কালো আর লাল কালির পথ

বইয়ের প্রচ্ছদ
বইয়ের প্রচ্ছদ

‘দারিদ্র্যতা নিংড়ে ছন্দ
দুঃখ নিংড়ে সুর।’ মেক্সিকান প্রবাদ।
যত দূর মনে আছে আমি ছোটবেলা থেকেই রাত জেগে মার ভয়ে লুকিয়ে চাদরের নিচে আলো জালিয়ে বই পড়তাম। মরার মতো ঘুমানোর চেয়ে আমার কল্পনার রাজ্য নিয়ে জেগে থাকাটাই বেশি পছন্দের ছিল। আর আমার বোন হিলদা প্রতি রাতে ঘুমানোর সময় গল্প না বললে মাকে নালিশ করার হুমকি দিত।
আমার গল্প বানানোর রহস্য জানা ছিল। দাদিমা মাঝে মাঝেই গল্প শোনাত সেই সব দিনের যখন অনেক ভয়ংকর নেকড়ে তাকে তাড়া করত আর সে আমাদের ছাদে পালাত। আমার বাবা গল্প বলত একটা অদ্ভুত বিরাট কুকুরের। যে হঠাৎ করে হাজির হতো আর যতটা জোরেই গাড়ি চলুক না কেন কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াতে থাকত।
যেকোনো মেক্সিকানকে খোঁচা দিলে গল্প বেরিয়ে আসবেই। সুতরাং লেপের নিচে জবুথবু হয়ে বসে আমি রাতের পর রাত আমার বোনের জন্য গল্প বানাতে থাকতাম। কিছুদিনের মধ্যেই সে আবদার করল যে, এখন থেকে তাকে প্রতি রাতে দুটি করে গল্প শোনাতে হবে। আমিও বুদ্ধি করে কয়েক দফায় গল্প বলতে লাগতাম। উত্তেজনার আর রহস্যের জট পাকাতে পাকাতে কয়েক রাত পরে গিয়ে কাহিনি শেষ হতো। মনে হয় ওই সময় থেকেই আমি আমার গল্পগুলো লিখতে শুরু করেছিলাম। আর হয়তো তখন থেকেই ছবি আর লেখালিখির সঙ্গে রাতের এক ধরনের সম্পর্ক জুড়ে গেছে।
শিল্পের উন্মোচন
নৃকাব্যতত্ত্ব অথবা ওঝাদের যে কৌশল সেখানে আমরা স্থানীয় আমেরিকান অধিবাসীরা শিল্প থেকে কৌশলকে আলাদা করিনি, পার্থিব থেকে অপার্থিবকে বিচ্ছিন্ন করিনি, দৈনন্দিন জীবন থেকে নান্দনিক বোধকে কেড়ে নিইনি। ধর্মের পবিত্রতা, সামাজিক বোধ আর শিল্পের মূল আমাদের সংস্কৃতিতে এক হয়ে মিশেছিল। আমেরিকার উপনিবেশ হওয়ার আগে আমাদের কবিরা খোলা আকাশের নিচে ফুল গাছের কাছে জড়ো হয়ে গান গাইত, নাচত, কবিতা আবৃত্তি করত। গল্পের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা গল্প বলিয়ে আর শ্রোতাকে অন্য মানুষে বা অন্য কিছুতে রূপান্তর করতে পারে। লেখকদেরও নাহুয়াল (nahual: আধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন একজন মানুষ যে নিজেকে অন্য প্রাণীতে রূপান্তরিত করতে পারে) বা ওঝাদের মতো জাদুকরী ক্ষমতা আছে।
আমি যে বইটা লিখছি তা এখন শেষের দিকে প্রায়। আমি বইটার দিকে তাকালেই একটা মোজাইকের নকশা (এখানে মোজাইকের নকশা রূপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে) দেখতে পাই, ঠিক যেন সুতোয় বুনানো, কোথাও হালকা কাজ, আবার কোথাও গাঢ়।
