কালের যাত্রার ধ্বনি

রংপুর ক্যাডেট কলেজ
রংপুর ক্যাডেট কলেজ

সময়কে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকেরা কম মাতামাতি করেননি। কারও কারও লেখা কালজয়ী হিসেবে উত্তীর্ণ। কিন্তু তারপরেও তারা সময়কে জয় করতে পারেননি!

ইংরেজ কবি রাল্ফ হডগ্সন ৯১ বছর বেঁচে ছিলেন। সময়কে নিয়ে টাইম, ইউ ওল্ড জিপসিম্যান নামে তার একটা ধ্রুপদি কবিতা তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন; কিন্তু তারপরও শতায়ু হয়ে সময়কে জয় করতে পারেননি। আসলে, সময়কে নিয়ে আরও অনেক কবি সাহিত্যিকই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন; এমনকি আমাদের রবীন্দ্রনাথও বাদ যাননি। শেষের কবিতা উপন্যাসের লাবণ্যকে দিয়ে শেষ যে চিঠিটি অমিতকে লিখিয়েছিলেন, সেটাও ছিল এ রকম—কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও? তারি রথ নিত্য উধাও।...ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল/জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল...। লাভ হয়নি কোনো, রবীন্দ্রনাথকেও চলে যেতে হয়েছে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলা কঠিন। তারপরও দিতে হতো, কারণ ওটা ছিল ক্যাডেট কলেজ! ওখানে ওটাই শেখানো হতো আমাদের। ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতন টিকটিক করেই চলত জীবন। যে জীবন দোয়েলের, শালিকের; সেই জীবন নয়। সে এমন এক জীবন যেখানে পান থেকে চুন খসে পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তারপরও যে ব্যত্যয় ঘটত না, তা নয়। কিন্তু তার জন্য মাশুল দিতে হতো। যুক্তিসংগত কারণ থাকলে অবশ্য অন্য কথা!
বাঁশির পুতুল ছিলাম আমরা সবাই। বাঁশির শব্দে ঘুম ভাঙত, বাঁশির শব্দেই প্যারেড, পিটি, খেতে যাওয়া থেকে শুরু করে খেলাধুলা পর্যন্ত; সবকিছুই। সেটাই ছিল আমাদের দুরন্ত কৈশোর। ঘাগট নদীর পাড়ে ইট, কাঠ, পাথর আর কংক্রিট জঙ্গলের ওই অত্তটুকুন জায়গায় আমাদের দুরন্ত সেই কৈশোর বন্দী হয়ে থাকলেও তা ছিল বর্ণিল আর ছন্দময়।
অপরাধ করে ধরা খেলে পাঙ্গা টাঙ্গা না দিয়ে পিতৃস্নেহে ক্ষমা করে দিতেন মুহাম্মদ জয়েনুদ্দিন স্যার। বিশাল দেহের মতো বিশাল একটা মনের অধিকারী বাংলার এই অধ্যাপক অপলক চেয়ে থাকতেন আর আমার ভবিষ্যৎ চিন্তায় শঙ্কিত হয়ে পড়তেন। চোরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদুরে গলায় বলতেন—
হুম! এভাবে কী দিন যাবে বাবা...?
স্যারের মহানুভবতায় কুঁকড়ে যেতাম। অপরাধ যন্ত্রণায় কাতর আর নিশ্চুপ এই আমি মাথা নিচু করে মাটির দিকে চেয়ে থাকতাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতাম, এমনটা যেন আর না হয়। আজ এত বছর পর স্যারের সেই প্রশ্ন মনে ভেসে উঠল। সেই দিনগুলোতে উত্তর খুঁজে পেতাম না। এখন পাই।
আরেক দিনের কথা মনে পড়ে, কলেজ ডিউটি মাস্টার ইকরামুল হক স্যার বসে আছেন। তাকে ঘিরে ধরে আছি আমরা সবাই। উনি জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন দার্শনিক তত্ত্ব দিচ্ছেন। না বুঝে হঠাৎ​ প্রশ্ন করে বসলাম, স্যার জীবনের এই পথটা কীভাবে খুঁজে পাব? অপলক চেয়েছিলেন তিনি। তারপর বললেন—
আরে বাবা, পথে না নামলে তুমি পথ কীভাবে খুঁজে পাবে? পথের মাঝেই পথের সন্ধান খুঁজে পেতে হয়।
টিকটিক করা বাঁশির পুতুলের সেই জীবনে ঠিক এ রকমই ছিল শিক্ষক আর শিক্ষিকাদের দিক-নির্দেশনা, সামরিক ভাষায় যাকে বলে মোটিভেশন। রংপুর ক্যাডেট কলেজের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এমনি টুকরো টুকরো কত লক্ষ নিযুত স্মৃতি যে মনে পড়ে যায়! স্নেহ ধন্য কৈশোর!
শুধুই কী শিক্ষক-শিক্ষিকা? অন্যান্য কর্মকর্তা, কর্মচারী? সবাই মিলে সেটা ছিল একটা পরিবারের মতন। কত নাম যে ভুলে গেছি তার ঠিক নেই। স্মৃতির পাতায় ধুলো জমবেই, সময় বলে কথা। নাম ভুলে যাওয়া সেই যে কুক (সম্ভবত গফুর) ভাই, যিনি আমাদের জন্য রান্না করতেন। পাঁচবেলা যার রান্না খেয়ে সেই কৈশোর কেটেছে, তার খবর রাখতে পারিনি। সেই যে হাউস বেয়ারা আলতাফ ভাই, ফজলু ভাই, কিংবা মফিজ ভাই, তাদের খবরও রাখতে পারিনি। কিংবা মেস ওয়েটার আয়তাল ভাই, বাচ্চু ভাই? ইলেকট্রিশিয়ান নাজিম ভাই, অথবা পেইন্টার দুলাল ভাই; যার তুলির ছোঁয়ায় ঝলমল করে উঠত কলেজটা। কত জনার নাম যে মনে পড়ছে। অথচ আজ আমি সারা দুনিয়ার খবর রেখে বেড়াই!
ঘাগট পাড়ের পূবাকাশে আজও সূর্যোদয় হয়। একই সেই বাগানে জায়গা করে নেওয়া নতুন কুঁড়িগুলোকে রোদ মাখায়, ফুটতে সাহায্য করে। তারপর পশ্চিম পাড়ের দিগন্তে, ঠিক বিলের শেষ প্রান্তে, আর কে রোডের মাথায়; আস্তে করে ডুব দেয়। হয়তো বা রাতের আকাশে এখনো কয়েকটা তারা চুপচাপ খসে পড়ে, আর রেলিঙে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো এক কৈশোর থেকে একটা দিন হারিয়ে যায়।
(ক্যাডেট আনোয়ার হোসেন ত/৬৪৫, ১৪তম ইনটেক, ১৯৮৮-১৯৯৪, রংপুর ক্যাডেট কলেজ)