করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন এবং নতুন গবেষণা
করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির বিষয়ে অনেক অগ্রগতি হচ্ছে। সম্প্রতি চায়নিজ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি গবেষণাগার এবং বায়োটেক কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে একটি নিষ্ক্রিয় সারস কোভি-২ ভাইরাস তৈরি হয়েছে। এর মাধ্যমে নতুন একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। গবেষণাটি এই সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে বিজ্ঞানের বিশ্বখ্যাত জার্নাল সায়েন্স-এ। সাধারণত ভ্যাকসিনগুলো তৈরি হয় দুর্বল এবং নিষ্ক্রিয় ভাইরাস দিয়ে। এভাবে তৈরি ভ্যাকসিনগুলো অন্যান্য পদ্ধতির ভ্যাকসিনের চেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর। ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং পোলিও ভাইরাসের ভ্যাকসিন এই ধরনের নিষ্ক্রিয় ভাইরাস দিয়ে তৈরি হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন তৈরির ফর্মুলা এখন ব্যবহার করা হচ্ছে। ভ্যাকসিন বিষয়ে গবেষণাগুলো বোঝার জন্য করোনাভাইরাসটির আকার সম্পর্কে আবারও বলতে হবে। করোনাভাইরাসের আকার নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। সংক্ষেপে আবারও বলছি। এটা একটি আরএনএ ভাইরাস। এর জীবনের মূল এই আরএনএ বস্তুটি ছাড়া আকৃতি ঠিক রাখার জন্য আরও চারটি প্রোটিন রয়েছে। এদের টেকনিক্যাল নাম হচ্ছে স্পাইক প্রোটিন, এনভেলপ প্রোটিন, মেমব্রেন প্রোটিন এবং নিউক্লিওকেপ্সিড প্রোটিন। আকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন আরও ১৬টি প্রোটিন রয়েছে এই ভাইরাসে। এ ছাড়া আরও ৪টি অতিরিক্ত প্রোটিন আছে। এদের মধ্যে স্পাইক প্রোটিনটির বিরুদ্ধে মানব শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে। এর আগে সহজভাবে এই বিষয়ে লিখেছি, লিঙ্কটি দিলাম। ‘করোনার ভ্যাকসিন এবং বর্তমান গবেষণা নিয়ে কথা’ ।
করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনটির গুরুত্ব সম্পর্কে এখন সবাই জানে। এই স্পাইক প্রোটিন এবং ফুসফুসের কোষের একটি প্রোটিন এসিই-২র সংযোগের মাধ্যমে ভাইরাসটি তার জেনেটিক বস্তু আরএনএ মানব শরীরে প্রবেশ করায়। ভাইরাসের এই আরএনএর বিন্যাস ব্যবহার করে মডারনা নামে একটি কোম্পানি নতুন ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। এটার মানুষের শরীরের ওপর বড় আকারের পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ আজকে (৭ মে) অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, এডেনো ভাইরাস, যা শিম্পাঞ্জির শরীরে ফ্লু তৈরি করে তা দিয়ে ভ্যাকসিন বানাচ্ছে। এরা এই এডেনো ভাইরাসটির জিনে স্পাইক প্রোটিনের জিনটি যুক্ত করে দিয়েছে। এই পরিবর্তিত ভাইরাসটি মানব শরীরে প্রবেশ করালে এটা স্পাইক প্রোটিনের বিরুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে বলে জানা যাচ্ছে। মানব শরীরে এখন নিবিড় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এর কার্যকারিতা। শুনেছি, অচিরেই হয়তো এই ভ্যাকসিন বাজারে চলে আসতে পারে। ভ্যাকসিন তৈরির এই দৌড়ে আছে জনসন অ্যান্ড জনসন, ফাইজার, সানফি এবং পৃথিবীজুড়ে আরও অনেক কোম্পানি। তারপরও একধরনের অনিশ্চয়তা এখনো রয়েছে এই ভ্যাকসিনগুলো নিয়ে। এত চেষ্টার পরও ইবোলা, এইচআইভি এবং ডেঙ্গুর এখনো তেমন কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন নেই।
চীনের এই গবেষকেরা এই নতুন ভ্যাকসিনের নাম দিয়েছে পিকোভেক (PiCoVacc)। এটা তৈরি করার জন্য করোনায় আক্রান্ত ১১ জন রোগীর ফুসফুসের নিম্ন কক্ষের একটি বিশেষ জায়গা থেকে তরল পদার্থ সংগ্রহ করা হয়। এঁদের মধ্যে তিনজন ইনটেনসিভ কেয়ারে ছিলেন। রোগীদের মধ্যে ৫ জন চীনের, ৩ জন ইতালির, ১ জন সুইজারল্যান্ডের, ১ জন ব্রিটেনের এবং শেষের জন স্পেনের। এই স্যাম্পলগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে নেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে ভাইরাসটির বিবর্তন কতটুকু হয়েছে তা জানা। অবশেষে, এই ১১টি ভাইরাসের স্যাম্পল থেকে এই ভ্যাকসিন তৈরি করার জন্য এরা চীনের একটি রোগীর ভাইরাসকে ব্যবহার করেছে। ভাইরাস তৈরির ক্ষেত্রে একটি প্রধান সমস্যা হবে যদি স্পাইক প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়। এর ফলে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, তা করোনা রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে না। এ জন্য এরা সময় নিয়ে ধাপে ধাপে ভাইরাসটিকে একধরনের কিডনি কোষের মধ্যে কালচার করেছে। একটি সুনির্দিষ্ট সময় পরে জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে ভাইরাসের আকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কিছু প্রোটিনের অ্যামিনো অ্যাসিডগুলোর মধ্যে অল্প পরিবর্তন হয়েছে। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, স্পাইক প্রোটিনের মধ্যে কোনো পরিবর্তন পাওয়া যায়নি। কৃত্রিম পরিবেশে স্পাইক প্রোটিনটির জিনগত বৈশিষ্ট্য টিকে থাকার তথ্য পাওয়ার পর এই গবেষকেরা একধরনের কেমিক্যাল দিয়ে এই ভাইরাসের জিনোমকে (আরএনএ) পরিবর্তন করে দেয়। এরপর এর আকৃতিটি আবার পরীক্ষা করার পর দেখা গেল, ভাইরাসটির আকৃতি ঠিক রয়েছে এবং এর স্পাইক প্রোটিনগুলো মূল ভাইরাসের মতোই বাইরে করোনার মতো বিন্যস্ত হয়ে আছে। এভাবে তৈরি হয়ে গেল একটা নিষ্ক্রিয় ভাইরাস, কিন্তু স্পাইক প্রোটিনের মাধ্যমে এটা শরীরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারবে এবং শরীর এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। ফলে পরবর্তী সময়ে করোনায় আক্রান্ত হলে এই অ্যান্টিবডির মাধ্যমে মানব শরীরের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভাইরাসটিকে মেরে ফেলতে পারবে।
এটা সত্যিই কাজ করে কি না, জানার জন্য গবেষকেরা নিষ্ক্রিয় করোনাভাইরাসটি পরীক্ষা করেছেন ছোট ইঁদুর থেকে শুরু করে, বড় ইঁদুর এবং একধরনের বানরের ওপর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই নিষ্ক্রিয় ভাইরাস সফলভাবে অ্যান্টিবডি তৈরি করেছে। এ ছাড়া বানরের ক্ষেত্রে সরাসরি বানরের ফুসফুসে করোনাভাইরাস দেওয়ার পরও এদের করোনার কোনো তাৎপর্যপূর্ণ সংক্রমণ হয়নি। এ ছাড়া পিকোভেক সারা পৃথিবীর সারস কোভি-২–এর অন্যান্য স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর বলে পরীক্ষায় দেখা গেছে। ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আছে, সেটাকে টেকনিক্যালি বলে অ্যান্টিবডি ডিপেনডেন্ট এনহেন্সমেন্ট আর সংক্ষেপে বলে ‘এডিই’। ডেঙ্গু এবং এইচআইভির ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে এই সমস্যা প্রকট। শরীর একবার সংক্রমিত হওয়ার পর যদি ভাইরাসের অন্য কোনো টাইপ দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন এই অ্যান্টিবডিই ভাইরাসের সংক্রমণ আরও বাড়িয়ে দেয়। এই ডিটেইলটা পাওয়া যাবে প্রথম আলোতে ডেঙ্গু ভাইরাসের ভ্যাকসিন নিয়ে আমার একটি পূর্ববর্তী লেখায়, লিঙ্কটি দিলাম ডেঙ্গু ভাইরাসের ভ্যাকসিন ও বর্তমান গবেষণা । আশার কথা হচ্ছে, বানরের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনটা দেওয়ার পর আবার করোনার সংক্রমণের ফলে এই ‘এডিই’ সমস্যাটি দেখা যায়নি। এই ভ্যাকসিন এখন মানব শরীরে পর্যবেক্ষণের জন্য ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে এই নতুন ভ্যাকসিন পিকোভেক অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে। বিজ্ঞান সব সময় ডেটানির্ভর, ভবিষ্যতে আরও গবেষণা আমাদের জানিয়ে দেবে এর পুরোপুরি দক্ষতা।
বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এবং ভ্যাকসিনের মাধ্যমে ভাইরাল বিশেষজ্ঞরা করোনার ওপর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যৎই বলতে পারবে, এই যুদ্ধে আমরা কতটুকু জয়ী হব। এই মহামারি একসময় শেষ হবে, রেখে যাবে তার ধ্বংসাবশেষ। প্রকৃতির নিয়মে ১০০ বছর পর হয়তো আরেকটি মহামারি আসবে। করোনার কারণে ভবিষ্যতে একটি নতুন মানসিকতার পৃথিবী আবির্ভূত হবে? আমি জানি না। কিন্তু মহাকালের নিয়মে আমরা আবারও ভুলে যাব এবং একই বৃত্তে বারবার ঘুরপাক খাব।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, রসায়ন এবং প্রাণরসায়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস।
তথ্যসূত্র:
https: //science. sciencemag. org/content/early/2020/05/05/science. abc1932? utm_campaign=SciMag&utm_source=JHubbard&utm_medium=Facebook
https: //abcnews. go. com/Health/inside-oxford-trial-leading-race-coronavirus-vaccine/story? id=70517788
https: //www. nytimes. com/2020/05/07/health/coronavirus-vaccine-moderna. html