আমি দেখি পরতে পরতে সেই ছাচের ভেতরের গভীর কারুকাজ, তার ভেতরে জেগে উঠে লাল মাটি, কালো মাটি। আমি সেই গভীর গাঁথুনি দেখতে পাই। আমি যদি কাঠামো ঠিক মতন গড়তে পারি, তাহলে তাতে প্রাণ দিতে খুব কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু মাঝে মাঝে কাঠামোর জন্য অস্থি, মজ্জা, কঙ্কাল তৈরির আগেই হাজির হয়। যদিও আবছা অন্ধকারে ঢেকে থাকে কিন্তু অনাবৃত হতে থাকে লেখার শুরুতে, মাঝে আর শেষ পর্যায়ে গিয়ে। অসংখ্য আঁকিবুঁকি, কোথাও এবড়োখেবড়ো জমিন আবার কোথাও মসৃণ, এসব কিছু আচ্ছন্ন করে রাখে আমাকে।

আমি দেখি শেষ রংটুকু নিজেরই অস্তিত্বকে মিটিয়ে দিয়ে সীমানা ছাড়িয়ে উপচে পড়ছে, ছড়িয়ে পড়ছে অন্য সব কিছুতে, ছড়িয়ে পড়ছে ফ্রেমের বাইরে। আমি অনুভব করি রূপকের ছড়াছড়ি। নানান রকম চিন্তাভাবনা এখানে ওখানে ওত পেতে উঠছে যাদের কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। যদিও আমি সাজানো গঠনপ্রণালিতে বিশ্বাস রাখি যেখানে সব বিষয়ই পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং একে অন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত। প্রায় শেষ হয়ে আসা কাজটিকে এক সঙ্গে সবকিছু জড়ো করে বানানো একটা মন্টাজ (এক ধরনের শিল্প যেখানে অনেক ছোট ছবি একত্র করে কোনো অর্থবহ চিন্তার অবকাশ ঘটানো হয়) অথবা যত্নে গাঁথা কোনো মালা মনে হচ্ছে, এক অদ্ভুত ছন্দে তা যেন নেচে বেড়াচ্ছে।
এর যেন নিজস্ব একটি সত্তা আছে, যা আমাকে দিয়ে নিজের ধাঁধার উত্তর মিলিয়ে নিচ্ছে। সে যেন এক বিদ্রোহী, স্বেচ্ছাচারী অস্তিত্ব, একটা ইঁচড়ে পাকা মেয়ে শিশু। যে বয়সের থেকে বেশি বুঝতে শিখে গেছে অভদ্র, জেদি, তার সারা গায়ে এখানে ওখানে পালক, পশম, ডাল পালা, কাদামাটি। আমার সন্তান, কিন্তু খুব বেশি সময়ের জন্য না। মা মনসার (হিন্দুদের দেবী) মতো এই নারীর সত্তা রুষ্ট, বিমর্ষ, উল্লসিত, পায়রা, ঘোড়া, সাপ, ফণীমনসা। যদিও সে নিখুঁত না—একটা অন্ধ দুরূহ কদাকার বস্তুমাত্র, কিন্তু আমার কাছে সে জীবিত-উদ্দীপনায় ভরপুর। তার সঙ্গে আমার কথা হয়।
আমি ধূপ আর শস্য দিয়ে পূজা করে মোমবাতি জ্বালাই। মাঝে মাঝে হয়তো আমি কিছু চেয়ে প্রার্থনাও করি। তারপর পানির কল ছেড়ে, থালাবাসন অথবা জামাকাপড় ধুয়ে আমি গোসল করি অথবা রান্নাঘরের মেঝে পরিষ্কার করি। এই ভূমিকা পর্ব কখনো কয়েক মিনিট আবার কখনো কয়েক ঘণ্টা অবধি চলে। কিন্তু আমি সব সময় বাধার বিরুদ্ধে যাই। আমার ভেতর কিছু একটা কাজ করে যা আমাকে লেখালিখি করতে বাধা দেয়। কিন্তু একবার যদি লেখার ভেতরে ডুব দিই তাহলে পনেরো মিনিট থেকে সতেরো ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও লেখা ফেলে উঠতে ইচ্ছা করে না।
আমার গল্পগুলো সময়ে বন্দী করা ঘটনাপ্রবাহের মতো। যখনই কেউ গল্প বলে বা নীরবে পড়তে থাকে গল্পগুলো তখনই আবার জ্যান্ত হয়ে যায়। আমার গল্পকে আমি অভিনয় শিল্পের মতো ভাবতে ভালোবাসি, জড় বস্তুর মতো না (যেমনটা পশ্চিমারা নান্দনিক শিল্পকে নিয়ে ভাবে)। অথচ, এই লেখার একটা পরিচয় আছে, প্রাণ আছে, এর মধ্যে দিয়ে হয়তো কোনো দেবতা, পূর্বপুরুষ বা প্রকৃতি বা দৈব শক্তির পুনর্জন্ম হয়েছে। আর এই লেখা একজন মানুষের মতোই অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, এরও ক্ষুধা মেটাতে হয়।
যখনই ডাকা হয় তখন এর ঘটনা অথবা বস্তু সবকিছুই বর্তমানে চলে আসাকেই গল্প বলে। এই গল্প লেখা বা বলার ক্ষমতাটা নৈসর্গিক। এর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা হচ্ছে সে দেবতা ও মানুষের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং এর কাজ হচ্ছে দেবতাদেরকে জাগ্রত করা। মহাবিশ্ব ও তার শক্তি পরিচালনাই এ ধরনের কাজের ধর্ম। যখন সে এই ক্রিয়ার মধ্যে যখন থাকে না আমি তাকে চিনতেও পারি না। হয়তো তখন সে এই ক্রিয়ার থাকে আবার থাকে না। ঠিক যেমন আধ্যাত্মিক নৃত্যের সময় মুখোশের কতটা প্রবল ক্ষমতা থাকে, কিন্তু এমনিতে হয়তো একটা জড়বস্তু মাত্র। কিন্তু কিছু কিছু কাজ চিরকালের জন্য এক ক্রিয়ার সঙ্গে চলতে থাকে। যেমন কিনা টোটেম (নেটিভ আমেরিকান মূর্তি শিল্প) পোল, গুহার দেয়ালের চিত্রকর্ম।

জাগিয়ে তোলা শিল্প
এসব জ্যান্ত শিল্পকর্ম সাম্প্রদায়িক ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের কথা বলে। মানুষের জীবনের সাক্ষর রাখাই এর মূল উদ্দেশ্য। কারণ এই সব শিল্প মানুষকে আশাবাদী করে, আনন্দ দেয়, নিশ্চিন্ত রাখে। কিন্তু এর অনেক খারাপ প্রভাবও থাকতে পারে। যার কারণে মানুষকে নিজের সত্যতা যাচাই করতে এগিয়ে যায়।
পশ্চিম ইউরোপীয় সংস্কৃতি সাধারণত চারুশিল্পের যেসব নান্দনিক বৈশিষ্ট্যকে মেনে চলে তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে অভ্যন্তরীণ প্রণালির শক্তি যেমন দ্বন্দ্ব, ছন্দ, সমাধান ও ভারসাম্য এসব কিছুকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা। এভাবে গুণাবলি ও অভ্যন্তরীণ অর্থের অস্তিত্ব বজায় রাখা হয়। এসব এর মধ্যেই নিহিত তার সার্থকতা। এর কাজ হচ্ছে বিষয়বস্তু, কৌশল, অনুভূতি এসব কিছুতে আধিপত্য অর্জন করে মানুষকে বিমুগ্ধ করা। তারা ব্যক্তিনির্ভর, সাম্প্রদায়িক না। মনস্তাত্ত্বিক ঘুরপাকে তা নিজের ও দর্শনার্থীদের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে।
