসিক আয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মনে যেমন ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল, একইভাবে বিশ্বের মানুষকে জানার সুযোগ করে দিয়েছিল মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা। যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের মানুষ অকুতোভয় মুক্তি সেনাদের মরণপণ লড়াই ও প্রতিরোধের খবরের বিষয়েও আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেছিল।

জর্জ হ্যারিসন ও রবি শংকরের মতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছিলেন বিশ্বের অগণিত মুক্তিকামী শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন খ্যাত-অখ্যাত বিশ্ব নাগরিকেরা। কিছু কিছু ঋণ আছে অপরিশোধ্য, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি, মুক্তি সেনা ও বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্য যারা আন্তরিকভাবে মানবতার দায় মনে করে লড়ে গেছেন, তাঁদের কথা সুবর্ণজয়ন্তী পালনের এই সময়ে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। মনে আছে প্রণবেশ সেনের লেখায় আর দেব-দুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রাণবন্ত সংবাদ পরিক্রমার কথা। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগেই আকাশ বাণী থেকে প্রচারিত দেব দুলাল, প্রণবেশের উদ্দীপনাময় সংবাদ পরিক্রমা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রবলভাবে আবেগপ্রবণ করে তুলত। এভাবে বিশ্বজুড়ে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের সঙ্গে থেকে এই বীর জাতির উদ্দীপনার পালে যারা হাওয়া দিয়েছেন, তারা সবাই আমাদের ইতিহাসের অংশ। তাদের সম্মানের সঙ্গে মনে না রাখলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে যেতে পারি।

সামান্য কিছু পথভ্রষ্ট বিভীষণ ছাড়া পুরো জাতি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে হাজার বছরেও এভাবে বজ্রকঠিন শপথ নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাহরণ বিশ্বজুড়ে খুব বেশি নেই। স্বাধীনতার জন্য প্রাণের আবেগ যখন স্বতঃস্ফূর্ত, দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে, তখন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র, গোলাবারুদ, মারণাস্ত্র মুক্তিপাগল মানুষের কাছে অতি তুচ্ছ হয়ে পড়ে। বাঁধভাঙা দেশপ্রেমের আবেগের শক্তি আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্র-ভিয়েতনাম যুদ্ধে। আর পুরো বিশ্ব অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে একাত্তরের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। এত গৌরব, এত বেদনা, এত আত্মশক্তি প্রদর্শনের কাল বাঙালি আর কখনো পায়নি। অপ্রতিরোধ্য বাঙালির এই অকুতোভয় লড়াইকালে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে নিষ্ঠুর ষড়যন্ত্রও দেখেছি অনেক।

মুক্তিযুদ্ধকালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে তখন শীতল যুদ্ধ। সেই শীতল যুদ্ধের নিষ্ঠুর খেলায় বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রায় পিষ্ট হতে যাচ্ছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ও যুদ্ধকালে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন আমাদের চরম বিরোধিতা করে। আমাদের স্বাধীনতা তথা মুক্তির আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে চীন-মার্কিন ষড়যন্ত্রে পাকিস্তানিরা নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ইতিহাসে সবচেয়ে বীভৎস অত্যাচার শুরু করে।

সেই ষড়যন্ত্রের বড় বড় খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তাঁর দিক নির্দেশনায় যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। কিসিঞ্জার আগে থেকেই থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব এবং ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার মৈত্রী সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সঙ্গে চীনের মৈত্রী সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে চীনের সঙ্গে মার্কিনদের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ গ্রহণ করেন কিসিঞ্জার। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশবিরোধী এই ষড়যন্ত্র এতই ব্যাপক ও নিন্দনীয় ছিল যে, সারা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ কিসিঞ্জারকে ঘৃণার চোখে দেখতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে কিসিঞ্জার এবং ষড়যন্ত্র সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছরে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বিশ্ব নাগরিকদের কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণে রাখি। একইভাবে হেনরি কিসিঞ্জারের মতো ষড়যন্ত্রকারীদের নোংরা ষড়যন্ত্রের কথাও গুরুত্ব দিয়ে সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখি। অতীতের শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে হবে। সুবর্ণজয়ন্তী বাংলাদেশের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি মাইলফলক মাত্র, আমরা ধীরে ধীরে হীরকজয়ন্তী, শতবর্ষ, সার্ধশত বর্ষ হয়ে অনন্ত ভবিষ্যতের পানে পা বাড়াব।

স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যখন পত পত করে দেশে–বিদেশে সগর্বে ওড়ে, তখন মনে পড়ে যায় হেনরি কিসিঞ্জারের কথা। যিনি জাতিসংঘসহ সব রাজনৈতিক ফোরামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো কিছুর বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে রুখে দেওয়ার ব্যাপারে প্রত্যয়ী ছিল। সেই প্রত্যয় থেকে উদ্ভূত ভূ-রাজনৈতিক খেলায় জন্ম নেয় এক জঘন্য প্রতিহিংসা। আমরা দেখি, পাকিস্তান রক্ষার জন্য ৩০ লাখ বাঙালির আত্মদানকে তুচ্ছ জ্ঞান করে রিচার্ড নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ধূলিসাৎ করতে বঙ্গোপসাগরে একটি অত্যাধুনিক রণতরীও পাঠিয়েছিল নিক্সন, যে রণতরীটি সপ্তম নৌবহর নামে পরিচিত ছিল। এত কিছুর পরও ও রোখা যায়নি ভেতো বাঙালিদের। যাদের বলা হতো, ‘ভীরু, অলস, কর্মবিমুখ, কাপুরুষ, যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ।’

