কানাডার ঐতিহ্যিক শহর গিমলির পথে
উচ্চতর পড়াশোনার জন্য বাংলাদেশ ছেড়ে কানাডায় আসতে হয়েছে। দেশটিতে আসার মাস দুয়েকের মাথায় ঋতুর পরিবর্তন। প্রকৃতিতে এল আলো ঝলমলে গ্রীষ্ম।
আমার ভাগ্য বেশ প্রসন্নই বলা চলে, জুন মাসের মাঝামাঝি বেশ উষ্ণ হয়ে উঠেছিল চারপাশ, কিছুটা চৈত্র মাসের গরমের মতো। শীতের রুক্ষতার শেষে প্রকৃতি যেন চারদিক উজাড় করে তার সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে। চারদিকে অদ্ভুত সুন্দর সবুজ পাতা, রঙিন ফুল আর নীল আকাশের সৌন্দর্যে রীতমতো চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এরই মধ্যে আমাদের স্টুডেন্ট হাউজিংয়ের সবাই মিলে ঘুরে এলাম লেক উইনিপেগের তীরে ছোট্ট শহর গিমলি থেকে।
উইনিপেগ শহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে লেক উইনিপেগের তীরে ছোট্ট শহর গিমলি। শহর থেকে বের হতেই দেখি দুপাশে মাঠের পর মাঠে সবুজ গমের খেত। কোথাও কোথাও আমাদের দেশের শর্ষের মতো ক্যানুলার খেত হলুদ হতে শুরু করেছে। মাইলের পর মাইল সূর্যমুখীর খেতে এখনো ফুল আসেনি। দুপাশেই চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের গন্তব্য গিমলিতে।
গিমলি শহরটির জন্ম হয়েছে আইসল্যান্ডিক অভিবাসীদের হাতে। তখন এটি ছিল একটি গ্রাম। আইসল্যান্ডে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ফলে অনেকে বাধ্য হয়ে চলে আসে কানাডাতে, তা–ও প্রায় ১৮৭৫ সালের দিকে। তাদের থেকে কিছু পরিবার এসে উপস্থিত হয় লেক উইনিপেগের তীরে। প্রথম প্রথম গিমলিকে নিউ আইসল্যান্ড নামেও লোকজন চিনত। ১৯৪৮ সালে গিমলিকে শহরের মর্যাদা দেওয়া হয়, যা ২০০৩ সালে মিউনিসিপালিটিতে পরিণত হয়।
হাজার দুয়ের মানুষের এই ছোট্ট শহর পরতে পরতে আইসল্যান্ডিক সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে। এখনো কৃষিকাজ আর লেক উইনিপেগে মাছ ধরাই গিমলির অধিবাসীদের প্রধান পেশা। শুনে অবাক লাগলেও এটাই সত্য। লেক উইনিপেগে মাছ ধরার জন্য বেশ কিছু ছোট–বড় জাহাজ আর ইঞ্জিনচালিত নৌকা গিমলির জেটিতে বাঁধা থাকে। এসব নৌকাতে বিশাল লেকে মাছ ধরতে যান গিমলির জেলেরা। পরে তা চলে যায় আমাদের শহর উইনিপেগসহ কানাডার ছোট–বড় আরও অনেক শহরে। লেক উইনিপেগ পৃথিবীর ১২তম বৃহত্তম লেক, প্রায় বাংলাদেশের ছয় ভাগের এক ভাগের সমান।
সাজানো গোছানো ছোট্ট গিমলি শহরের মাঝ দিয়ে কিছু দূর যেতেই পেয়ে গেলাম লেকের সীমানা। এর এক পাশে বেশ কিছু হোটেল, অন্য পাশে রেস্তোরাঁ। ছোট ছোট নুড়ি পাথরের পার প্রস্থে বড় না হলেও দৈর্ঘ্যে বেশ বড়। কিছু দূর এগিয়ে যেতেই বিশাল জেটি। লেকের পানিতে অনেকেই সাঁতার কাটছে, কেউবা জেট স্কি চালাছে। আমরাও নেমে গেলাম পানিতে দাপাদাপি করতে। পানি থেকে উঠে সবার যখন ক্ষিধেয় মাথা খারাপ অবস্থা তখনি জানলাম, গিমলির বিখ্যাত ফিস অ্যান্ড চিপসের কথা।