পশ্চিম ইউরোপীয় সংস্কৃতির শিল্পের কাজ নিয়ে উপজাতি সংস্কৃতি থেকে ভিন্ন দৃষ্টি ভঙ্গি বহন করে। তাদের শিল্পকে গৃহবন্দী করতে শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদদের দিয়ে ঘর তৈরি করে, তারপর বিমা আর রক্ষীবাহিনী দিয়ে আগলে রাখে। তত্ত্বাবধায়কেরা সংরক্ষণ করেন, বিশেষজ্ঞরা ফ্রেমে বাধাই করে প্রদর্শন করেন। তারপর শিক্ষিত ও উচ্চ জাতের মানুষ এসব শিল্প পরিদর্শন করতে আসে। উপজাতি সংস্কৃতির মানুষেরা তাদের শিল্পকর্মকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ঘরে বা অন্য কোথাও পবিত্র স্থানে রাখে। তারা এই শিল্পের সঙ্গে সম্মিলিত হয় (ছাগল বা মুরগির) রক্ত বলিদান দিয়ে আর ওয়াইনের সুরা ইত্যাদির অর্ঘ্য দিয়ে। তারা তাকে নাইয়ে, খাইয়ে, কাপড় পরায়।
এসব শিল্পকর্মকে তারা মানুষের মতো দেখে, কোনো বস্তু হিসেবে দেখে না। এখানে সাক্ষীরা শিল্পের সৃষ্টির সঙ্গে তাদের পূজায় শামিল থাকে, শুধুমাত্র সমাজের বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত কোনো সদস্য হিসেবে নয়।
এথনোসেন্টিসম (ethnocentrism: নিজের গোষ্ঠীকে বা চিন্তাধারাকে সবার থেকে উচ্চতর ভাবা) পশ্চিমাদের নন্দনতত্বের এক স্বৈরশাসন। আমেরিকান মিউজিয়ামে ভারতীয় (নেটিভ ইন্ডিয়ান) মুখোশ একটা অদ্ভুত শৈল্পিক ধারায় রূপান্তরিত হয়। যার মধ্যে শক্তির কোনো উপস্থিতি নেই যাকে অর্চনার কোনো আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে জাগিয়ে তুলতে হয়। এই সব শিল্প যেন জিতে নেওয়া কিছুর মতো। মৃত বস্তুর মতো, প্রকৃতি থেকে, তার নিজের শক্তি থেকে আলাদা হয়ে যায়।
আধুনিক পশ্চিমা আঁকিয়েরা ধার করেছে, অনুকরণ করেছে অথবা হয়তো দূরদর্শন করেছে উপজাতীয় সভ্যতার শিল্প। নাম দিয়েছে কিউবিসম, সুররিয়ালিজম, সিমবলইসম (Cubism, Surrealism, symbolism: বিংশ শতাব্দীতে উদ্ভাসিত কিছু তাৎপর্যময় শিল্প শাখা) । সেই সুর, ড্রামের বিট আর কালোদের জাইভ কথাকাব্য (jive talk: দ্রাম, বিটঃ বাদ্য যন্ত্র ১৯৪০-৫০ এর ব্ল্যাক আমেরিকান জ্যাজ শিল্পীদের বাক্যালাপ)। সব ওদের দখলে। সাদারা (পশ্চিমা) আর আমাদের কিছু মানুষ মিলে তাদের আত্মিক শেকড় থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলেছে। আর আমাদের আত্মিক শিল্পকে ফিরিয়ে আনতে এক চেতনাহীন প্রয়াসের মধ্যে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা যদি তা করতেই চায় আমি আশা করি তারা ঠিক পথ ধরে তা করবে এবং বুঝেশুনে করবে তারা কি করতে যাচ্ছে।
আসুন আমরা গ্রিক পুরান আর পশ্চিমা কার্টিজিয়ানের আদর্শ আমদানি করা বন্ধ করি। নিজেদের সমর্পণ করি এই মহাদেশের আত্মার গভীর পৌরাণিক মাটিতে। সাদাদের আমেরিকা শুধুমাত্র মাটির দেহকে জয় করেছে তা শোষণ করার জন্য। কখনো তাকে রক্ষা করতে বা তাকে লালন করতে চায়নি। গোপনে আমাদের জীবনী শক্তি কেড়ে তা দিয়ে বাণিজ্যিক চাহিদা না মিটিয়ে সাদারা আমাদের কাছ থেকে শ্রদ্ধার সঙ্গে শিখতে ও জানাতে পারে।
