২০২০ সালে অন্য রকম কাঁচির প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য দুজন নারী বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এ দুজন হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপন্তিয়েঁ ও মার্কিন বিজ্ঞানী জেনিফার অ্যান ডাউডনা। তাঁরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আশায় ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনুধাবনের জন্য কাজ করছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আবিষ্কার করে বসলেন এই বৈপ্লবিক জেনেটিক কাঁচি, যা দিয়ে বংশগতির বৈশিষ্ট্যের ধারক উপাদান থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কাঙ্ক্ষিত অংশ কেটে বাদ দেওয়া যাবে এবং ইচ্ছেমতো নতুন অংশ জুড়ে দেওয়া যাবে।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাঁচির ব্যবহার বহুমুখী। বহুকাল আগে থেকেই নরসুন্দরের হাত থেকে দরজির দোকান পর্যন্ত কাঁচির অবাধ বিচরণ। তা ছাড়া নবজাত শিশুটি মায়ের পেটের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে ভূমিষ্ঠ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার নাড়ি কাটা নিয়ে কাঁচির বাড়াবাড়ি কম নয়। এমন যন্ত্রটি কে আবিষ্কার করেছিল, জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও সঠিক জবাব মেলেনি। তবে জানা যায়, আজ থেকে ৩ হাজার ৫০০ বছর আগে যন্ত্রটির উদ্ভাবন করেছিল প্রাচীন মিসরীয়রা।
এ বছর, ২০২০ সালে অন্য রকম কাঁচির প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য দুজন নারী বিজ্ঞানী নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এ দুজন হলেন ফরাসি বিজ্ঞানী ইমানুয়েল শারপন্তিয়েঁ ও মার্কিন বিজ্ঞানী জেনিফার অ্যান ডাউডনা। তাঁরা নতুন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আশায় ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা অনুধাবনের জন্য কাজ করছিলেন। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে আবিষ্কার করে বসলেন এই বৈপ্লবিক জেনেটিক কাঁচি, যা দিয়ে বংশগতির বৈশিষ্ট্যের ধারক উপাদান থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কাঙ্ক্ষিত অংশ কেটে বাদ দেওয়া যাবে এবং ইচ্ছেমতো নতুন অংশ জুড়ে দেওয়া যাবে। জিন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন এ দুজন বিজ্ঞানী।
দুজনেই অপেক্ষাকৃত কম বয়সের। তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ইমানুয়েল শারপন্তিয়েঁ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬৮ সালের ১১ ডিসেম্বর। প্যারিসের পাস্তুর ইনস্টিটিউট থেকে পিএইচডি করেন। তাঁর বাবা পেশায় একজন মালি, মা হাসপাতালে চাকরি করেন। জেনিফার অ্যান ডাউডনার জন্ম ১৯৬৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। বাবা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, মা একটি কলেজে ইতিহাস পড়ান।
জিন প্রযুক্তির জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হাতিয়ার ‘জেনেটিক কাঁচি’ আবিষ্কার। তাঁরা ‘ক্রিসপার-ক্যাস নাইন’ (কাঁচি প্রযুক্তি) ব্যবহার করে অল্প সময়ে খুব সহজে জীবকোষের বংশগতির উপাদানে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছেন। এই বংশগতির উপাদানের আণবিক একক জিনকে অদল বদল করাকে বলা হয় জিনোম এডিটিং বা সম্পাদনা। জেনেটিক কাঁচি ব্যবহার করে গবেষকেরা কার্যত সব জীবের জিনোম সম্পাদনা করতে পারবেন এবং জীবে কাঙ্ক্ষিত গুণাবলির সমাবেশ ঘটিয়ে অতিমাত্রায় উন্নত জীবে পরিণত করতে পারবেন।
বিজ্ঞানীদের এমন একটি জাদুর কাঁচি প্রযুক্তির স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৫৩ সাল থেকে। সে বছর দুজন বিজ্ঞানী ওয়াটসন ও ক্রিক বংশগতির উপাদান ডিএনএ আবিষ্কার করেন। জীবের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য এই ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অর্থাৎ ডিএনএ-তেই উৎকীর্ণ থাকে জীবটি কেমন হবে, আচার, আচরণ, ক্রিয়াকলাপ, আকৃতি, গড়ন, আয়ুর ব্যাপ্তি—সব। এক কথায় ডিএনএ বলে দেয় জীবটির আসল পরিচয়। তাই ডিএনএ আবিষ্কারের পরপরই বিজ্ঞানীদের মাথায় একটি ভাবনা পেয়ে বসে, তা হলো কীভাবে এর কাঠামো পরিবর্তন করে কাঙ্ক্ষিত গুণাবলির জীব উদ্ভাবন করা যায়। বিজ্ঞানীরা তা করতে গিয়ে ভীষণ হিমশিম খাচ্ছিলেন। কারণ, আগে ডিএনএ–এর গঠনে পরিবর্তন ঘটানো অনেক জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং ভীষণ ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া ছিল।
কেমন কাঁচি, কী করে?
ব্যাপারটি বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ২০১২ সালে। সে বছর ক্রিসপার-ক্যাস নাইন প্রযুক্তি বা জেনেটিকের কাঁচি আবিষ্কারের পর প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীদের সামনে সম্ভাবনার এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়। কারণ, বংশগতির উপাদান ডিএনএ-এর আণবিক একক জিনকে কাটা কুটি করে ইচ্ছেমতো খুব সহজে, অল্প সময়ে এবং অবিশাস্য রকমের কম খরচে ডিএনএ-কে বদলে ফেলা যায়।
যেসব বিজ্ঞানী বংশগতির উপাদান নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা লক্ষ করেন যে ব্যাকটেরিয়ার বংশগতির উপাদানে অনেকগুলো অংশ আছে এবং এর মধ্যে অনেকগুলোর পুনরাবৃত্তি থাকে। ব্যাপারটি বিজ্ঞানীরা ঠিক বুঝতে পারছিলেন না যে কেন এটা ঘটছে। পরে এ ব্যাপারে তাঁরা আরও আগ্রহী হলেন এবং কেন এমন হচ্ছে, সে রহস্য ভেদ করেন।
যখন ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হয়, তখন জেনেটিক পরজীবী এই ভাইরাস ব্যাকটেরিয়ার কোষের মধ্যে তার নিজের বংশগতির উপাদান প্রবেশ করিয়ে দেয়। এ সময় ব্যাকটেরিয়া নিজ কোষের প্রতিরক্ষার জন্য বিশেষ পদ্ধতিতে ভাইরাসের বংশগতির উপাদান কেটে ফেলতে পারে। ফলে ভাইরাস তার বংশগতির উপাদান কাজে লাগাতে পারে না। পক্ষান্তরে ভাইরাসের বংশগতির উপাদান থেকে কিছুটা অংশ ব্যাকটেরিয়া নিজের বংশগতির উপাদানে সন্নিবেশ করে নেয়। এর ফলে পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত হলে আক্রমণকারী ভাইরাসকে সহজেই শনাক্ত করে এবং ত্বরিত প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে।
ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস থেকে নিজ বংশগতির উপাদানে যে অংশগুলো যোগ করে, তাকেই বলা হয় ‘ক্রিসপার’ (CRISPR)। এর পুরো নাম Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeat। এর কাজ হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া যখন ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এনজাইম (প্রোটিন) উৎপন্ন করে, যা ভাইরাসের বংশগতির উপাদানকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। সংক্রমণ প্রতিরোধের এটা একধরনের ভ্যাকসিন বা টিকার মতো। যেহেতু ব্যাকটেরিয়া ভাইরাসের বংশগতির উপাদান থেকে কিছুটা অংশ ব্যাকটেরিয়া নিজের বংশগতির উপাদানে সংযুক্ত করে, সেহেতু বংশপরম্পরায় এই টিকা ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরক্ষা দিয়ে যায়। আমরা মানুষেরা যেসব সাধারণ ভ্যাকসিন নিয়ে সংক্রামক রোগের মোকাবিলা করি, তা এমন পরবর্তী বংশধরদের জন্য কার্যকর থাকে না।
এ প্রোটিনগুলোর একটি হচ্ছে ‘ক্যাস নাইন’। প্রোটিনের কাজ হলো আক্রমণকারী ভাইরাসের বংশগতির উপাদান কেটে খণ্ডিত করে ফেলা। বিজ্ঞানীরা অবাক বিস্ময়ে তা লক্ষ করলেন। সেখান থেকে দীক্ষা নিয়ে জিনোম এডিটিংয়ের কাজে লেগে পড়লেন। এই প্রোটিনের সঙ্গে একটি গাইড আরএনএ জুড়ে দিলেন। এই গাইড পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে সঠিক, আরাধ্য অংশটুকু কেটে দিতে পারবে।
জিনোম সম্পাদনা: ব্যবহার এবং অপব্যবহার
জিনোম সম্পাদনা করতে গিয়ে এর আগেও বিজ্ঞানীরা আরও দুটি উপায় বের করেছিলেন। তবে সে দুটি পদ্ধতি ছাপিয়ে বিজ্ঞানীরা প্রচণ্ড আশাবাদী হচ্ছেন এমন ক্রিসপার-ক্যাস নাইন প্রযুক্তির ব্যবহারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাঁরা এখন খুব সহজেই ফলপ্রসূভাবে জিন এডিটিং করে জিনোমের ভেতরে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারবেন। ফলে ক্যানসারসহ বহু দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা অনেক সহজ হয়ে যাবে। রোগপ্রতিরোধী এবং অজৈব ঘাত সহনশীল, যেমন লবণাক্ততা, বন্যা, খরা, শৈত্যপ্রবাহ ইত্যাদি সহনশীল, সেই সঙ্গে অধিক ফলনশীল উন্নত ফসলের উদ্ভিদ উদ্ভাবন সহজ হবে। অনেক নতুন ওষুধ আবিষ্কৃত হবে। অর্থাৎ এক কথায় এর বহুমুখী ব্যবহার মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। আর সে জন্যই একে বলা হয়েছে ‘জৈবপ্রযুক্তিতে শতাব্দীর সবচেয়ে সেরা আবিষ্কার’।
ইতিমধ্যে চীন এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের ভ্রূণের জিনোম সম্পাদনা করে মানুষকে অতিমানুষে পরিণত করার চেষ্টা করছে বলে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তাই অনেকে আবিষ্কারকে সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করছেন।
আর তাই এই আবিষ্কারের সুফল নিতে উঠেপড়ে লেগেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা। এ প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞানীরা বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণাগারে সব কাঙ্ক্ষিত গুণের জীব উদ্ভাবনে বিভিন্ন জীবের জিনোম ইচ্ছেমতো সাজিয়ে নিচ্ছেন। এদিকে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে চীন এক ধাপ এগিয়ে গেছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের ভ্রূণের জিনোম সম্পাদনা করে মানুষকে অতিমানুষে পরিণত করার চেষ্টা করছে বলে চীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। তাই অনেকে আবিষ্কারকে সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কারের সঙ্গে তুলনা করছেন। ডিনামাইট ব্যবহার করে পাহাড়ের বুক চিরে রাস্তাঘাট, বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি ডিনামাইট ব্যবহার করে বহু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া, জীবনহানির ন্যক্কারজনক নজিরও খুব একটা কম নেই।
‘ক্রিসপার-ক্যাস নাইন’ প্রযুক্তির যেমন ভালো দিক আছে, ঠিক তেমনি খারাপ দিকও আছে। কথা হলো, এমন অভূতপূর্ব আবিষ্কারকে কে কীভাবে কাজে লাগাবে, ভবিষ্যতে সেটাই হবে দেখার ব্যাপার। এমন আবিষ্কার ইতিবাচক গবেষণার হাতিয়ার হলে মানব সভ্যতা একটি আলাদা মাত্রা পাবে। আর যদি তা ‘অতিমানব’ তৈরিতে কাজে লাগানো হয়, তাহলে মানব সভ্যতা বিভক্ত হবে, অতিমানবেরা সাধারণ মানুষদের দাসে পরিণত করবে। ভয়টা সেখানেই।
তারপরও কথা থাকে, ঠিক ৩০ বছর আগে ইন্টারনেট যেমন করে বদলে দিয়েছিল পৃথিবী, ঠিক তেমনটিই ঘটতে যাচ্ছে। অসম্ভবকে সম্ভব করে পৃথিবী বদলে দেবে এই জেনেটিকের জাদুর কাঁচি।