সম্প্রতি বাংলাদেশে আমার খুব কাছের একজন পাত্রীর জন্য একটি সম্বন্ধ এসেছিল। ছেলে উচ্চশিক্ষিত, ভালো বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত, আচার ব্যবহার ভালো; পারিবারিক ঐতিহ্য প্রশ্নাতীত, সচ্ছল, নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার।
পাত্রীর অগ্রজের সঙ্গে ইন্টারভিউ উতরে পাত্র এল পাত্রী দেখতে। ছেলের সঙ্গে ছেলের আত্মীয়স্বজন। বাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ। মধ্যবিত্ত পরিবারের পাত্রী দেখা পর্বে যা হয়, আত্মীয়স্বজনের কমতি নেই। হবু কনেকে ঘিরে ছোট ভাই–বোনদের খ্যাপাখ্যাপির পর্ব।
ব্যস্ততার মাঝে ড্রয়িংরুমের দরজার ফাঁক গলে পাত্রীর মায়ের চোখ পড়ে যায় ছেলের ওপর। চমকে যান তিনি। হন্তদন্ত হয়ে চলে যান রান্নাঘরে, যেখানে পাত্রীর অগ্রজের সঙ্গে আরও কজন ভাই-বোন। মা দরজাটা চাপিয়ে দেন, তোদের কি মাথা খারাপ হয়েছে? তোরা এটা কী ধরে নিয়ে এসেছিস? ঘুটঘুটে কালো একটা ছেলে। ভাগ্যিস, ঘরে দিনের বেলায় লাইট জ্বালানো ছিল। আমাকে মেরে ফেললেও আমি এ ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ে বিয়ে দেব না। তোদের বাপ নেই বলে আজকে তাই ওকে আমার এভাবে জলে ভাসিয়ে দিতে হবে?
ঘটনাটা খুবই স্বাভাবিক, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। এখানে সুন্দরের বিচার হয় গায়ের রং দিয়ে। এখানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো লাইসেন্স পায় ত্বক ফরসা করার ক্রিম বিক্রির; পাত্র/পাত্রী পক্ষকে সন্তুষ্ট করার জন্য বিয়ের সময় যাতে ফরসা দেখা যায়, তার জন্য কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে সে ক্রিম ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয় বিজ্ঞাপনে। এখানে কৃষ্ণবর্ণ মেয়ের বিয়ের জন্য কৃষ্ণকায় ছেলের পায়ে ধরেন বাবা-মা! বিয়ের বয়স পেরিয়ে যায়; কৃষ্ণকলিকে মা-বাবা জলাঞ্জলি দেন যৌতুকে। কৃষ্ণ পাত্রে ফরসা পাত্রীপক্ষের আপত্তি যত, কৃষ্ণ পাত্রীতে কৃষ্ণ পাত্রের আপত্তি তার চেয়ে শতগুণ। যে মায়ের ঘরে কালো মেয়ে, সে মাও চান তাঁর কালো ছেলের বউটি ফরসা হোক।
উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাডিসন ক্যাম্পাসে একটা বক্তৃতা দিয়ে পিটসবার্গ ফিরছি। চল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতায় প্লেনে বসে এ লেখা লিখছি। উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার প্রাক্তন ছাত্র ইমানুয়েল কাজ করছে চার বছর ধরে। কৃষ্ণকায় ইমানুয়েল, তার স্ত্রী উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ধাত্রী বিশেষজ্ঞ শ্বেতাঙ্গিনী ক্যাথরিন (ক্যাট), দুই বছর বয়সী মেয়ে মিরিয়াম, আর দুই মাস বয়সী ছেলে ইলাইকে নিয়ে ছোট্ট শহর মিডলটনে সুখের সংসার।
ক্যাটের জন্ম ও বেড়ে ওঠা উইসকনসিন রাজ্যের ছোট্ট একটি গ্রামে। গ্রামের ১০০ ভাগ শ্বেতকায় জনগোষ্ঠীর জীবিকা গবাদি পশুপালন আর ভুট্টা চাষ। আমেরিকার কৃষকেরা সাধারণত শিক্ষিত ও ধনী, যা আমাদের দেশের একেবারেই উল্টো। মা গৃহস্থালি দেখভাল করতেন। এক ভাই ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক আর আইনে জুডিশিয়াল ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে এখন মিলওয়াকি শহরে কর্মরত। অন্য ভাইও কলেজ শেষ করে কাজ করছে শিকাগোতে। একমাত্র বোন ক্যাট। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পাট চুকিয়ে ক্যাট ভর্তি হয় মেডিকেল কলেজ অব উইসকনসিনে। পড়া শেষ করে যোগ দেয় ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের বিখ্যাত ম্যাগি নারী হাসপাতালের ধাত্রীবিদ্যা বিভাগে, তিন বছরের আবাসিক প্রশিক্ষণে।
