কিশোরী বিনুর গল্প

এবার বৃষ্টির মৌসুমে জল বিধৌত বৃষ্টিধারা নয়। ধুলোর ঝড়ে প্রায় প্রতিদিনই ভরে উঠছিল চারপাশ। শহরের ব্যস্ততম রাস্তাঘাট সেই ধুলোর ঝড়ে অন্ধ হতে হতে মাঝে মাঝেই দাঁড়িয়ে পড়ছিল থমকে গিয়ে। আকাশের শরীর জুড়ে কখনো কোনো কালো মেঘ ঘনিয়ে উঠলেই নেমে আসছিল এই ধুলোর ঝড়। তাই দেখে শহরবাসীরা ভাবছিল, কংক্রিটে মোড়া লোকবোঝাই শহরে কোথা থেকে উড়ে আসে এই ধুলো? কিন্তু একদিন–দুদিন নয়, প্রায় সপ্তাহ জুড়েই চলেছে প্রকৃতির এমন আচরণ। কিন্তু তাতে কিশোরী বিনুর কী-ই বা আসে যায়? সে রোজ দেহমনে ফুটে ওঠার আনন্দে বিবশ হতে হতে বিকশিত হতে থাকে নিয়মিত। কে জানে কোন্ আনন্দের ঘোর লেগেছে তার গোপন প্রাণের চেতনা ঘিরে। জীবনের সব রকম খুঁটিনাটি বিষয়বস্তু না জেনেও কিশোরী মেয়ে পরম নিশ্চিন্ত প্রতিদিনই তাই ফুটতে থাকে মুদিত কোমল কুঁড়ি থেকে পুষ্পিত জীবনের অভিমুখে।
বিনুর প্রস্ফুটনের দিকে বাড়ির গৃহকর্ত্রীর কঠিন চোখের কড়া শাসন অবশ্য ছুঁয়ে থাকে সর্বদাই। থাকবে না? এমন বয়েসকে কী আর বিশ্বাস করতে আছে? বিশেষত যেখানে ঘরে নিজের যুবক ছেলের উপস্থিতি? আর ওদিকে কিশোরী বিনুরও রোজ রোজ কুঁড়ি থেকে পুষ্পিত হওয়ার পালা? ছেলের সামনে বিনুর মুখে তাই চকিত হাসি দেখলেই মানালি ক্ষেপে ওঠে তপ্ত কিরণ বিরক্তিতে—অ্যাই, শুধু শুধু হাসছিস কেন রে? কি দেখে তোর এত হাসি পায়? এমন জিজ্ঞাসার জবাব জানে না বিনু। কী উত্তর দেবে সে? বরং এমন প্রশ্নে তার চকিত হাসি হঠাৎ করেই শরীর ছাপিয়ে উচ্ছল হয়ে ওঠে। হঠাৎই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কিশোরী। আড় চোখে সামনে বসা তরুণের দিকে চায়। মানালির উনিশ বছরের ছেলে টিভির পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে সহসাই দৃষ্টি ফেলে বিনুর মুখে। তাতে মুহূর্তে বিনুর শ্যামলা মুখে লজ্জাবতীর পরশ লাগে। রঙের জোয়ারে পেলব মুখ রাঙা হয়ে ওঠে পলকে। যেন অচেনা অনুভবের চোয়ানো স্রোত চুঁইয়ে পড়ছে দেহ জুড়ে। লজ্জার ছায়া শিহরণ তুলতেই মাথা নিচু করে ফেলে বিনু। সব দেখেশুনে মানালির চোখের পাতা তিরতিরিয়ে কাঁপে। কী সর্বনাশা অমোঘ মুহূর্ত! এসব দৃশ্য দৃষ্টি ছুঁয়ে সহ্য করা যায় কখনো? জীবনের এই গোপন পাঠ জানা আছে মানালির। তাই সে ধমকে ওঠে গভীর আবেগে—তোকে কখন বলেছিলাম, বাইরে ঝড় উঠেছে, ছাদ থেকে সব জামাকাপড় নামিয়ে নিয়ে আসতে? বিনু অবশ্য ছাদে গিয়েছিল। তবে