কবিতার এক পাতা
‘কবিতার এক পাতা’ দুই বছর পূরণ করেছে। অভিবাদন কবিদের। পূর্ব-পশ্চিমে ছড়িয়ে থাকা কবিদের দাপুটে বিচরণ ছিল এ সময়টিতে। কবিরা সময়কে ধারণ করেছেন তাঁদের ভাববিলাস দিয়ে। বোধের জগতে তাঁরা নাড়া দিয়েছেন। বাংলা কাব্যচর্চার প্রয়াসে ‘কবিতার এক পাতা’ একটি মাইলফলক হয়ে উঠেছে। ধন্যবাদ কবি ফারুক ফয়সলকে। প্রতি মাসে যত্ন করে ‘কবিতার এক পাতা’-এর মাধ্যমে আমাদের কাছে কবিতা উপস্থাপনের জন্য।
বর্ষপূর্তিতে আমাদের ইচ্ছা ছিল একটা জম্পেশ আয়োজনের, যেখানে এ পাতায় সরব কবিদের উপস্থিতি থাকবে। তাঁদের কাব্য জলসায় সমবেত করার এ সুযোগ আমরা নিতে পারলাম না। বড় বেশি পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। মহামারি আমাদের তাড়া করছে।
সব সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটুক। মহামারি উবে যাক। প্রকৃতি শান্ত
হোক। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সঙ্গে থাকার জন্য সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
—ইব্রাহীম চৌধুরী, আবাসিক সম্পাদক
চলতি সংখ্যা প্রকাশের মধ্য দিয়ে ‘কবিতার এক পাতা’ দুই বছর পূরণ করল। এই আনন্দ ভ্রমণে সঙ্গী হয়েছেন উত্তর আমেরিকা, বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাংলা কবিতার কবি, আবৃত্তি শিল্পী ও কবিতাপ্রেমী পাঠক। আমরা আনন্দিত। কৃতজ্ঞ আপনাদের সবার প্রতি। ‘কবিতার এক পাতা’-এর দ্বিতীয় বর্ষপূর্তির দুই পাতার এ বিশেষ সংখ্যা উত্তর আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের সতেরো জন কবির সতেরোটি কবিতায় বৈশ্বিক সাজে সেজেছে। আশা করছি, বরাবরের মতোই সংখ্যাটি আপনাদের মনোযোগ ও ভালোবাসা পাবে। প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার আবাসিক সম্পাদকসহ পুরো পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কবিদের প্রতি রইল আমাদের সশ্রদ্ধ ভালোবাসা। আপনারা আমাদের বুকভরা ভালোবাসা নেবেন। —ফারুক ফয়সল
বদিউজ্জমান নাসিম
কোলাজ
১
গল্পগুলো আমার;
পথ হারিয়ে অন্ধকারে
তোমার দ্বারে থামার!
২
মন যেতে চায় অনেক দূরে
মন যেতে চায়—চায় না;
মন যেতে চায় তাহার কাছে
মন যেতে চায়—যায় না।
৩
বন্ধুরা সব বুদ্ধিজীবী
ওরা ব্যস্ত ওদের সাথে;
বন্ধুরা সব সিক্ত আঁখি
মদ-বিনিময় মধ্যরাতে।
৪
ভূমিহীন চাষি আমি
তুমিহীন চাষি
তুমিহীন ভূমিহীন
তোমায় ভালোবাসি।
শামীম আজাদ
বাহু বদল
কত দিন ধরে বরফের বইঠা বাইছি।
ডানে পুরাতন মমতার মাঠ
কে যেন মোম দিয়ে ঢেকে ফেলেছে!
বাঁয়ে সাবানজলে ধোয়া আতপ চালের ভাত
ও বারো রকমের মসলা দিয়ে
বাদুড়ের কলিজা ভুনার
আয়োজন চলছে।
আমার সামনে ও পেছনে কেবলি
নর-ভাষ্যের নদী, আমি নামব কোথায়!
আমি যে আমার কঙ্কাল বয়ে বয়ে
ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
এত এত মর্মরিত মহালয়া
এমনকি অকালবোধনও গেল
আর আমি কাশ ফুলে ফুলে
কেবল ফটো হয়ে উঠলাম
কিন্তু দুর্গা হলাম না।
এই অস্বাভাবিক অবরুদ্ধ সময়ে
কবিতার বাম্পার ফলনের মধ্যেও
আমার ফল ও ফসল যে
অসাধারণ ও ভিন্ন
তুষারেরও যে তাপ আছে
এ যে শুধু নারীভাষ্য নয়
গা পুড়লে সব গুনাগার
ঠিকই টের পাবে।
আমি আর বরফের নাও বাইতে পারব না।
এইবার অকালকুষ্মাণ্ডদের পালা।।
শামস আল মমীন
জি হ্যাঁ
ফ্রাঙ্কফুর্টে প্রকাশনা উৎসব
নিউইয়র্কে বইমেলা
বুকের ওপর নেম ট্যাগ
বড় বড় হরফে লেখা
বাংলাদেশ...
রপ্তানি মেলা
স্যুট-টাই আর পাঞ্জাবিঅলা
মনকাড়া, কী সুন্দর নকশি কাঁথা
বলে কেউ, তুমি কী...
জি হ্যাঁ,
বাংলাদেশ...
ব্যানানা রিপাবলিক, মেসি’স, গ্যাপ
ওল্ড নেভি
উষ্ণ বস্ত্র, শীতবস্ত্র
দেয়ালে ইটের মতো থরে থরে সাজা
এটা কী, জি হ্যাঁ,
বাংলাদেশ...
ওয়াল স্ট্রিট, নাসা
কলেজ করিডর
বেনারসি ওড়ে...
ইয়েলো ক্যাব,
ডাউন টাউন, আপ টাউন
কারি ইন-এ হারি
জ্যাকসন হাইটস্,
ডানকিন ডোনাটস;
বুকের ভেতর, জি হ্যাঁ,
সারাক্ষণ
বাংলাদেশ...
মঈনুস সুলতান
সব কিছু ভিন্ন মনে হয়
গাঢ়ভাবে তাকালে সবকিছু ভিন্ন মনে হয় হালফিল,
আবির ছোঁয়া প্রকৃতির প্রেক্ষিতে ওড়ে সূর্যস্নাত প্রজাপতি
শা’নজরের মতো খুলে যায় মরমের খিল,
কলির অন্দরে ঝুরে মৌমাছির আতর মাখা আরতি।
আর দেখো যখনই এসে দাঁড়াই কৃত্রিম ঝিলের পাড়ে
সিরামিকের খাঁচায় সমুদ্রের টলটলে সবুজ,
তীব্র মনোযোগে শৈবাল বাড়ে
লতিয়ে ওঠে ওয়েসিসে তুমুল তরমুজ।
হায়..নিমজ্জনে খুঁজে পাই জলের জিন্দান
সাঁতরে চলে আসি কারা-দীঘির দ্বারে,
এখানে আছে বুঝি নিরিবিলি কিছু ত্রাণ
শূন্যতায় যাবজ্জীবনের ক্ষয়িষ্ণু ক্ষারে।
ফেরার পথে দেখি সুরুজ ছিটানো উপত্যকা
সৈকত-ছাতার ছায়াতলে রোদের কস্তুরিতে মাজা ত্বক,
ঘাসের হাশিয়ায় উড়ছে দেবদারুর সাবুজিক পতাকা,
পারি না এড়াতে রূঢ় নীলিমায় মানবী সে চুম্বক।
অতি ধীরে হাঁটি বিমানঘাঁটির রানওয়ে ছেড়ে সুদূরে
খোয়াবের শানবাঁধা পলাতক সিঁড়ি,
কামের খামিরা তামাক পুরে
উচ্চাশার টেন্ডুপাতায় বাঁধি নিজস্ব বিড়ি।
কামরুল হাসান
রাত্তিরে ঘুম-না-আসা কবিতা
চামেলিদের বাড়ি থেকে আলো আসে গভীর রাত্তিরে
সংকেতও ভেসে আসে খুব
নিঃসীম অন্ধকারে ডুবে থেকে দেখি
গ্রহটির বদলানো মুখ
বিশ্বম্ভরের মেলায় কীর্তিনাশা নদী অপরূপ
চামেলি ও চামেলির বোনদের ভিনদেশি রূপ
আমাকে রয়েছে ঘিরে যে শব্দজোনাকিরা
তারা ওই দূরত্ব লঙ্ঘনে বিমুখ
বুঝি ওইখানে সাহসের দীর্ঘ ডানা হয়ে আছে চুপ
গ্রহের কিনারে পড়ে থাকা উড়ন্ত হাসিও নিশ্চুপ!
২
কত কী যে জড়ো করি দশটি আঙুলে
অতঃপর পড়ে যায় ফাঁক-ফোকর গলে
চামেলিও রয়ে গেছে ছিন্ন করতলে
মহাদেশের মতো এক দেশের ভূগোলে।
কত যে সুজনের মুখ দেখা হলো গ্রহে
কত যে পোড়াল তারা সুখে ও বিগ্রহে
অনুমেয় সব গতি রুদ্ধ-পাখ দূর দেশে
দাঁড়িয়ে রয়েছে কে আতঙ্কিত গা ঘেঁষে?
যখন হারাই সব, তখনো স্মৃতিরা সম্বল
পৃথিবীর ফুলদল সিক্ত চোখে ঝরে অবিরল
আলোর উৎপীড়ন চোখে সহ্য হয়ে আসে
প্রেম, পূজা, পরিণয় রাখি উদাসীন ঘাসে।
ঘুমের ভেতর যদি কেটে যেত আতঙ্ককাল
মহাসমুদ্রের ওপারে গিয়ে দেখতাম সকাল।
ফকির ইলিয়াস
সিনেমা দেখার নিয়ম
দৃশ্যগুলো বদলে যাচ্ছে দ্রুত। যারা দর্শক, তারা
পেছনে হেলান দিয়ে বসে আছে নিরাপদ দূরত্বে
কেউ জোর করে কেটে নিচ্ছে অন্যের
পাকা আউশ ধান,
কেউ জোর করে দখল করে নিচ্ছে
নন্দন, নদী, নগর, নৃত্য
বলপ্রয়োগ করে এই মাটিতেই এঁকে যাচ্ছে
নির্মম ধর্ষণের দাগ।
আমি একই বিষয় নিয়ে বারবার কবিতা লিখছি।
তুমি জানতে চাইছ, ‘বিষয় বদলাচ্ছ না কেন!’
কোনো উত্তর দিতে না পেরে আমি,
কেবলই দীর্ঘায়িত করছি আমার নির্বাসন!
জাগতিক বায়োস্কোপ থেকে চোখ সরাতে সরাতে
শুধুই ভুলে যেতে চাইছি সিনেমা দেখার নিয়ম।
হোসাইন কবির
বাতাসে আগুন জ্বলে
রক্ত জোছনায় প্রগাঢ় বেদনা-বধিরতা
নিরাসক্ত সান্ধ্য-ভাষ্য
পুড়ছে বনবনানী সমুদ্রের গতিপথ নদীর বুনন
নিঃসঙ্গ নদীর পাণ্ডুলিপি নিয়ে শুয়ে
আছে মানুষ—সর্বত্র
হাজার বছর হেঁটে চলা পথে আজ
‘উড়িতেছে’ ছাইভস্ম লেলিহান দাবদাহ
বাতাসে আগুন জ্বলে—পুড়ছে বহতা নদী,
পোড়ে অবয়ব মানুষের
হেনরী স্বপন
জারুল বনের ছায়া
উড়োজাহাজের ডানা মেলে থাকি...
তোমায় খুঁজতে ছুটে যাওয়া আমি পরিযায়ী পাখি।
পোশাকে উলের তাপ শুষে টের পাই—
তোমার ত্বকেও শুষ্ক মরুভূমি;
উষ্ণতা সাজানো দেহে, তৃষ্ণা কাতর পারদ ছিলে:
নিরিবিলি গ্রাম—তুমি।
আমি ছিলাম অলস অন্ধকারে সুখী...
তুমি ছিলে, আঁতর আবেগ—বন্ধ দ্বারে দায়মুখী;
পালক খুলতে শীতলপাটির মায়া...
রোদ তখনই মুছিয়ে দিত! ফোঁটা ফোঁটা—
জারুল বনের ছায়া।
শিউল মনজুর
চাবি
দূরে বনমোরগেরা ডেকে চলেছে, এমন ডাক কখনো কেউ শোনেনি...
কেমন যেন শুধুই ভাঙনের শব্দ ও সুর—প্রতিটি সাইরেন, বুকের ওপর
দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে হেসে খেলে দানবের পায়ে, আর বোঝার আগেই
জানার আগেই লকডাউন হয়ে যাচ্ছে পাড়া-মহল্লা, জেলা-উপজেলা
হাসপাতাল-ক্লিনিক; আর আইসোলেশনের গভীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে
বৃষ্টিভেজা লতাপাতাদের উচ্ছ্বাস। নির্মাণের কাল পেরিয়ে, জংশনের
ট্রেনগুলোও যেন বিষণ্নতা নিয়ে জং-ধরা মনে ক্লান্ত অবসন্ন পৃথিবীর
ভবিষ্যৎ পাঠে মগ্ন হয়ে আছে দার্শনিকের মতো। কেউ যেন
ভূবনচিলের ডানা ভেঙে দিয়েছে, গ্লোবাল ভিলেজের অক্সিজেন সিলিন্ডারে
ঝুলিয়ে দিয়েছে মস্ত বড় তালা। কুঁড়েঘরের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সবাই
খুঁজে ফিরছি মস্ত বড় তালার নতুন চাবি...
তাপস গায়েন
রাত্রিগাথা
কখন যে বিক্ষুব্ধ বাতাস আমাকে
পথের অন্তিমে পানশালার কাছে রেখে গেছে…
ভোর হবার আগে
এখন প্রকৃতি মূলত শান্ত আর বৃক্ষরা সমাহিত
রাত্রির প্রথম প্রহরে বাহিত
কিশোরী আমনকারের রাগ ভূপালি
ভবিষ্যতের স্বপ্নে এখনো উদ্দীপ্ত করে
উজ্জ্বল সূর্যের মতো আমার মেধাবী যৌবন
অভাবিত মাধুর্যে ভরে আছে রাতের বাতাস,
ফুলের বাগান মৌমাছিহীন সময়ের কোলাহলে পূর্ণ
একদিন যারা ছিল সমুদ্রগামী,
শিশুদের স্বপ্নে আজ তারা আছে ঘুমের গভীরে
দূর নগরীর স্কাইস্ক্র্যাপার
এখন আমার স্বপ্নের মৌনতায় আনত
নক্ষত্রের ধূলি ঝরে পড়ে এই দেহে
সময়ের জন্ম হবে বলে আমি হেঁটে চলি রাতের অন্তিমে…
জিললুর রহমান
মেঘে মেঘে
মেঘের পাহাড় ছাড়া আর কোনো পাহাড় হাঁটছে না
গজগামিনীর ঢঙে সার সার ঐরাবত যথা
যারা বড় বড় মেঘ—যারা ঘন শাদা ডাইনোসরবেশী
আমাদের মাথার ওপরে উড়ে উড়ে
নিত্যদিন প্রকৃতির প্রাণের দোসর
বাধা বন্ধনের ধার ধারে না, মানে না
সীমান্তের কোনো তার—কোনো কাঁটা
দখিনের সমুদ্রের হাওয়া ঠেলে দেয় সে মেঘ উত্তরে
পাহাড়ের ঘাড়ে তারা শীতল পরশ ঢেলে যায়
অজানা গন্তব্যে ছোটে বুনো হরিণীর গতি
আরও উত্তরের বরফের দুধসাদা ঠোঁটে
সাগরের নিমক ও উষ্ণতা হয়তো পায় একচোট
বুকে করে নিয়ে যায় সে আর্দ্রতা মানুষের ঘরে
প্রাণীদের—উদ্ভিদের প্রাণের ভেতর
নতুন শস্যের ঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে
নতুন জীবনচিত্রে ভরেছে আকাশ—
মেঘে মেঘে বেলা হয় বর্ষণের আনন্দের ঢঙে
মাথার ওপরে কড়া ঝলমলে রোদ্দুরের ফাঁকে
নির্বিকার গ্রাস করে করে ওড়ে সুদূর অলক্ষ্যে
সেই মেঘ, সিঁদুরে শঙ্কায় কম্পমান আকাশগঙ্গায়
শিবলী মোকতাদির
তদন্ত
বনের গভীরে থাকে ভয়। সুনিশ্চিত।
গন্ধে ভাসে মাংস-মাখানো মৃৎ
এখানে লাল কালিতে লেখা আছে
বড় বড় অক্ষরে—‘বিপদ আসন্ন’।
রংচটা দিনের বিষণ্ন আলোয় আমি তো নগণ্য।
মোটা মোটা শতাব্দীজুড়ে তোমাকে ধাওয়া করছে
আঁদ্রে জিদের অবৈধ পত্রাবলি।
মোনালিসার ফেডআউট গাম্ভীর্য।
বৈধ নাবিকের হারিয়ে যাওয়া অবৈধ লগবুক।
আমি দ্য ভিঞ্চির আদেশে
ফ্রয়েডের ফলস প্রেতাত্মায় ভর করে
ধরতে এসেছি তোমার যাবতীয় ধনতান্ত্রিক অপরাধ।
চাঁদ আছে চারিপাশে। আলো তার অলৌকিক।
জোনাকির জালিয়াতি ভেদ করে
ফুটে থাকা অন্ধকারে ফিরে এসে দেখি—
তাঁবু আমার পরিত্যক্ত, ভিতরে তার অনিত্য আলামত
দূরে, দুর্গ ঘেঁষে ছুটে যাচ্ছ তুমি
যেন সিঁড়ির মতো সরু পথ।
খলিল মজিদ
জন্মদিন
দেয়ালে ঝুলছে জন্মদিন। তার ‘পরে আঁকা আছে
লাল হলুদ সুগন্ধী। ওগো, শুভেচ্ছামুখর
পাঁপড়িসকল, ওগো, মোমের দীপালিসম
জ্বলন্ত পঁচিশ, কী নিদারুণভাবেই না তোমরা
আক্ষরিক। পার হয়ে গাণিতিক প্রহরাব্দ,
গত হয়ে সমূহ পঁচিশ, অবশেষে তুমি বৃত্তাবদ্ধ
চিহ্নিত চরস। জানালার গ্রিল গলে হেসে খেলে
আধিপত্যবাদী রোদের মধ্যে ঢুকে তো পড়েছ,
ভেঙে তো দিয়েছ আমার আত্মরক্ষার অভিমানখানা।
আলফ্রেড খোকন
কাঁটাবন প্রেসের এপিটাফ
গভীর রাত ধরে আমার একটি কবিতা যখন
কাঁটাবন প্রেসে চাপা খেয়ে হচ্ছে মুদ্রিত
ইলেকট্রিক তারে ঝুলে থাকা চাঁদ কি জানে
এর পেছনে কে বা কারা জড়িত!
মধ্যরাত জড়িয়ে পড়েছে বিষাদ বিভাগের স্নেহে
তার হাতে ঘোরলাগা অক্ষরগুলো একটু একটু করে
আকাশের স্নেহে পালিত
ছাপা হচ্ছে সন্ধ্যেবেলা, ঝুঁকে পড়া আলোয়
ভেজা হাতে কয়টি ব্যাকুল আঙুল
প্রেস ম্যানেজারের হাতে চাপা খাচ্ছে
অদূর ভবিষ্যৎ, বাংলা কবিতার ভুল
অক্ষরের আঁধারে ছাপা হচ্ছে ক্ষোভ, গোঙানি,
কত রকমের মোহ
মধ্যরাতে কবির কলমজুড়ে কত বোবা মুখ
বেদনার সমারোহ।
মোস্তাক আহমাদ দীন
অনাহূত
এখনো চিনি না তাকে, উঁচু ঘাড় বাঁকা করে এসে
দাঁড়িয়েছে পথের ওপরে
দেখি, ছায়া তার লেঙুরের মতো ঝুলে আছে পায়
তবু তো শরীর দেখি ছায়াভাবে স্থির নদীতীরে
আমি দেখি ঘোলাজল একরঙা রূপ ধরে আছে
এইবার ঝলোমলো পাখিটির রূপ ধরে এলে
তাকে কিছু চেনা যায় পুরাতন ঘড়ির ছায়ায়
যেখানে ছায়াটি পড়ে সেই জল আদি ঠারে রাঙা
আমি তো সর্বংসহা, সুরমার চিরল ধারায়
রওশন হাসান
অভ্যুদয়
আমি হেঁটে চলেছি আগামীকে মুষ্টিবদ্ধ করে
আমার শপথগুলো আমাকে ভেদ করে চলে
ভেদ করে অজাত অন্ধকার নিঃসীম নির্জনতায়;
আমি ও সিসিফাস বয়ে নিয়ে চলেছি ওজন প্রস্তর
আমাদের আসন্ন অভ্যুদয় আকাশ ও পৃথিবীর জন্য,
আমাদের জানা নেই পদচিহ্নের কৌশল, দূরত্বের মহিমা
কিছু অন্তর্বর্তী মেঘ ও বাস্পপ্রদাহ আমাদের বিপুল সাগ্রহ-সঙ্গী
ছত্রে ছত্রে আর্দ্র হাওয়ার বিষণ্ন প্রকোপ
আমরা পরমায়ু ও স্পর্ধার পাঁজরে ক্রুশবিদ্ধ যিশু
প্রহর ব্যগ্র অনামী ভবিষ্যতের পথে
মিইয়ে পড়া ফুল আর পাতাগুলো সম্পর্কচ্ছেদ কেমন ঝরে যায়
বিহঙ্গের প্রাণে অসতর্ক আলোর বিচ্যুতি অস্পষ্ট স্বস্তিহীন
ঠোঁট থেকে মুহূর্ত বৃষ্টি—চুম্বনের মতো আঁকড়ে ধরে মৌসুমের নিষ্ক্রমণ
মধ্যরাতের কল্পনায় জেগে ওঠা নিস্তব্ধ অরণ্যে
জীবন্ত কোন অস্তিত্ব ও ঘড়ির একাকিত্বে
কাগজের শূন্য পাতায় যেমন নড়ে ওঠে টেড হিউজের আঙুল।
মণিকা মুনা
অতীত প্রসঙ্গ
এখন অন্তঃপুরে উঁকি দেয়া যায়
নিজের ভেতরে দেখ
ক্ষমা করা যায়,
ভালোবাসা যায় আরেকবার?
সুড়ঙ্গে অন্ধকারের মতো
বদ্ধ হাওয়ার মতো
জীবন নেই
নিশ্বাস নেই
শরৎ নেই, শিউলি নেই
পড়ে আছে হাড়ের কঙ্কাল
স্মৃতি সেই জাদুঘর।
নাবিক সেখানেই পাতে পাল
হাল, সংসার!