তখনই ঘটে সর্বনাশটা! আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। পরিচয় হয়ে যায় ঘানা থেকে আসা প্রাণ-পরিসংখ্যান বিভাগের সদা হাস্যময় প্রাণোচ্ছল ছাত্র ঘুটঘুটে কালো ইমানুয়েল সাম্পিনের সঙ্গে। কালো আফ্রিকান ছেলেটার সহজ–সরল প্রাণবন্ত সদা হাস্যময় ব্যক্তিত্ব আকৃষ্ট করে ধবধবে সাদা উইসকনসিনের অজপাড়াগাঁয়ে বেড়ে ওঠা সুন্দরী ক্যাটকে। বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসা, ভালোবাসা থেকে প্রণয়। তার বছরখানেকের মধ্যে ক্যাটের মা পিটসবার্গে আসেন মেয়ের সঙ্গে দুদিন সময় কাটাতে। ডিনার খেতে খেতে ক্যাট তাকে পরিচয় করিয়ে দেয় তার প্রাণ ম্যানির (ইমানুয়েল) সঙ্গে। মায়ের গলা দিয়ে খাবার নামছে না আর এ খবর শুনে। সারা রাত মা–মেয়েতে যুক্তিতর্কের তরজা।
-তোর বাবা শুনলে তোকে ঠিক মেরে ফেলবে (ওদের উইসকনসিনের বাসায় সত্যি সত্যি মানুষ মারার বন্দুক আছে কয়েকটা)। তুই কেমন করে ওকে নিয়ে যাবি বাড়িতে?
-কেন, কী সমস্যা? তুমি তো ওকে দেখলে। ও কি খারাপ মানুষ?
-না, তা নয়, কিন্তু...
-কিন্তু কী? ও কালো? ওর চামড়ায় মেলানিন বেশি, সেটা সমস্যা?
মা চুপ করে থাকেন। উনি ক্যাথেরিনকে কীভাবে বোঝাবেন যে ১০০% সাদা চামড়ার মানুষের মধ্যে যখন ক্যাথেরিন তার ম্যানিকে নিয়ে যাবে, লোকজন তাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। ওরা পথ দিয়ে হাঁটবে, লোকজন ওদের দিকে তাকিয়ে থাকবে সার্কাসের জন্তুর মতো। ওদের জন্য চার্চ খুঁজতে হবে যারা জাতের বাইরে বিয়ে অনুমোদন করে। বাইবেল বেল্টের কাছাকাছি রাজ্য উইসকনসিনে তা খুঁজে পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। আরও কত কী...কীভাবে উনি বোঝাবেন, তাঁর একত্রিশে পা দেওয়া ডাক্তার মেয়েটিকে?
মা চলে যান পরদিনই। যাওয়ার সময় প্রিয় মেয়ে ক্যাটকে নিবিড় আলিঙ্গনে বিদায় জানান। ক্যাথেরিন ভয় পেয়ে যায়। এই কি তাহলে মায়ের সঙ্গে শেষ দেখা? মা ফিরে গিয়ে ফোনে জানান ওনার নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের কথা। আর কোনো কথা হয় না তাঁর সঙ্গে।
ঠিক তেরো দিনের মাথায় মা ফোন করেন আবার। জিজ্ঞেস করেন ম্যানির কথা। ক্যাটের ভালো লাগে মায়ের সঙ্গে ওর গল্প করতে। ক্যাটকে চমকে দিয়ে মা বলেন, ওকে বাসায় নিয়ে আসতে বলেছেন বাবা। কী ঘটেছে এ তেরো দিনে বাসায়, ক্যাট তা জানেনি কখনো। জানতে চাইলে মা-বাবা দুজনেই গেছেন এড়িয়ে। ক্যাট রাজি হয় ম্যানিকে নিয়ে যেতে তার জন্মস্থানে, তার জীবনের প্রথম আঠারো বছরের স্মৃতিময় গৃহটিতে। তারপরের ঘটনাগুলো অসম্ভব দ্রুততায় ঘটে যায়। ইমানুয়েল ক্যাথলিক শোনার পর ওর বাবা আর আপত্তি করেননি ওদের বিয়েতে।
আমি মিরিয়ামকে আর ইলাইকে কোলে নিই পালা করে। ক্যাটকে অবাক করে দিয়ে অশান্ত ইলাই আমার কোলে এসে শান্ত হয়ে বসে। আমার কোলে বসে নিশ্চয়ই ও ভাবছে, এই বাদামি চামড়ার লোকটা আবার কোথা থেকে এল রে বাবা! সাদা দেখেছি, কালো দেখেছি, হাফ সাদা হাফ কালো দেখেছি, বাদামি তো দেখিনি! ইলাই দেখতে বেশি ক্যাট-এর মতো। আর মিরিয়াম পেয়েছে ইমানুয়েলের গড়ন আরে ক্যাটের গায়ের রং। আমি ভাবছি এ ছোট্ট শিশু দুটি কী ভাবছে তাদের বাবাকে নিয়ে। ওরা কী ভাবছে—আমি ওকে বাবা বলব না, কারণ ও ভয়ানক কালো?