তার উড়ুউড়ু মন কোথায় যে হারায় থেকে থেকে। সে তাই বলতে ভুলে গিয়েছিল কাকিকে। এখন মনে পড়তেই খলখলিয়ে ওঠে—ছাদে তো গিয়েছিলাম কাকি। কিন্তু জামাকাপড় এখনো শুকোয়নি। শুকোয়নি মানে কি? কোনো কাজ ঠিকমতো করতে পারিস না? নিশ্চয়ই তারের ওপর জড়ো করে রেখেছিলি? না, না। খুব ভালো করেই ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। এটুকু বলতে গিয়েও ফের বিনুর মুখে তরল হাসি। চোখের কোলে গোপন অভিসার। দৃষ্টি ছুঁয়ে রঙিন প্রজাপতির ঝলমলানি। পলকেই যা আছড়ে পড়েছে উনিশ বছরের তরুণের মুখে। মানালির ঝানু চোখে সেটাও ধরা পড়ে। বুকের গহ্বরে অগ্নিকুল জ্বলে ওঠে তার। পরক্ষণেই কঠিন স্বর আরও বেশি কঠিন হয়ে ওঠে—আচ্ছা আবার যা! যা যা শুকিয়েছে তাইই নিয়ে আয়! আর শোন, ফিরে এসে আমার কয়েকটা শাড়ি আজ আয়রন করে দিবি! টিভি রুমে সারা দিন বসে বসে অত গ্যাজলামি করা চলবে না! বুঝেছিস? কি হলো, দাঁড়িয়ে রইলি যে?
হুকুম জারি করে নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছিল মানালি। হঠাৎ প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর কানে এসে ফের জ্বালিয়ে দিল তাকে—তুমি খামোখা ওকে এখন কেন ছাদে পাঠালে মা? ছেলের প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়ায় জননী। দুই চোখের মাঝখানে বিতৃষ্ণার প্রস্রবণ ঝরিয়ে তাকায় কড়া মুখে—খামোখা পাঠালাম মানে? তা ছাড়া কী? বিনু তো মাত্র ঘণ্টা খানিক আগে কাপড় কেচে ছাদে শুকোতে দিয়েছে। মাঝখানে দেখেও এসেছে একবার। ও বলল তো, এখনো শুকোয়নি। শুধু শুধু আবার পাঠালে কেন? কতগুলো সিঁড়ি ভেঙে ফের ছাদে উঠতে হবে জানো? তা নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা হয়েছে কেন রে? তোমার জন্য! এ রকম করলে কাজের লোক থাকবে বেশি দিন? না থাকলে না থাকবে! ভাত ছড়ালে কাকের অভাব? তুই পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব কথায় কান দিতে কেন আসিস? আহা! এত মহা মুশকিল হলো! আমি তো আর বধির নইরে বাবা! তুমি সারাক্ষণ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা কথা বলবে, আর আমি সে কথা কানে শুনলেই দোষ? বুকে জ্বালা পুরে মানালি অনেকবারই চেঁচায়, এ অভিযোগ মিথ্যে নয়। কিন্তু কেন চেঁচায় সে কথা প্রকাশ করলে কে তার কথা মান্য করবে? বরং লজ্জার আড়াল খসে পড়লে এদের গোপন বাঁধটুকুও ভেঙে যাবে তার চোখের সামনেই। মানালি তাই কথা বাড়ায় না এরপরে। কী হবে কথা বাড়িয়ে? যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে তার। পেটের শত্তুর! তা না হলে কথায় কথায় এমন প্রতিবাদী হয়ে ওঠে? কোথাকার কোন্ এক রত্তি কাজের মেয়ে, তার জন্য দরদ উছলে ওঠে এভাবে? মানালি জানে শৈশব থেকে কৈশোরে, তারপর যৌবনে প্রবেশ করাই জীবজগতের ধর্ম। সেই ধর্ম বিনুর জীবনে চাইলেও সে পারবে না প্রতিরোধ করে রাখতে। কিন্তু কিশোরী কেন যখন-তখন খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে? কেন তার চোখের গভীরে অকথিত ভাষায় তরঙ্গ জাগে? চলতে চলতে, বলতে বলতে সহসা সে গোপন চোখের দৃষ্টি ফেলে তাকায় তার ছেলের মুখে? আর তাই দেখে মৃন্ময়ও অনুভূতির চোখে চায়? যে ছেলে তার গর্ভ ফুঁড়ে জন্ম নিয়েছে, তার বুকের ভাষা এখন কী আর অজানা আছে তার? এসব দৃশ্যপট সেই কারণেই মানালির অন্তরে সারাক্ষণই বিতৃষ্ণার ভীতি ছড়ায়।
অবশ্য সত্যি বলতে কী, অপরাধ সৃষ্টিতে কিশোরী বিনুরও খামতি নেই কোনো। যতবার সে মানালির সুসজ্জিত শয়নকক্ষে প্রবেশ করে, ততবারই বৃহৎ আয়নায় নিজ প্রতিবিম্বের ছায়া ফেলে পলকের জন্য মুগ্ধ চোখে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেসব দৃশ্যপট হঠাৎ কখনো চোখে পড়লেই ÿক্ষিপ্ত করে তোলে মানালিকে—এক চেহারা আয়নায় দাঁড়িয়ে সারা দিনে কতবার তোকে দেখতে হয় রে বিনু? তোর কি মিনিটে মিনিটে চেহারার বদল হয়? বাপরে বাপ! এ মেয়ে তো আমার হাড় মাংস এক করে দেবে দেখছি! যেদিকটায় না চোখ দিয়েছি...! আজ সব ঘরের বিছানার চাদর সাবান কাচা করবি! এই তোর কাজ। যা, নিয়ে যা সব। পরে অবশ্য মনে মনে উচ্চারণ করে—ইশ্ চেহারা দেখো না! দিনকে দিন যেন ফুলে ফেঁপে ফেটে-ফেটে পড়ছে! উত্তরে কথা না বলে নিঃশব্দ সম্মতিতে মাথা নাড়ে বিনু। তার মুখের চেহারায় গাম্ভীর্যের ছায়া পড়ে। নত মুখে বিছানার ভারী ভারী চাদর তুলে কোমল হাতে কাচতে থাকে সে। মানালি তারপরেও দেখতে পায়, কদিন আগের এক রত্তি ছোট্ট মেয়েটা এক বৃষ্টিভেজা কদমফুল হয়ে স্নিগ্ধ লাবণ্যের উদ্ভিন্ন দীপ্তিতে ক্রমেই প্রতিদিন প্রসারিত হচ্ছে। আর তার স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সুদর্শন ছেলেটা সেই মায়াজালে আটকা পড়ে ধীরে ধীরে বোধহীন হয়ে যাচ্ছে বৃহৎ কোনো নির্বোধের মতো। মানালির দুচোখ জুড়ে নিরন্তর সে কারণেই এত সতর্ক পাহারা। দু দণ্ড বাইরে বেরিয়েও স্বস্তি নেই প্রাণে!
