করোনাভাইরাস ও মানসিক ভারসাম্য

ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস যেমন একদিকে নিকট লোকজন, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, তেমনি আবার দূরের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনকে কাছে নিয়ে এসেছে। কিন্তু যেটা কেড়ে নিয়েছে, সেটা হলো মানুষের সামনাসামনি হওয়ার সুযোগ ও স্বতঃস্ফূর্ততা।

পাড়াপ্রতিবেশীদের সঙ্গে দরজার ফাঁক দিয়ে, দূরত্ব বজায় রেখে সংক্ষিপ্ত আলাপেই কাজ শেষ করতে হচ্ছে। যারা আসে, তারাও বুঝতে পারে, আর যেহেতু ব্যাপারটা কিছুটা অস্বস্তিকর, তাই যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আলোচনা কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে শেষ করতে হয়। কুশল বিনিময়ও সম্ভব হয় না। কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয় পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু–বান্ধবদের সঙ্গে।

করোনাকালের জীবন
ছবি: প্রতীকী

স্কুল–কলেজ বন্ধ থাকায় পারিবারিক নৈকট্য যেমন একটা চাপ তৈরি করে, তেমনি দূরত্ব একটা একাকিত্ব ও অসহায়ত্বের জন্ম দেয়। স্কুল–কলেজের ছাত্র–ছাত্রীদের দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্ধুহীনতা মানসিক ভারসাম্য বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। একাকিত্ব, প্রয়োজনে নিকট আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধবকে নিকটে না পাওয়ার মানসিক যন্ত্রণা, মৃত্যুপথযাত্রীদের শেষ সময়েও হাতে হাত ধরে বিদায় না জানানোর বেদনা, ছেলেমেয়েদের দিনের পর দিন নিয়ন্ত্রিত জীবন অতিবাহিত করা, কৈশোরের উৎসাহ ও আবেগকে টুঁটি চেপে বন্ধ রেখে ঘরে বসে থাকা—কোভিড-১৯ এসব বেদনাদায়ক যান্ত্রিকতার জন্ম দিচ্ছে।

তবে আজকাল কোভিড-১৯–এর প্রকোপ কমেছে বলা যেতে পারে। ফলে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কঠোরতাও কমেছে এবং মানুষের জীবিকার জন্য বিভিন্নভাবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাজকর্ম পরিচালনা করার উপায় বের হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানসিক চাপ যে খুব কমেছে, তা বলা যাবে না।

অনলাইন কাজের গতি ও পরিবেশকে একটা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছে।

স্বাভাবিকভাবেই যাঁরা কম্পিউটার নিয়ে কাজে বিশেষভাবে পারদর্শী নন, তাঁরা পিছিয়ে পড়ার ভয়ে কিছুটা অসহায়। কাজের মূল্যায়ন, কাজের জটিল পরিস্থিতিতে সামনাসামনি আলাপের মাধ্যমে সমাধান খোঁজার সুযোগ না পাওয়ায় জটিলতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মনের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ ছাড়া আগে যেখানে কাজ কাজের জায়গায় (অর্থাৎ অফিসে) থাকত, এখন সেসব কাজ চলে এসেছে বাসায়। প্রতিদিনই সকাল, দুপুর ও রাতে অনলাইন কলের আশঙ্কা দৈনন্দিনের গোছানো কাজের পরিস্থিতিকে অগোছালো করে দিচ্ছে। আগে যেমন একটা দিনের শেষে কাজ সম্পন্ন করার আনন্দ থাকত, সেটা এখন তেমন নেই, নেই সাপ্তাহিক ছুটিতে সবাই মিলে আড্ডা, দূরে কোথাও ড্রাইভে যাওয়া, অথবা কফি বারে বসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে হালকা আড্ডা।

জুমের বদৌলতে অবশ্য বেশ লং ডিসট্যান্স কথা হচ্ছে, চুটিয়ে আলাপও হচ্ছে এবং কিছুটা সাহায্যও হচ্ছে। তবে এসব যতই হোক না কেন, চাইলেই তো সবাই এসব ব্যবহার করতে পারে না, করার তেমন সুযোগও নেই। তাই নিজেকে সীমার মধ্যেই ধরে রাখতে হচ্ছে, নিজেকে গুটিয়ে নিতে হচ্ছে। স্বতঃস্ফূর্ততা পরিত্যাগ করে মুখে নেকাবের মতো মুখোশ পরে বাইরে যাওয়া, চেহারা না দেখেই কথা বলা—সবকিছুই একটা অসহনীয় অবাস্তব পরিবেশের জন্ম দিচ্ছে।

