কাতারে সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে বাংলাদেশ
২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলকে সামনে রেখে দেশের অবকাঠামোকে আধুনিকায়ন করার দিকেই কাতার সব শক্তি নিয়োগ করেছে। কিন্তু বিশ্বকাপ–পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে এখন থেকেই ভাবতেও শুরু করেছে কাতার সরকার। আমদানি ও জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতি থেকে সরে এসে বহুমুখী অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য কাতার জরুরি ভিত্তিতে ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল শেষ হওয়ার পর কাতারের নির্মাণ খাতে জনশক্তির চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাবে। তাই জনশক্তির নির্ভরশীল নয়—এমন সব হাইটেক শিল্পকারখানা নির্মিত হচ্ছে কাতারে। এ জন্য দক্ষ জনশক্তি আমদানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে থেকে চিকিৎসক, প্রকৌশলীসহ অন্যান্য দক্ষ জনশক্তি নিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ কাতার সরকার। বাংলাদেশ সফরের সময় কাতারের প্রতিমন্ত্রী সুলতান বিন সাদ আল-মুরাইখি এ কথা বলেছেন। গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশি প্রবাসী ও নেপালিদের মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর অঘোষিতভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য ভিসা বন্ধ ছিল। এতে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। তবে এখন সেই সিদ্ধান্ত থেকে কাতার সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ফলে বহুদিন পর কাতারে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তির ঢোকার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতীয়রাই কাতারের দক্ষ জনশক্তির বিভিন্ন খাতে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে প্রকৌশলী, আইটি বিশেষজ্ঞ, ব্যাংক, মানবসম্পদ ইত্যাদি প্রায় সবখানেই ভারতীদের দেখা যায়।
এদিকে শ তিনেক প্রকৌশলী, ডজন খানেক চিকিৎসক ছাড়া হাসপাতালে বাংলাদেশি কোনো নার্স নেই বললেই চলে। কাতারের জনশক্তি বাজারে প্রতিযোগিতা এখন তুঙ্গে। ভারতীয় নাগরিকেরা ভিসা ছাড়াই কাতারে প্রবেশ করতে পারেন। বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাঁদের অন অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে প্রচুর দক্ষ ভারতীয় নাগরিক কাতারের জনশক্তি বাজারে প্রবেশ করছে, যা বাংলাদেশি নাগরিকদের কাতারের দক্ষ জনশক্তির বাজারের ঢোকা দুরূহ করে দিচ্ছে।
একটা সময় ছিল যখন মধ্যপ্রাচ্য এবং আরব দেশগুলো থেকে সরকারি দল তাদের স্বাস্থ্য খাতে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে গিয়ে শত শত চিকিৎসক নিয়ে আসতেন। কিন্তু ইদানীং শিক্ষার মান এবং সনদপত্র নিয়ে সংশয় থাকার কারণে আগের মতো বাংলাদেশ থেকে কেউ সরাসরি চিকিৎসক নিয়োগ দিতে চায় না।
এ ছাড়া কাতারে কাজ করতে হলে চিকিৎসক ও নার্সদের একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আসতে হয়। প্রকৌশলীদের যেমন পরীক্ষা দিয়ে কাতার পৌরসভা এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন নিতে হয়, তেমনি চিকিৎসকদেরও কাতার কাউন্সিল ফর হেলথ কেয়ার প্র্যাক্টিশনারস (কিউসিএইচপি) থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এ জন্য প্রথমে দিতে হয় পরীক্ষা। পরীক্ষায় পাস করলে আন্তর্জাতিক সংস্থা ডাটা ফ্লোর মাধ্যমে সব সার্টিফিকেট এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করে জমা দিতে হয়। এরপর কিউসিএইচপি সব মূল্যায়ন করে তবেই নিবন্ধন দেয়। কেবল আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলো থেকে পাস করা চিকিৎসক ও নার্সদের পরীক্ষা দিতে হয় না।
কাতারের একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক জানালেন, ডাটা ফ্লো থেকে বাংলাদেশে তথ্য যাচাই–বাছাইয়ের জন্য অনুরোধ গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়মতো সত্য সরবরাহ করে না। অনেক সময় তাদের অবহেলার কারণে ছয় মাসেও ডাটা ফ্লো তথ্য পায় না। এ জন্য অনেক বাংলাদেশি নার্স ও চিকিৎসক প্রবাসে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ ভারত থেকে একজন আবেদনকারীর তথ্য এক সপ্তাহের মধ্যে ডাটা ফ্লো সংস্থার কাছে চলে আসে।
বাংলাদেশের শ্রম, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও কাতারের বাংলাদেশে দূতাবাসের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ বিরূপ পরিস্থিতির উন্নতি করা না গেলে কাতারে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কেবল আলোচনার টেবিলেই রয়ে যাবে। আশার কথা হলো বাংলাদেশে থেকে প্রথমবারের মতো শ খানেক নার্স আনার প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে বলে জানিয়েছে কাতারের বাংলাদেশ দূতাবাস।
করোনা ভাইরাস অবশেষে হানা দিয়েছে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের উপকূলে। এ পর্যন্ত কাতারে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত আটজন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। ইরানফেরত একজন কাতারি নাগরিকের মধ্যেই প্রথম করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের বিমানবন্দরের কাছে অরিক্স রোটানা হোটেলে রাখা হয়েছে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য কাতার সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন চীনের সঙ্গে কাতার এয়ারওয়েজ বিমান যোগাযোগ স্থগিত করেছে; মিসর থেকে কাতারে প্রবেশে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের বিশেষভাবে স্ক্যানিং করা হচ্ছে। কাতারের সরকারি ইন্ডিপেনডেন্ট স্কুলগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
তবে সুপার মার্কেটের তাকগুলো এখনো ভর্তি দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রসারের কারণে খাদ্যসামগ্রী আমদানি এখনো ব্যাহত হয়নি। ক্রেতাদের মধ্যেও প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী মজুত করার তেমন হুড়োহুড়ি চোখে পড়ছে না।
কাতারের ওপর প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর অবরোধ আরোপের পর আমদানি কমিয়ে এনে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে অনেক এগিয়ে গেছে কাতার। দুগ্ধজাত খাদ্যসামগ্রী, শাকসবজিসহ অনেক কিছুই এখন স্থানীয়ভাবে উৎপন্ন হচ্ছে। তাই করোনার কারণে আমদানি সাময়িকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও সুপার মার্কেটের তাকে তেমন প্রভাব পড়বে না বলেই মনে হচ্ছে।