কানাডায় টয়লেট টিস্যু পর্যন্ত নেই, এরপরও...
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে তরুণী। মনে হচ্ছে এশীয়। মুখে মাস্ক, চোখে রাজ্যের উৎকণ্ঠা। সামাজিক দূরত্ব বা সোশ্যাল ডিসট্যান্সের কোনো তোয়াক্কা না করেই মেয়েটা তড়িঘড়ি দাঁড়ানোর চেষ্টা করল লাইনে। টরন্টোর স্কারবরো এলাকার কস্টকো নামক পাইকারি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের গুদামের সামনের লাইনটা দীর্ঘতর হলো। এতক্ষণ যেসব মানুষ নির্ভার দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের চোখ খানিকটা সংকুচিত হলো কি? মেয়েটা অবশ্য সেসবের তোয়াক্কা করল না। চুপচাপ মিশে গেল অপেক্ষমাণ ক্রেতাদের সারিতে।
খানিক সামনে অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছিল আরেকজন শ্বেতাঙ্গ। পাশে কিউ নিয়ন্ত্রণ করতে দাঁড়ানো কস্টকো কর্মীকে শেষমেশ সে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, ‘ভেতরে টয়লেট টিস্যু পাওয়া যাবে তো?’ জবাবে কস্টকো কর্মী অসহায় একটা ভঙ্গি করল। ‘আসলে আমি শিওর না। সম্ভাবনা খুব কম।’
টয়লেট টিস্যু আলাপ শুনেই সচকিত হয়ে গেল আশপাশের কয়েকজন। শুনেছি, যেখানেই যাক, বাঙালির লোটা-বদনা সম্বল। কানাডীয় নাগরিকদের কাছে দেখা যাচ্ছে, এই টয়লেট পেপারই বাঙালির লোটা-বদনা সমতুল্য। না হলে পৃথিবীতে এত কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস থাকতে এই করোনাভাইরাস সংকটে টয়লেট টিস্যুর জন্য এমন হাহাকার কেন? তাদের শহরে অন্য কোনো জরুরি জিনিসপত্রের আপাতসংকট হবে না, সেটা টরন্টোর নগর কর্তারা জানিয়েছেন আগেই। কিন্তু টিস্যু পেপার নিয়ে কেন এই কাড়াকাড়ি? কেন এই ‘প্যানিক শপিং’?
কস্টকোর এই বিশাল লাইনে আমার সঙ্গী সেদিন (১৭ মার্চ) ড. দেলোয়ার ফারুক। পেশায় শিক্ষক। দেলোয়ার ফারুক কানাডায় আছেন দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে। আমারই মতো, টরন্টোতে জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর দরকারি জিনিসপত্র কিনতে এসেছেন। তিনি নিশ্চিত করলেন, কানাডায় এই ধরনের অভাবনীয় টয়লেট টিস্যুসংকট কোনো দিন তিনি দেখেননি।
বেশ লম্বা লাইন পেরিয়ে, ভেজা টিস্যু পেপারে হাত মুছে সাফসুতরো হয়ে আমরা বিশাল গুদামে ঢোকার সুযোগ পেলাম। ঘটনা সত্যি। বাকি কোনো কিছুর অভাব নেই। কোনো কোনো পণ্যে ক্রয়সীমা আছে কিন্তু টয়লেট টিস্যু জিনিসটা একদমই লাপাত্তা। পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম, কেবল কস্টকো নয়, ওয়ালমার্ট, মেট্রো বা ফ্রেশকোর মতো সব বড় সুপারমার্কেট তো বটেই, এমনকি অনলাইন স্টোর থেকেও যাবতীয় টয়লেট টিস্যু হাওয়া।
কদিন আগেই টরন্টোয় জরুরি পরিস্থিতি জারি করা হয়েছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী–পত্নী সোফি ট্রুডোর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা দিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছিল কানাডা। এই নিয়ে কিছু কানাডীয়কে দেখেছি সামাজিক মাধ্যমে ট্রুডোকে নিয়ে নির্মম রসিকতা করতে। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডো সহজে হার মানার পাত্র নন। কানাডার ভেতরের বাইরের অভিবাসী এবং অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের কাছে ট্রুডো যে একজন সত্যিকার নায়ক, সেটা দেখছি। নিজের ঘরের সমস্যা সামলে ট্রুডো ঠিকই আবার হাজির হয়েছেন নায়করূপে। করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় তাঁর সরকারের কাজের অগ্রগতি নিয়ে নিয়মিত হাজির হচ্ছেন সাংবাদিকদের সামনে।
অনেক রাষ্ট্রনায়ক যখন দ্বিধায়, ট্রুডোই কালবিলম্ব না করে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁর দেশের মানুষকে এই কঠিন সময়ে আর যা–ই হোক, বাড়িভাড়া, খাদ্য জোগান নিয়ে ভাবতে হবে না। বিদেশে অবস্থানরত কানাডার নাগরিক আর স্থায়ী বাসিন্দাদের উদ্দেশে ট্রুডো বলেন, ‘এখন ঘরে ফিরে আসার সময়।’
ভিনদেশে আটকে পড়া কারও যদি ফেরার ভাড়া না থাকে, তাঁকে দেওয়া হবে দরকারি অর্থ সহায়তাও। কদিন পরই অবশ্য ট্রুডো মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি সংকট উত্তরণে প্রতিটি কানাডীয় নাগরিকের ঘরে থাকার গুরুত্বের কথাও।
স্বাভাবিকভাবেই ট্রুডোর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন টরন্টো নগরের মেয়র। কানাডার ব্যস্ততম এই শহরে সংকট মোকাবিলায় বাড়িওয়ালাদের মর্টগেজ প্রদান সাময়িক স্থগিতসহ নানা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ঘোষিত ৮০ বিলিয়ন ডলারে সহায়তা তহবিল কীভাবে শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেটে পৌঁছাবে, এ নিয়ে এখনো পুরোপুরি ফয়সালা হয়নি। এই লেখা লেখার দিনেও কেবল অন্টারিও রাজ্য করোনায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অর্ধশতর বেশি। দুই হাজার ছুঁইছুঁই গোটা দেশে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা। তবে আর যা–ই হোক, মনে হয় না সরকারের কার্যক্রম নিয়ে খুব বেশি সমালোচনা করার আছে কানাডার জনগণের। পাশের প্রভাবশালী প্রতিবেশী দেশের সরকার বাহাদুর যখন ‘মাথা গরম’ হিসেবে দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি পেয়েছেন, ট্রুডো যেন ঠিক তার উল্টো। গত নির্বাচন থেকে এই করোনা সংকটের কাল। সাংবাদিকদের নিষ্ঠুরতম প্রশ্নের সামনেও ট্রুডোকে দেখছি অবিচল। আর যা–ই হোক, মেজাজ হারানোর মানুষ তিনি নন। সংকটের সময়ে তাঁর মতো উদার, ঠান্ডা মাথার, ভরসাযোগ্য মানুষকেই সম্ভবত নেতা হিসেবে দেখতে চায় আমজনতা।