দেশ–বিদেশে কোভিডের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব বিশ্লেষিত হয়েছে এবং প্রচুর লেখাও হয়েছে। কিন্তু যেটা তেমন বিশ্লেষিত হয়নি, সেটা হলো মানুষের, বিশেষ করে কমবয়সী ছেলেমেয়েদের ওপর কোভিডের প্রভাব। এটা যে শুধু একটা সাময়িক পরিস্থিতি, তা নয়। যেকোনো মানসিক চাপের একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকে। করোনাভাইরাসের প্রথম দিকে এটা তেমন বিশ্লেষিত না হলেও এখন হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণায় এসবের ওপর বেশ কিছু তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

কোভিডের প্রভাবে মানসিক ব্যাধি

যারা আগে থেকেই হালকা মানসিক ব্যাধির শিকার, তাদের ওপর কোভিডের প্রভাবের তীব্রতা অনেক বেশি লক্ষণীয়। যারা একাকিত্বে ভোগে বা যাদের পরিবারের মধ্যে কেউ করোনাভাইরাসের শিকার হয়েছে, তাদেরও মানসিক চাপ থেকে মানসিক ভারসাম্যের শিকার হওয়ার প্রবণতা বেশি। এ ছাড়া আর্থিক অনটন, চাকরি হারানো, ভাড়া বাড়ি থেকে উৎখাত, ঘুমের স্বল্পতা, অসহায়ত্ব তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে বেশ বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এসব মানসিক চাপের প্রতিরোধক হিসেবে যারা মাদকদ্রব্য সেবনের আশ্রয় নেয় অথবা যারা দিনের পর দিন ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে, তাদের ওপর প্রভাবের প্রাথমিক তীব্রতা কমলেও তারা একটা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক প্রভাবের শিকার হতে পারে।

দুঃখ-কষ্ট, গ্লানি ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে পরস্পরকে সান্ত্বনা দেওয়া মানুষের নাগরিক আচরণ, ভয় ও বিধিবিধান পদদলিত হচ্ছে। কোভিড বাচ্চাদের একে অপরের সঙ্গে দেখা করার স্বাধীনতা ও সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। যাঁরা চিকিৎসা পেশায় আছেন, তাঁদের হঠাৎ দায়িত্বে ডেকে আনা হচ্ছে এবং কাজের চাপ তাঁদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপের সৃষ্টি করছে। তাঁরা দেখছেন, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছে। ভেন্টিলেটরের স্বল্পতার জন্য বয়স্ক, গুরুতর অসুস্থ রোগীদের কাছ থেকে ভেন্টিলেটর সরিয়ে কোভিডে আক্রান্ত কম বয়সী, যাদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশি, তাদের দেওয়া হচ্ছে। এসব কর্তব্য নিজেদের দায়িত্বে চিকিৎসক–সেবাকর্মীদের করতে হচ্ছে। এটা অনেকটা বয়স্ক রোগীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ারই শামিল।

কোভিডের খুব গুরুতর প্রভাবগুলোর মধ্যে বেশি আলোচিত হলো করোনার কারণে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা, জীবিকা অথবা তাঁদের আয়ের ওপর প্রভাব। এটা অনস্বীকার্য, মৃত্যু অথবা আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব—দুটিই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটাও অনস্বীকার্য, মানসিক চাপ, বিশেষ করে কমবয়সী ছেলেমেয়েদের ওপর এর নেতিবাচক মানসিক প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

বিচ্ছিন্নতা, আয় হ্রাস ও ভয় থেকে উদ্ভূত মানুষের ওপর কোভিডের মানসিক প্রভাব মূল্যায়ন করা বেশ কঠিন। এগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাকে ট্রিগার করছে অথবা বিদ্যমানগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। অনেক লোক অ্যালকোহল ও ড্রাগ ব্যবহার, অনিদ্রা ও উদ্বেগের বর্ধিত মাত্রার সম্মুখীন হচ্ছে। এ ছাড়া স্নায়বিক ও মানসিক জটিলতার প্রমাণ রয়েছে, যেমন প্রলাপ ও স্ট্রোক। পূর্ববিদ্যমান মানসিক, স্নায়বিক বা পদার্থ ব্যবহারের ব্যাধিযুক্ত ব্যক্তিরা কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
বিভিন্ন দেশে করোনার বিস্তার রোধে নেওয়া ব্যবস্থা, যেমন স্কুল বন্ধ ও সামাজিক দূরত্ব বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ শিশু ও তাদের পরিবারকে প্রভাবিত করেছে। শিশুদের সুস্থতার ওপর এ ধরনের পদক্ষেপের এই পরিণতিগুলো সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায় না।

