করোনাকালে জীবনবোধের সন্ধানে
করোনার তৃতীয় ধাক্কায় সিডনির জীবনযাপন পুরোপুরি বিপর্যস্ত। অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্য করোনার প্রথম ধাক্কা এবং দ্বিতীয় ধাক্কা খুবই ভালোভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ডেল্টা ভেরিয়েন্টের মোকাবিলায় এখন যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
সিডনিতে লকডাউনকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছে। যে সবার্বগুলোতে এখন পর্যন্ত সংক্রমণ দেখে দিয়েছিল, সেগুলোর সব কটিতেই লকডাউন চলেছে কিন্তু কিছু সবার্বকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে কমিউনিটি সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি। সেই সবার্বগুলো হচ্ছে ব্ল্যাকটাউন, ক্যাম্বেলটাউন, ক্যান্টারবুরি-ব্যাংকসটাউন, কাম্বারল্যান্ড, ফেয়ারফিল্ড, জর্জেস রিভার, লিভারপুল এবং পারামাটা। নাগরিকদের বাসায় থাকার জন্য প্রতিদিনই নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারসহ অন্যান্য দায়িত্বরত কর্মকর্তা অনুরোধ করে যাচ্ছেন। কোনো দরকারে বাসা থেকে বের হলেও বাসার কেন্দ্র থেকে ১০ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হচ্ছে কিন্তু উল্লিখিত সবার্বগুলোর জন্য পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে থাকতে বলা হয়েছিল।
বাসা থেকে কোনো দরকারে বের হলে একবারে কেবল একজনকে বের হতে বলা হয়েছিল। আর শরীরচর্চা বা বাজার করার জন্যও নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যেই থাকতে হয়েছিল। যেকোনো জনসমাগমের স্থানসহ জনপরিবহনে মাস্ক বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আর ওপরের আটটা সবার্বের জন্য ঘরের বাইরে বের হলেই মাস্ক একেবারে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়েছিল। মাস্ক না পরলে আগে জরিমানা ছিল দুই শ ডলার, সেটাকে বাড়িয়ে এখন পাঁচ শ ডলার করা হয়েছে।
এ ছাড়া সবাইকে করোনার টিকা নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে টিকা পেলে নিয়ে নেন; কারণ, টিকা নেওয়া মানুষের শরীরে সংক্রমণের হার অনেক কম। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন, যিনি প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছিলেন। অন্যরা কোনো টিকা নেননি। আগে বয়সের হিসাবে বয়স্কদের জন্য টিকা নির্ধারিত ছিল। কয়েকটা ধাপে বয়সসীমা বাড়িয়ে এখন আঠারো বছরের চেয়ে বড় যে কেউ টিকার জন্য আবেদন করতে পারবেন নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে।
এর মধ্যেই নিউ সাউথ ওয়েলসের রাজধানী সিডনিতে কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত হয়ে লকডাউনের বিরুদ্ধে মিছিল করেছেন। পরেরবার আবার একই রকম সমাবেশ করতে চাইলে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করে সেটা ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এখন পর্যন্ত টিকা নেওয়ার ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করে যাচ্ছেন। যদিও টিকা কেন্দ্রের বাইরে প্রতিদিনই অপেক্ষমাণ মানুষের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। আমার প্রথম ডোজের টিকা নেওয়ার সময় ছিল ৫ জুলাই সকাল সাড়ে আটটা। আমি তাই সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। অত সকালেও দেখি আমার সামনে গোটা বিশেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন এবং সময়ের সঙ্গে আমার পেছনে লাইন দীর্ঘ হতে শুরু করল।
টিকা কেন্দ্রের বিষয়টা এখানে একটু বলে নেওয়া দরকার। আগে থেকে নিবন্ধন করে সবাই নির্ধারিত সময়ে টিকা কেন্দ্রের বাইরে সুশৃঙ্খলভাবে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করেন। সেখানে অবশ্যই শারীরিক দূরত্ব রক্ষার এবং মাস্ক পরার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। প্রথমে একজন স্বাস্থ্যকর্মী এসে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সাহায্যে প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা মেপে একটা ছোট বৃত্তাকার লাল রঙের স্টিকার দিয়ে সেটাকে শরীরে সেঁটে দিতে বলেন, যাতে সহজে দেখা যায়। এরপর রিসেপশনে সবার মেডিকেয়ার কার্ড এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স চেক করে একটা ব্যান্ড হাতে পরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভেতরে প্রবেশ করার পর আবারও লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। বিভিন্ন কক্ষের সামনে স্বাস্থ্যকর্মী দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষমাণ মানুষ এবং টিকাদানকারীর হিসাবে বলে দেন, কাকে কোন লাইনে যেতে হবে।
এরপর টিকা কক্ষে প্রবেশের পর আবারও তথ্যগুলো যাচাই করে টিকা প্রার্থীর শারীরিক বিষয়ের বিস্তারিত তথ্য নিয়ে নেন। এ ছাড়া স্বাস্থ্যকর্মী টিকার বিষয়ে বিস্তারিত বলেন যেমন: কোনো ব্র্যান্ডের টিকা, কত পরিমাণে দেওয়া হবে এবং কত দিন পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে আসতে হবে। টিকা নেওয়া হয়ে গেলে সবাইকে অবজারভেশন কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করতে হয়। টিকাদানকারী টিকা দেওয়ার সময় থেকে হিসাব করে একটা সাদা কাগজের স্টিকারে ১৫ মিনিট পরের সময়টা লিখে সেটা জামার সঙ্গে লাগিয়ে নিতে বলেন।
অবজারভেশন কক্ষে গিয়ে অপেক্ষা করার পর সেই স্টিকারের সময় ধরে ধরে সবাইকে ডেকে আবার লাইনে দাঁড়াতে বলা হয়। এরপর আবার একজন স্বাস্থ্যকর্মী সবকিছু চেক করেন, যেমন টিকা নেওয়ার পর কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না। সমস্যা হলে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে—এসব বিষয়ে পরামর্শ দেন।
ঠিক একইভাবে তিন সপ্তাহ পর নিতে হয় টিকার দ্বিতীয় ডোজ। আমাদের বন্ধু আশফাক ভাই এবং দিশা ভাবিরা টিকা নিয়েছিলেন ক্যান্টারবুরি কেন্দ্র থেকে। দুই ডোজ টিকা নেওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ফোন করে জানানো হয়, উনারা টিকা নেওয়ার জন্য যে সময়টা কেন্দ্রে অবস্থান করেছেন, সেই সময়ে ওখানে এমন একজন ছিলেন, পরে যাঁকে পরীক্ষা করে করোনা পজিটিভ বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাই তাঁদেরকে আইসোলেশনে থাকতে হবে এবং তিন দিন পরপর পরীক্ষা করাতে হবে। তাঁদের প্রথম পরীক্ষাতে করোনা ডিটেক্ট হয়নি। এরপর আবারও তাঁরা টেস্ট করানোর জন্য নমুনা দিয়েছেন। এই কদিন উনারা কোথাও যেতে পারবেন না।
এভাবেই করোনা এক নতুন জীবনবোধের উপায় বাতলে দিচ্ছে। মাঠে ঘাটে পথে প্রান্তরে সবাই মুখোশ পরে ঘুরছেন। কেউ কাউকে চিনতে পারছেন না। আগে যেমন সবাই সবার বিপদে এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়াতেন, এখন সবাই দূরে সরে গিয়ে বরং পাশে দাঁড়াচ্ছেন। কারণ, সংস্পর্শে এলে এই রোগ আরও বেশি ছড়িয়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে আক্রান্ত করবে। বাজারঘাটের জন্য আগে যেমন সবাই শপিং মলগুলোতে হামলে পড়তেন, এখন সেখানে সবাই অনলাইন শপিংয়ে ঝুঁকে পড়ছেন। বাড়ি বাড়ি এসে পোশাক থেকে শুরু করে মুদির সদাই পর্যন্ত ডেলিভারি দিয়ে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। সেলুনগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, তাই অনেকেরই চুল কাটা বন্ধ হয়ে আছে। অবশ্য অনেকেই চুল কাটার যন্ত্র কিনে বাসায় নিজে নিজে চুল কেটে নিচ্ছেন। আমাদের বাসায় ছোট রায়ানকে কোনোভাবেই চুল কাটানোর জন্য রাজি করানো যাচ্ছে না। তাই তার চুলের নিচে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে কানের লতি।
এত কিছুর পরও থেমে নেই জীবন, থেমে নেয় উৎসব, আনন্দ উদ্যাপন। ঈদুল আজহার খুতবা থেকে শুরু করে নামাজের জামাত আদায় করা হয়েছে জুম মিটিংয়ে বা অনলাইন ব্যবস্থায়। বেশির ভাগ কোরবানি দেওয়ায় বন্ধ ছিল এবার। অনেকেই সেই টাকা দিয়ে করোনার কাজ হারানো মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সামনে আসছে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেটাও আর যথানিয়মে পালন করা সম্ভব হবে না। সেটাও হয়তোবা পালন করা হবে জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এর মধ্যেই বেরিয়ে গেছে আনন্দমেলার শারদীয় পূজাসংখ্যা।
আমরা ছোটবেলায় পড়েছিলাম, মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজে সবাই একত্রে মিলেমিশে বসবাস করেন। একে অপরের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। গত প্রায় দেড় বছরে করোনার প্রকোপে একধরনের নতুন সমাজব্যবস্থা ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে। আমরা একে অপরের সংস্পর্শে না এসেও অন্যের পাশেই আছি। বিপদগ্রস্ত মানুষকে যতটুকু পারা যায় আর্থিক ও মানসিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি। তাদের সঙ্গে দেখাও হচ্ছে ইথারের ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে, হচ্ছে মিথস্ক্রিয়া। করোনার প্রভাবে এভাবেই হয়তোবা একটা নতুন জীবনবোধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম হয়তোবা এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যাবে। মুখোশ পরে চলাটাকেই হয়তোবা তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হবে। যেই বাতাসে রয়েছে জীবন রক্ষাকারী অক্সিজেন, আবার সেই একই বাতাসের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে যাচ্ছে করোনার জীবাণু।
এভাবে চলতে চলতে হয়তোবা কোনো একদিন আসবে, যখন করোনার জীবাণু পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হবে। মানুষ মুখ থেকে মুখোশ খুলে একে অপরকে দেখে অবাক হয়ে যাবে। আনন্দের আতিশয্যে বারবার করবে কোলাকুলি। গুরুজনেরা আবারও ছুঁয়ে দেখবেন তাঁদের স্নেহের পরবর্তী প্রজন্মকে আর শোনাবেন করোনাকালের ভোগান্তির গল্প, যুদ্ধের গল্প বা বেঁচে থাকার গল্প।