আজও আকাশের কোণে কালো মেঘের ভিড় জমছিল দুপুর থেকে। জমতে জমতে সেই মেঘ দিন শেষে আজ আর শহর জুড়ে ধূলির ঝড় নয়, ঝরিয়ে দিল বৃষ্টি। ঝমঝমিয়ে একটানা বৃষ্টির স্রোতে মাটির শরীর শীতল হলো। সবুজ গাছের দেহ ঘিরে যত মলিনতা জমেছিল, তারাও ধুয়ে ধুয়ে স্বচ্ছ হয়ে গেল সবাই। বৃষ্টি ভেজা ব্যস্ত শহর ধুয়েমুছে প্রফুল্ল হয়ে উঠল নিমেষেই। ঠিক সেই মুহূর্তে নিরালা ব্যালকনিতে বসে একা একা মেঘ ভরাট আকাশটার দিকে বিনু তাকিয়েছিল অপলক। কী দেখছিল সেখানে, সেই-ই জানে। হঠাৎ শোনা গেলে মিহি সুরে নিচু গলায় গান গাইছে বিনু। তার উচ্চারণে অস্পষ্ট জড়তা। গানের সুর ভাঙা ভাঙা। কিশোরী মেয়ে আপন মনে গুনগুনিয়ে গান গাইছে এমন ঘটনা এ বাড়িতে নতুন নয় অবশ্য। তাতে মানালি ছাড়া বাড়ির আর কেউ বিশেষ কোনো অভিপ্রায়ও খুঁজে দেখেনি কোনো দিন। কে জানে সেই সংগীত ধ্বনি হয়তো বা কানেই আসেনি কারও। কিন্তু যার আসে, আজও তারই শ্রবণে ধরা পড়ল কিশোরী বিনুর অশ্রুত সুর।
মানালি সহসা ব্যস্ত পায়ে ছুটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল—কীরে, এখানে বসে কি করছিস? জবাবে বিনু নিরুত্তর। কী উত্তর দেবে সে? সে কী আর জানে কী করছে এখানে বসে? কী দেখছে অপলকে, মেঘে ঠাসা আকাশের দিকে চেয়ে? নিত্যদিন দেহমনে তার মুদিত কৈশোর বিকশিত হতে হতে পুষ্পিত হতে চাইলেও এখনো জীবনের সব জিজ্ঞাসার জবাব কী আর জানে সে? মানালি ঝুঁকে পড়ে গভীর সংশয় নিয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায় এরপরে—কি হলো রে বিনু? কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে বড়? কাকির কথায় বিনু একবার খলখলিয়ে বলে উঠতে চেয়েছিল—কিছু না কাকি, এমনিই বসে আছি। সব কাজ সারা হয়ে গেছে, তাই বসে আছি। কিন্তু তার বদলে কিশোরী হঠাৎই কেঁদে উঠল হু হু করে। সেটা এমনই সহসা, এমনই অকপটে যে, যেমন সে কথা বললেই হেসে ফেলে চকিতে। যেমন সে চকিতে দৃষ্টি মেলে হঠাৎই মানালির প্রাণপ্রিয় ছেলের দিকে চায়। মানালি বিস্ময় নিয়ে নিচু হয়ে দাঁড়াল। তার গলার স্বরে ঝরে পড়ল মাতৃস্নেহের গাঢ়তা—কাঁদছিস কেন? মৃন্ময় বকেছে তোকে? নাকি আর কিছু? শরীর খারাপ করেছে? কি হয়েছে বিনু? বিনু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল—কেউ তাকে বকেনি। শরীর খারাপও করেনি তার। বিনুর আসলে কিছুই হয়নি। তাহলে? খামোখা কেন কাঁদছিস তুই?
ছোট বিনু অবশ্য বোঝাতে পারেনি, তার উদাসী মনের স্তরে স্তরে আজ ব্যাকুল অনুভবের ছোঁয়া লেগেছে। ব্যথা না পেয়েও, কারণ না জেনেও কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার। যেমন করে মেঘের ছোঁয়া লেগে অনন্ত আকাশের হৃদয়খানা ঝরে পড়ছে বৃষ্টি হয়ে, চারপাশ ভিজিয়ে দিয়ে ঝরে পড়ছে ঝমঝমিয়ে, তেমনিভাবে তারও বড় সাধ হয়ে হয়েছে অশ্রু স্রোতে ভেসে ভেসে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়তে। কে বলেছে, ফুটে ওঠার আনন্দে মেতে কিশোরী কেবলই হাসতে জানে? মেঘবৃষ্টির খেলা খেলে অশ্রু ভাসা আকাশটার মতো বিনুও চায় আজ ছড়িয়ে যেতে। তাই বিনু যে গান গাইছিল তা ওই মেঘ বর্ষণেরই মথিত সংগীত। কেননা হাসি কান্নার স্পর্শ ছাড়া যৌবনের প্রস্ফুটন কী মনের বনে ফুল ফোটায়?
(লেখিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যপ্রবাসী)