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটনের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মরগুলের (এট আল) করা একটি সমীক্ষায় সেটি আঁচ করা যায়। ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী ৯২৭ শিশুর ওপর একটি সমীক্ষায় দেখা যায়, সবচেয়ে ঘন ঘন রিপোর্ট করা লক্ষণগুলো ছিল একঘেয়েমি (৭৩.৮ শতাংশ), একাকিত্ব ( ৬৪.৫ শতাংশ) ও হতাশা (৬১.৪ শতাংশ)। বিরক্তি, অস্থিরতা, রাগ, উদ্বেগ, দুঃখ, উদ্বেগ ও পরিবারের বাকি সদস্যদের সঙ্গে তর্ক করা প্রায় ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে রিপোর্ট করা হয়েছে।
শিশুরা শারীরিক ক্রিয়াকলাপ ও ঘুমাতে কম সময় ব্যয় করে এবং বেশি টেলিভিশন অথবা কম্পিউটারের পর্দায় আটকে থাকে। অর্ধেকের বেশি পরিচর্যাকারী লকডাউনের সময় মাঝারিভাবে বা গুরুতরভাবে যন্ত্রণাদায়ক বলে রিপোর্ট করেছেন এবং তত্ত্বাবধায়কের মানসিক সংকটের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে শিশুর লক্ষণগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।

করোনাকালের জীবনগাথা
ছবি: প্রতীকী

চীনের আরেকটি আন্তবিভাগীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারির নাটকীয় বিস্তার স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও চরম দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী উদ্বেগ, বিষণ্নতা, অনিদ্রা ও সামগ্রিক মানসিক সমস্যাগুলোর উপসর্গে ভুগছেন। চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান ও জনস্বাস্থ্য পেশাদারদের সামগ্রিক মানসিক সমস্যার প্রাদুর্ভাব ছিল ৬০.৩৫, ৬২.০২, ৫৭.৫৪ ও ৬২.৪০ শতাংশ। প্রথম সারির স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্বেগ, অনিদ্রা ও সামগ্রিক মানসিক সমস্যার ঝুঁকি অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
ভ্যালেন্সিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তাম্রিত ৫২৩ জন স্প্যানিশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে করোনা মহামারির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের ওপর একটি সমীক্ষা করেন। সেটা থেকে দেখা গেছে, কিশোরদের বয়ঃসন্ধিকালে কোভিডের আক্রমণ স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফলাফলগুলো ইঙ্গিত করে, সামাজিক-জনসংখ্যাগত ও কোভিড–সম্পর্কিত ভেরিয়েবলগুলো বর্তমান মহামারি চলাকালীন কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে মানসিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের ওপর এর প্রভাব বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া বয়ঃসন্ধিকালে যাঁরা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন এবং যাঁরা বেশি সময় বাড়িতে থাকেন, তাঁদের বিষণ্নতা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপের লক্ষণগুলো বেশি দেখা যায়।

ইরানের একটি গবেষণায় যথেষ্ট মানসিক সমস্যার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সাধারণ জনসংখ্যার ২৪১ জন অংশগ্রহণকারীর এই আন্তবিভাগীয় গবেষণায় কোভিড রোগীদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার উচ্চ প্রবণতা এবং তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর অক্ষমতাগুলোও বের হয়ে এসেছে।
করোনার বিরুদ্ধে মানুষের দ্রুত বিজয় বা এখন পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। এখনো আলোচনা ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ, সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কমানো এবং দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। বলা হচ্ছে, আমাদের করোনার সঙ্গে বাঁচতে শিখতে হবে, যেমনটি আমরা অতীতেও অন্যান্য ক্ষেত্রেও করেছি, যদিও সেসব সংক্রমণ কোভিডের মতো মারাত্মক ছিল না। কিন্তু তখন মানুষও বিজ্ঞান–প্রযুক্তিতে এখনকার মতো উন্নত ছিল না।
করোনার বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় পাওয়ার সম্ভাবনা কম। ভাইরাসটি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং আরও বেশি ভাইরাল হয়ে উঠতে পারে বলে এখনো ধারণা করা হচ্ছে। অনেকের বিশ্বাস, মানুষ শেষ পর্যন্ত ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণে আনবে। তবে করোনার বিরুদ্ধে মানুষের এ প্রয়াসটি অনেক দিন ধরে চালাতে হবে। এর প্রধান কারণ হলো তরুণ প্রজন্মের ওপর এই নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি। আমাদের সেটা মেনে নিয়েই চলতে হবে এবং কোভিডের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

*লেখক: ডক্টর আতিকুর রহমান একজন অর্থনীতিবিদ ও লেখক। ইতালির রোমে জাতিসংঘের সংস্থা ইফদের (আইএফএডি) সাবেক কর্মকর্তা