বাংলাদেশের প্রতি কিসিঞ্জারের ক্ষোভ এতই প্রবল ছিল যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়ের পরও তাঁর ক্ষোভ অব্যাহত ছিল। বাংলাদেশের বিষণ্নতা, বাংলাদেশের অসহায়তাকে তিনি উপভোগ করতেন, বাংলাদেশ নিয়ে তিনি নানা কৌতুক উদ্রেককারী মন্তব্য করার সুযোগ পেলে পিছপা হতেন না।। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন সারা বিশ্বের শান্তিকামী, স্বাধীনতাকামী দেশগুলোর সহায়তায় উঠে দাঁড়াচ্ছে, তখন বাংলাদেশের ত্রাণ সাহায্যের প্রয়োজন ও জাতি হিসেবে আমাদের সাহায্যের চাহিদাকে কটাক্ষ করে একটি অমানবিক ও নিষ্ঠুর মন্তব্য করেন কিসিঞ্জার। বাংলাদেশকে তিনি একটি ‘বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেন। তবে কিসিঞ্জারের এই কটাক্ষ আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তিতে কালিমা লেপন করতে পারেনি। বরং তাঁর এই উক্তি, জাতির আত্মশক্তিকে জাগিয়ে তুলেছিল। আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে নিম্ন কণ্ঠে সৌজন্য বজায় রেখে মহামতি কিসিঞ্জারকে বলতে হয়, লড়াকু বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের মডেলে পরিণত হয়েছে। রাজনীতি ও সুশাসনে আমাদের অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিকভাবে অনেক শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

আবেগপ্রবণ বাঙালি ধীরে ধীরে পরিশ্রমী, নিয়মানুবর্তী ও দেশপ্রেমিক জাতি হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের এই উঠে দাঁড়ানো আজ বিশ্বের সেরা সেরা অর্থনীতিবিদদের কাছে এক অবাক বিস্ময়। করোনাকালে যেখানে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের প্রবৃদ্ধি ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তার প্রবৃদ্ধির গতি ধরে রেখেছে। এ খবর আমাদের কোনো সংবাদপত্রের নয়, সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং ওয়াশিংটন পোস্টের মতো সংবাদপত্র তাদের প্রতিবেদন ও মতামতে সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বাঙালি কবিরা ভয়কে, ঘৃণাকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করার কথা বলেন। তাই প্রিয় কিসিঞ্জার আপনাকে এখন ‘প্রিয়’, ‘সুপ্রিয়’ বলে সম্বোধন করছি। প্রিয় (!) কিসিঞ্জার, স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশে উত্তরণ করতে হলে কিছু নির্ধারিত শর্ত পূরণ করতে হয়। এগুলো হলো—মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ও জলবায়ু ভঙ্গুরতা। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে অনেক চড়াই-উতরাই পাড়ি দিতে হয়েছে। অর্থনীতির অনেক সূচকেই বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে ভালো করেছে। দারিদ্র্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যু কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। নারীর ক্ষমতায়নেও এগিয়েছে ব্যাপকভাবে। মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এমন আরও অনেক সূচকেই বাংলাদেশ ক্রমাগতভাবে ভালো করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এলডিসি থেকে উত্তরণের এই জায়গায় আজকের বাংলাদেশ।

সুপ্রিয় (!) কিসিঞ্জার, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে আমরা আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চাই। আপনি, রিচার্ড নিক্সনসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এ রকম বন্ধু (!) না পেলে আমরা বুঝতে পারতাম না, সপ্তম নৌবহর থেকে আমাদের শক্তি কোনো অংশে কম নয়। আপাত নিরীহ বাঙালি পলিমাটির মতো নরম, কিন্তু গ্রীষ্মের দাবদাহের পর কাল বোশেখির ঝড়ের মতো উন্মত্ত। আমাদের কবিরা যেমন কবিতা লেখেন, ‘ও ভাই, ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে, গোলাগুলির গোলাতে নয়, গভীর ভালোবেসে।’

আবার তাঁরা এ রকম কবিতাও লিখতে পারেন ‘আমি চির দুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!’ এসব তো কবিতা, কবিতার সত্যকে বাঙালি বাস্তবের সত্যে পরিণত করতে পারত না, যদি আপনাদের সর্বাত্মক সাহায্যে ত্রিশ লাখ মানুষকে আত্মাহুতি না দিত। আপনাদের সম্মিলিত নৃশংসতায় বাঙালি জেগে উঠেছিল। সুবর্ণজয়ন্তীর এই সময়ে আপনাদের কাছেও আমরা অন্যরকম ঋণী। আমরা যেরকম মনে রাখব জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবি শংকরকে, একইভাবে মনে রাখব আপনি ও রিচার্ড নিক্সনের মতো বন্ধুদেরকেও।

লেখাটি শেষ করার আগে একটি পরিসংখ্যান আপনাকে জানাতে বড় লোভ হচ্ছে, ১৯৭০ সালে এই ভূখণ্ডে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১৪০ ডলার, ২০১৮-২০১৯-এ বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৯০৯ ডলার এবং ২০২০ সালে তা ২ হাজার ৬৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ১৯৭২-’৭৩ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মাথাপিছু গড় আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৭৫ গুণ। আরও অনেক অর্জনের কথা আপনাকে নাই বা বললাম।

অভিবাদন তাই সুবর্ণ জয়ন্তী উদ্‌যাপন করতে যাওয়া বাংলাদেশকে। অন্যরকম কৃতজ্ঞতা আপনাদেরকেও।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট