করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে প্রবাসীর কিছু পরামর্শ
প্রাণঘাতী করোনা আজ সারা পৃথিবীকে গ্রাস করার দ্বারপ্রান্তে। এ পর্যন্ত প্রায় পুরো পৃথিবীতে এ মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে। আজ পর্যন্ত বিশ্বে ৪ লাখের বেশি মানুষ এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
সংক্রমণের হার তর তর করে প্রতি মুহূর্তে বেড়ে চলেছে, মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রাণহীন দেহ। করোনা-আক্রান্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া মহামারি (প্যানডেমিক) সংক্রমণকে ঠেকাতে এবং তাদের জনগণের প্রাণ বাঁচাতে সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। উন্নত অনেক দেশও এই মহামারি ঠেকাতে খুবই হিমশিম খাচ্ছে। এর বাস্তব উদাহরণ হিসেবে ইতালি, স্পেন, ইরান, জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এসব দেশের সংক্রামক রোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে গবেষণা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও চিকিৎসা ব্যবস্থা সবই আমাদের তুলনায় অনেক অনেক গুণ উন্নত ও সহজলভ্য মনে করা হয়। তবে শুরুতে ইরান ও ইতালি রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে তেমন গুরুত্ব আরোপ না করায় এবং সময়োপযোগী ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়, রোগটি মহারোষে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তাদের দেশে।
সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে একজন প্রবাসী বাংলাদেশি হিসেবে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ও দেশের জনগণকে করোনাভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকার জন্য কিছু পরামর্শ তুলে ধরতে চাই। আশা করি দেশের সম্মানিত জনসাধারণ, সামাজিক সংগঠন ও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রশাসন দেশবাসীর স্বার্থে এ পরামর্শগুলো বাস্তবায়নে আন্তরিক হবে।
১. পিপিই সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে
চীন, ইতালি ও ইরানে ইতিমধ্যে অনেক স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় সংক্রমিত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তাই আমার প্রথম আবেদন করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যাঁরা নিয়োজিত আছেন বা হবেন (চিকিৎসক, নার্স ও এ সেবার সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য জনবল) তাঁদের জন্য দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সরঞ্জাম (পিপিই) সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ভুললে চলবে না, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা আমাদেরই মতো মানুষ, তাঁদেরও সংসার, পরিবার-পরিজন আছে। আমাকে, আপনাকে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি তাঁদের নিজেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাদের আমরা বিনা অস্ত্রে রণক্ষেত্রে পাঠাতে পারি না। সেটা হবে অমানবিক এবং জুলুম। তাই উপযুক্ত সেবা পেতে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সজ্জিত করুন।
২. বাংলাদেশে যাওয়া প্রবাসীদের প্রতি আবেদন
আপনাদের নিজের, প্রাণপ্রিয় পরিবার, স্বজন ও দেশবাসীর জীবন রক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে এই মহামারি ঠেকাতে সরকার প্রণীত সব নিয়মকানুন ও স্বাস্থ্যবিধি বিনা অজুহাতে মেনে চলুন। আমিও একজন প্রবাসী, আমার পরিবার, আত্মীয়স্বজন এবং অতি আদরের নিষ্পাপ ছোট্ট একটা নাতিকে দেশে রেখে এসেছি, অনেক দিন দেখা হয়নি। তাদের জন্য মন-প্রাণ কাঁদে। এই মহামারি কেটে যাওয়া পর্যন্ত আমার আয়ু আছে কি না, পরিবারের সঙ্গে ভবিষ্যতে আর দেখা হবে কি না, সবই এখন অনিশ্চিত। বর্তমানে দেশে যাওয়ার ছুটি হাতে পেয়েও যাত্রাপথের নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা ব্যবহার করতে পারছি না। আমরা জানি, নিঃসন্দেহে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে আমাদের অবদান দেশবাসী এবং সরকার কর্তৃক স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তবে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর আজকাল সামাজিক ও কিছু কিছু গণমাধ্যমে প্রবাসীদের দেশে প্রত্যাবর্তনকে কেন্দ্র করে কিছু লোক নানা রকম অপ্রীতিকর মন্তব্য করছেন। বলতে হয়, আমাদের জন্য অতিশয় মর্মবেদনাদায়ক। দেশ ও দশের স্বার্থে ওই সব অনভিপ্রেত আলোচনা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে এখন প্রবাসীদের এগোতে হবে। দুঃখের বিষয়, এ মাসে দুই লাখের বেশি প্রবাসী দেশে ফিরে কোয়ারেন্টিনে থাকার কথা। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশকেই নাকি পুলিশ বাড়িতে খুঁজে পাচ্ছে না। অন্য কথায়, তাঁরা হয়তো গা ঢাকা দিয়েছেন। বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, কেন এ লুকোচুরি? এতে যে বিপদ অনেক বেড়ে যাবে, তা কি ওই ব্যক্তিরা বুঝতে পারছেন না? যেহেতু আমরা বিশ্বের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে দেশে ফিরেছি এবং যাত্রার সময় পর্যন্ত নিশ্চিত নই নিজে আক্রান্ত কি না, তাই দেশের মাটিতে বিমান থেকে অবতরণের মুহূর্ত থেকেই সরকারের সব স্বাস্থ্যবিধি/পরামর্শ অক্ষরে অক্ষরে পালন করুন। নির্ধারিত সময়ের জন্য সঙ্গরোধে (কোয়ারেন্টিনে) থাকুন। একজন থেকে অন্যজনের দূরত্ব ২ মিটারে রেখে সামাজিক দূরত্বায়ন মেনে চলুন। সংক্রমিত প্রমাণিত হলে স্বেচ্ছায় নির্জনবাসে (আইসোলেশনে) থাকুন। এগুলো বাধ্যতামূলক, কেউ না বললেও সবার বাঁচার তাগিদে তা পালন করুন।
৩. সরকার ও তার প্রশাসনের প্রতি আকুল আবেদন
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, দেশবাসীকে মহামারির নিষ্ঠুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করছে বা করেছে। এ দুর্যোগের সময় নিজ দেশের মানুষকে আগে মহামারি থেকে বাঁচান তারপর অন্যদের জন্য তহবিল গঠনে অংশ নিন। প্রাণঘাতী মহামারি আমাদের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত, একে প্রতিরোধের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনার গতি বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে করি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নিপুণতা ও মোকাবিলার দক্ষতার জন্য বিশ্বে বাংলাদেশের সুনাম রয়েছে। মহামারি করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে দেশের অতীত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান। এই ধরনের মহামারি নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে যাঁরা অভিজ্ঞ, তাঁদের খুঁজে বের করুন। সময়টি জাতীয় ঐক্যের সময়, আমাদের সবার বাঁচা-মরার প্রশ্ন। আপনাদের ওপর জনগণের প্রাণ বাঁচাতে অর্পিত দায়িত্ব পালনে মোটেও কেউ অবহেলা করবেন না।
৪. দেশের আপামর জনতার প্রতি আবেদন
আপনারা আমাদের শরীরে রক্ত চলাচলের ধমনির মতোই অতি গুরুত্বপূর্ণ অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা বিদেশে যাঁরা আছি, তাঁরা আপনাদেরই কারও না কারও আপনজন। আপনারা যেমন নিজ জীবনকে ভালোবাসেন, সুস্বাস্থ্যে দীর্ঘায়ু কামনা করেন, আমাদের বেলাতেও তা চরম সত্য। করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ায় আজ পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে গেছে। আমাদের দেশ সে আতঙ্কের বাইরে নয়। যেসব প্রবাসীর মাধ্যমে রোগটি দেশে প্রবেশ করেছে, তাঁরা নিশ্চয়ই জেনেশুনে বা ইচ্ছা করে আক্রান্ত হননি বা অন্যকে সংক্রামিত করেননি। কারও ক্ষেত্রে নিজের অজান্তে যাত্রা পথে সংক্রমিত হয়ে তা দেশে প্রবেশের পর প্রকাশ ঘটেছে বা যাত্রা শুরুর দেশেই সংক্রমিত হয়েছে। এমন অবস্থায় পরিবারের যে লোকটি সারা জীবন ধরে তাঁর কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে পরিবারকে স্বাবলম্বী করে তুলতে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁকে তো দেহে প্রাণ থাকা অবস্থায় কবর দেওয়া যায় না। তাই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পর্কে বিলম্ব না করে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করুন। তারা প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেবেন বা নেবেন। রোগটি যেহেতু অতিমাত্রায় সংক্রমণপ্রবণ, তাই নিজের আপনজন হলেও খালি হাতে সেবা করতে বা সৎকার করতে যাবেন না। আমরা সবাই জানি, এই সৃষ্টিতে জন্ম-মৃত্যু এক অলঙ্ঘনীয় প্রক্রিয়া। তাই কারও বেলায় এ ঘটনা ঘটলে হৃদয়ে যত কষ্টই হোক না কেন, একে মেনে নিতেই হবে অন্যদের বেঁচে থাকার তাগিদে। এই মুহূর্তে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কোভিড-১৯-এর মৃত্যুথাবা থেকে উদ্ধার করতে পারে আমার-আপনার প্রিয়জনকে।
৫. শেষ কথা
আশার কথা, করোনাভাইরাসে এখনো মৃত্যুর হার নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া অন্যান্য মহামারির তুলনায় অনেক কম রয়েছে এবং ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, উপযুক্ত সতর্কতা পালনে এ রোগের সংক্রমণ থেকে নিজেকে এবং অন্যদের নিরাপদ রাখা সম্ভব। তাই আতঙ্কিত না হয়ে মনে শক্তি সঞ্চয় করুন। তাতে এ রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা কমে যাবে। এই মুহূর্তে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সতর্কতার সঙ্গে জনসমাগম এড়িয়ে চলা, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সপরিবারে ঘরে অবস্থান করাই এই ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার বিশেষজ্ঞগণের মূল্যবান উপদেশ। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন, রক্ষা করুন করোনাভাইরাসের আপদ থেকে, এই কামনাই করি।