কুরান্দেরিসমো, সান্তেরিয়া, সামানইসম, দাউইসম, জেন (Curanderismo: সামানিক চিকিৎসা, Santeria: সিনক্রেটিক ধর্ম, Shamanism, Taoism: চায়না থেকে উদ্ভব একটি দার্শনিক ধর্ম, Zen: মাহায়ানা বুদ্ধ ধর্মের একটি শাখা) এসব কিছু গ্রহণ করে অথবা ভিন্ন রঙের মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন ও তাদের আচার অনুষ্ঠান শিখে। অ্যাংলোরা (ইংলিশ আমেরিকান—যারা ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত) হয়তো তাদের ওই সাদা নিষ্ফলতাকে শৌচঘর, হাসপাতাল, শবাগার, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি সবকিছু থেকে দূর করতে পারে। যদিও সচেতন মনে কালো রং ও অন্ধকার হয়তো মৃত্যু, অশুভ ও ধ্বংসের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু সাদা রং আমাদের অবচেতনে ও স্বপ্নে রোগ, মৃত্যু, আশাহীনতার সঙ্গে সংযুক্ত। আশা করি এই বাঁহাতি যা কিনা অন্ধকারাচ্ছন্ন, স্ত্রীসুলভ, আদিম, নামে পরিচিত রূপান্তর করতে পারবে ওই নির্লিপ্ত, ডানহাতি, যুক্তিসম্মত, আত্মঘাতী সক্রিয়তা যা বেখেয়ালি হলেই আমাদের মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অ্যাসিড বৃষ্টির মতো গুঁড়িয়ে দিতে পারে।

গায়ক, আমি (Ni cuicani)
প্রাচীন আযটেকদের (মেক্সিকান জনগোষ্ঠী) জন্য, পুথির ওপর কাল আর লাল কালির অঙ্কনকে সাহিত্য ও জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হতো। তাদের বিশ্বাস ছিল যে রূপক ও প্রতীক চিহ্ন, কাব্য ও সত্য দিয়ে সর্গের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব। topan (যা কিছু ওপরে অবস্থান করে। দেবতা ও ফেরেশতাদের পৃথিবী) যুক্ত হতে পারবে mictlan (যে সবকিছু নিচে অবস্থান করে। পাতালপুরী আর মৃতদের দেশ)।
কবিঃ সে দমকলের মুখ থেকে পানি ঢালছে, হাতল নামিয়ে আবার তুলছে, নামাচ্ছে, তুলছে। তার হাত অন্ত্র থেকে টান অনুভব করে। যেন কোনো জ্যান্ত প্রাণীর প্রতিরোধ। গভীর থেকে এক দীর্ঘশ্বাস নিংড়ে ওঠে। হাতলটা তার হাতে যেন হিংস্র হয়ে ওঠে। চোখে মুখে হঠাৎ ঠান্ডা পানির ঢল উপচে এসে পড়ে। রাতের আলোর আতঙ্ক বালতিতে ভর্তি হতে থাকে।
একটা ছবি আবির্ভূত ভাব আর আত্মসচেতন জ্ঞানের মধ্যে সাঁকোর মতো; শব্দগুলো তারের মতো সেই সাঁকোকে ধরে রাখে। ছবি বেশি স্পষ্ট, অনেক বেশি তড়িৎ শব্দের থেকে এবং আমাদের অচৈতন্যর সব থেকে কাছে। ছবির ভাষা আমাদের চিন্তাকে শব্দের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নেয়। আর রূপক অলংকারযুক্ত মন এগিয়ে নেয় বিশ্লেষণধর্মী চৈতন্যর পথে।

সামানিক (Shamanic সামানদের নিয়ে। সামানরা মানুষ ও আধ্যাত্মিক পৃথিবীর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে থাকে) ভাব
যখন আমি গল্প তৈরি করি অথবা আমার মনের পর্দায় সব কণ্ঠ আর দৃশ্য অভিক্ষিপ্ত করতে দিই তখন আমি সম্মোহনে চলে যাই। আমি আগে ভাবতাম আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি অথবা বিভ্রান্তি হচ্ছে। কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারি এই কাজ আমারই, আমার ডাক, এই ছবির ভিড়ে বিস্তরণ করা। একদম চলচিত্রের মতো বর্ণনা আমি কিছু লিখে রাখতে পেরেছি। বেশির ভাগই হারিয়ে ফেলেছি বা ভুলে গেছি। আমি যখন এসব ছবিগুলোকে লিখে রাখি না কয়েক দিন, সপ্তাহ কিংবা মাস তখন আমি শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরি। কেননা আমার লেখা আমার অচেতন মনকে জাগিয়ে দেয়, আর যেহেতু কিছু কিছু ঘটনা আমার অতীতের অবশিষ্ট অংশ তাই আমার তাকে আবার ভেঙে সাজাতে হয়। মাঝে মাঝে আমি যখন লিখি তখনো অসুস্থ হয়ে পরি। আমি ধারণ করতে পারি না। আমার গা গোলায় অথবা জ্বরে গা পুড়তে থাকে, আরও খারাপ অবস্থা হয়। কিন্তু এই সব ছবি বা কাহিনির পিছে যেসব মানসিক আঘাত রয়েছে এসবকে পুনর্গঠন করে আমি তাদের অর্থপূর্ণ করতে চাই, যখন তাদের কোনো অর্থ হয় তখন তারা বদলে যায়, রূপান্তরিত হয়। এভাবেই আমার লেখনী আমাকে ভালো করে তোলে, আমাকে অসীম আনন্দ এনে দেয়।
গানের সঙ্গে চলচ্চিত্রের মিল করার জন্য আমার একা থাকতে হয় অথবা চেতনা বহির্ভূত অবস্থায় থাকতে হয়। আমি কানে তুলো দিই, কালো কাপড় দিয়ে আমার চোখ ঢেকে সোজাসুজি শুয়ে পরি, ঘুম আর জেগে থাকার মাঝামাঝি একটা অবস্থায় আমার দেহ ও মনকে আটকে রাখি কল্পনায়। আমি এর মধ্যেই বন্দী। আমার শরীর অনেক ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছে। শুরুতে মনে হয় যেন চলচ্চিত্রের নাট্যশালায় দর্শকের মতো দেখছি। ধীরে আমি নাটকের ক্রিয়ায়, কথোপকথন নিমজ্জিত হয়ে একসময় এই নাটকে অংশগ্রহণ করি। আমার যুদ্ধ করে এই জ্যান্ত গল্প থেকে সরে অথবা পালিয়ে আসতে হয়। আমার ঘুমানো দরকার যাতে আগামীকাল আমি লিখতে পারি। কিন্তু আমি এমন এক গল্পের খপ্পরে যে আমাকে যেতে দেবে না। ফ্রেমের বাইরে আমি চলচিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, ক্যামেরা অপারেটর, আর ফ্রেমের মধ্যে আমিই অভিনেতা পুরুষ ও নারী আমি মরুভূমির বালু, পাহাড়, আমি কুকুর, মশা। আমি চার থেকে ছয় ঘণ্টার চলচ্চিত্র ধারণ করতে পারি। যখন আমি জেগে উঠি তখন যেকোনো স্থানের বেশ কতগুলো পাঁচ থেকে তিরিশ মিনিটের ছোট অংশ আমি মনে করতে পারি। এসব বর্ণনা আমার ওই সব চেতনা বঞ্চিত সময়ের মধ্যে থেকে উঠে আসা গল্প। (চলবে)
লেখিকার বর্ডারল্যান্ডস বইয়ের দ্য পাথ অব রেড অ্যান্ড ব্ল্যাক ইন্‌ক অংশ থেকে অনূদিত। সংক্ষেপিত।
(অনুবাদক জেসিকা ইসলাম মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরপ্রবাসী)