রেস্টুরেন্টের বাইরে বেশ বড় লাইন, অপেক্ষায় থাকতে হবে। ক্ষুধায় বেশ খারাপ অবস্থা সবার, তাই অন্য আরেক দিন মেনুতে রাখলাম ফিশ অ্যান্ড চিপস।
এখানে পূর্বপুরুষ আইসল্যান্ডিক ভাইকিংদের স্মরণে রয়েছে ভাইকিং পার্ক। সবাই মিলে সেখানেই গেলাম। দারুণ এক ভাইকিং যোদ্ধার ভাস্কর্য পার্কের মাঝে। চারদিকে কেমন একটা শান্তি–শান্তি আবহাওয়া এখানে। লেকের ঠিক পাশেই সারি সারি বাড়ি। দেখে বেশ অবাক লাগছিল, সকালে উঠেই এক কাপ চা হাতে নিয়ে লেকের মিষ্টি বাতাস উপভোগ করে এখানকার অধিবাসীরা।
আমরা পার্ক থেকে চলে গেলাম জেটির উদ্দেশে। গিমলিতে জেটির কাছেই ছোট্ট একটা পুরোনো লাইটহাউস আর জেটির রেলিং ধরে হেঁটে শেষ মাথায় গেলে সেখানে আরেকটি লাইটহাউস। জেটির কাছের পুরোনো লাইটহাউসে আর আলো জ্বলে না। বেশ অনেক বছর আগে এটি ভেঙে গেলে সেটিকে মেরামত করে জেটির পাশে রেখে দেওয়া হয়েছে। সন্ধ্যায় জেটি ধরে এগিয়ে দেখা মিলল দূরের দু–একটা জাহাজ। মাছ ধরে ফিরে আসছে গিমলির দিকে। শৌখিন মৎস্যশিকারিদের বেশ আনাগোনা এখানে। জেটির পাশে বসে ছিপ ফেলে বসে বাতাস খাচ্ছে। অনেকেই মাছও পাচ্ছে। একজনকে দেখলাম গিটার হাতে নিয়ে অচেনা সুরে গান গাচ্ছে। জীবনের বিভিন্ন রঙে যেন রঙিন চারপাশ।
উইনিপেগ শহরের বেশ কাছে হওয়াতে গিমলিতে নানান অনুষ্ঠানের অয়োজন হয়ে থাকে। যদিও এই বছর করোনার কারণে সেসব আয়োজন বন্ধ। এসব আয়োজনের মধ্যে গিমলি ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও গিমলি সেইলিং বা পাল তোলা নৌকার উৎসব অন্যতম। এ ছাড়া বার্ষিক আইসল্যান্ডিক ফেস্টিভ্যালের আয়োজন হয়ে থাকে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে। ওই সময় হাজারো মানুষের আগমনে মুখর হয়ে যায় গিমলি।
ফেস্টিভ্যালে মূলত আইসল্যান্ডিক খাবার, পোশাক, গয়না, নাটক, গান আর খেলাধুলার আয়োজন থাকে। আইসল্যান্ডের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে সবার কাছে উপস্থাপনা করাই এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
খুবই ছোট্ট একটি শহর গিমলি। তবে শহরে পথেঘাটে মিশে আছে পুরোনোর ছাপ। ঐতিহ্যিক সব নিদর্শন। শহরবাসীর জীবনযাপন ও আচার–আয়োজনেও ফেলে আসা পুরোনো সময় আর ঐতিহ্য–সংস্কৃতিকে ধরে রাখার প্রচেষ্টা। তাই গিমলিতে গেলে আপনি ফিরে যাবেন অতীতে। মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। আর আইসল্যান্ডিক সংস্কৃতিতে।
* লেখক: রাশেদুর রহমান, শিক্ষার্থী