মানুষের সৌন্দর্য কিসে? গায়ের রঙে? ফরসা গায়ের রং কি কারও অর্জন? বিধাতা ললাটে যা দিয়েছেন তা নিয়ে কি গৌরব করা সাজে? শিক্ষা অর্জন করা যায়। ভালো চাকরি অর্জন করা যায়। ভালো আচার ব্যবহারকে জীবনের অংশ করা যায়। ধূমপান না করে থাকা যায়। চুল বড়/ছোট রাখা যায়। পলিটিকস না করে থাকা যায়। ধর্ম পালন করা যায়। কিন্তু গায়ের রং ফরসা নিয়ে কি জন্মানো যায়? টাইম মেশিনে করে সাত পুরুষ আগে গিয়ে ব্লন্ড মেয়েদের সঙ্গে মহাদাদাদের বিয়ের ব্যবস্থা করে আসতে পারলে না হয় একটা কথা ছিল। যদি তা–ই হয়, তাহলে যা নিজের অর্জন নয়, তা নিয়ে গৌরব কিসের?
নেলসন ম্যান্ডেলার নাম শুনলে সব বাংলাদেশির গা শিউরে ওঠে আবেগে, উদ্দীপনায়। আমরা তাঁর গল্প পড়তে ভালোবাসি। তাঁর জীবনী গান, গল্প যারপরনাই উদ্বুদ্ধ করে আমাদের। মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্নভরা বক্তৃতা শুনে আমরা অনুপ্রাণিত হই! কিন্তু ওদের চামড়ার এক শ ভাগের এক ভাগ কালো চামড়ার (বাদামি বলাই শ্রেয়) ছেলে-মেয়েদের আমরা বিয়ে করতে বা তাদের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাই না। কারণ, তারা কালো বলে! আমরা লোকমান হোসেন ফকিরের লেখা ‘আমায় একটা সাদা মানুষ দাও’ গানটি ভূপেনের গলায় শুনতে খুবই পছন্দ করি, কিন্তু কালো মেয়েকে কালো বলে মুখ ফিরিয়ে নেই। আমরা বহুবার ভাবসম্প্রসারণে পড়েছি, ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবারি সমান রাঙা’। কিন্তু আমাদের ভেতরটা আসলে এখন কালোই রয়ে গেছে।
চল্লিশ হাজার ফুট উচ্চতা থেকে প্লেনটি ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। আমি বুঝতে পারি পিটসবার্গ কাছে এসে গেছে। আমি জানালা দিয়ে নিচে তাকাই। হাইওয়েতে অসংখ্য গাড়ির সারি। এত দূর থেকে কোনটা কোন রঙের তা বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সব গাড়ি চলছে তার গন্তব্যে। আরও নিচে নেমে আসে প্লেন। একেবারে অবতরণের মুহূর্তে আমি লক্ষ করি এয়ারপোর্টে কর্মরত মানুষগুলোকে। ওরা কালো কি সাদা, তা বুঝতে পারছি না। কিন্তু বুঝতে পারছি ওরা আমাদের প্লেনটি অবতরণের জন্য যা যা করা দরকার সবই করছে। কালো বা সাদায় কী যায় আসে?
লেখক: পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব পিটসবার্গের প্রাণ-পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক।