কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: বাংলাদেশের বিনীত শ্রদ্ধাঞ্জলি
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনের এরিনা থিয়েটার। যেখানে একাত্তর সালের ১ আগস্ট পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। সেদিন বিশ্ব নাগরিকদের ভালোবাসার ঋণে আবদ্ধ হয়েছিল মুক্তিকামী, স্বদেশবঞ্চিত, দরিদ্র বাংলার মানুষ। ৫১ বছর পর ২০২২ সালের ৬ মে রাতে বাংলাদেশ নিজে আয়োজন করেছে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ–এর সুবর্ণজয়ন্তী।
বিশ্বব্যাপী খ্যাতনামা রক ব্যান্ড অ্যাম্বাসেডর স্কোরপিয়নের ও বাংলাদেশের চিরকুট ব্যান্ডের পরিবেশনা দেখতে ১৩ হাজার মানুষ জড়ো হয়েছিলেন এ বর্ণাঢ্য সঙ্গীতায়োজনে। কনসার্ট থেকে প্রাপ্ত আয় সারা বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর শিশু-কিশোরদের সাইবার সিকিউরিটি সচেতনতা তৈরির কাজে ব্যয় করা হবে। এ যেন ছিল বিশ্ববাসীর ঋণ ফিরিয়ে দেওয়ার কৃতজ্ঞতা বহিঃপ্রকাশের এক অনন্য প্রয়াস। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর আমেরিকান রাজনীতিবিদ এবং তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। সে কথায় যাঁরা বিশ্বাস করতেন অথবা এখনো করেন, তাঁদের তিন মিনিটের তিনটি তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছে উন্নয়নশীল বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের কাহন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন মাহেন্দ্রক্ষণ আসে কালেভদ্রে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি–বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইসিটি বিভাগ এ আয়োজন করে। নেই তেমন কোনো প্রচার, বাংলাদেশের বড় কোনো ব্যান্ড দল আসেনি। নেই আমেরিকান কোনো ব্যান্ড দল। এমন অনেক নেতিবাচক ধারণা নিয়ে অনুষ্ঠানে এসেছিলাম। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে দুই ধাপের নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে দীর্ঘ খোঁজাখুঁজি করে নিজের আসনটি পাই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায়। কনসার্ট শুরু হওয়ার কথা রাত আটটায়। পরিচিত অনেক মানুষের দেখা পাই আশপাশে। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানও দেখছি আছেন অনেকেই। ২০ হাজার ৭৮৯ আসনের এ হলে অগণিত সিট খালি দেখে নেতিবাচক ধারণা বাড়ে ক্রমশ। ভুলে যাই ঠান্ডা এবং দিনব্যাপী ঝড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির কথা।
আমার সিটের কাছে যাওয়ার পথে দেখেছিলাম প্রতি প্রবেশপথের পাশে আছে স্ন্যাকসসহ অন্য বুথ। একটি বসেছে শুধু স্কোরপিয়ন ব্যান্ডের পোলো শার্ট ও হুডি নিয়ে। স্নেকস নিতে এসে দেখি স্করপিয়ন বিক্রি হচ্ছে দেদারছে। আমাদের হলের প্রবেশপথগুলোতে দর্শকের ভিড় বেড়েছে।
আবার হলে ঢুকে দেখি লোকে লোকারণ্য। প্রাচীন গ্রিক থিয়েটারের আদলে নির্মিত এ এরিনা থিয়েটার মিলনায়তনে অন্তত ১৩ হাজার দর্শকের সমাগম। পাহাড়ের পাদদেশের মতো সমতলে বিশাল মঞ্চ। বাকি তিন দিকে দর্শক। স্তরে স্তরে আসনগুলো ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। মঞ্চ থেকে দর্শক গ্যালারি যেন বর্ণিল আলোর উচ্ছ্বাস। দর্শক গ্যালারিতে বর্ণিল আলো পড়লে মনে হয় রংধনুর কল্লোল বইছে। মঞ্চে গ্রাফিকসের খেলা। ক্রিস্টাল ক্লিয়ার সাউন্ড। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে মঞ্চের সামনে শ খানেক মনিটরে কাজ করছেন কর্মী বাহিনী।
এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। শতকরা ৬০ ভাগ দর্শক ইউরোপিয়ান। হাজার তিনেক হবেন আমন্ত্রিত বাংলাদেশি দর্শক। ফোন করে অনেক বন্ধু বলছে টিকেট কাটতে পারছি না। অনেকেই গেটের সামনে এসে ফিরে গেছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বিলবোর্ডে লেখা উঠেছে সোল্ড আউট।
ঠিক রাত আটটায় অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি–বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বিশ্ব নাগরিকদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে সংক্ষিপ্ত স্বাগত বক্তব্যে ৫০ বছরে বাংলাদেশের উন্নয়নের কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের পথ ধরে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী বছর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি বাংলাদেশ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া শুরু করবে ইউএনডিপি। তাঁর বক্তব্যে সায় জানিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখর করে বাংলাদেশি দর্শকেরা।
বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করেন একুশে পদকপ্রাপ্ত রবীন্দ্র সংগীতশিল্পী কাদেরী কিবরিয়া। এ সময় তাঁর সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন মুক্তযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, মো. নুরুল আমিন ও অপরাজিতা হক। হল ভরা দর্শক এ সময় দাঁড়িয়ে সম্মান জানায় বাংলাদেশকে। অভূতপূর্ব এই দৃশ্যে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অশ্রুসিক্ত হন।
বাংলাদেশের ব্যান্ড ‘চিরকুট’ ২০ বছর ধরে মৌলিক গান করছে। এবার প্রথমবারের মতো বিশ্ব দরবারে এত বড় মঞ্চে উঠেছে তারা। দলটির প্রধান ভোকাল শারমীন সুলতানা সুমী শুরু করেন ‘ধনে ধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটি দিয়ে। দলের অন্যান্য সদস্য এবং বাংলাদেশি দর্শকেরা তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মেলান। তাঁদের ব্যান্ডের পুরোনো জনপ্রিয় কয়েকটি গানের পর সুমি গেয়েছিলেন ‘শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি’ গানটি। এত বড় আয়োজন উপলক্ষে চিরকুটের নতুন কোনো গান না পেয়ে অনেকেই আশাহত হন।
নগর বাউলের জেমস এলে এ কনসার্ট পূর্ণতা পেত বলে প্রবাসীরা মনে করেন। তাঁদের ২০ মিনিটের পারফরম্যান্স শেষে মঞ্চে আসে জার্মানির বিখ্যাত রক ব্যান্ড দল স্কোরপিয়নস। মঞ্চের বাদ্যযন্ত্র ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি পরিবর্তনের সময় বড় স্ক্রিনে দেখানো হয় বাংলাদেশের উন্নয়নের তথ্যচিত্র।
১৯৬৫ সাল থেকে রক ও মেটাল গান গেয়ে জগৎখ্যাত হওয়া স্কোরপিয়নস মঞ্চে আসা মাত্রই দর্শকসারি প্রাণ ফিরে পায়। অলিভিয়া তাঁর কিশোরী কন্যাকে নিয়ে এসেছেন স্কোরপিয়নস গান শুনতে। ‘আমি কিশোরী বয়স থেকে স্কোরপিয়নস এর গানের জন্য পাগল। আমার মেয়েও তাদের জন্য একই রকমভাবে পাগল’। বলছিলেন জার্মানির দর্শক অলিভিয়া। একের পর এক জনপ্রিয় সব গান মাতিয়ে তোলে গোটা মিলনায়তন। মঞ্চ থেকে গ্যালারি একাকার হয়ে যায় সম্মিলিত কন্ঠে। এ যেন ১৩ হাজার মানুষের এক যৌথ পরিবেশনা। এ কনসার্টের প্রতিপাদ্য ‘লেট দ্য মিউজিক স্পিক’ আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন করেছে স্কোরপিয়ন।
৫১ বছর আগে একই মঞ্চে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করে সে সময়ের প্রখ্যাত ব্যান্ড তারকা জর্জ হ্যারিসনকে স্মরণ করে স্কোপিয়নস। তারা গোল্ডেন জুবিলি বাংলাদেশ কনসার্টকে ‘বাংলাদেশ নাইট’ বলে অভিহিত করে। বুকে হাত রেখে বাংলাদেশের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইটি–বিষয়ক উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয় ও তাঁর স্ত্রী ক্রিস্টিনা প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রিয় ব্যান্ড দল স্কোরপিয়নস এর গান উপভোগ করছিলেন।
২০০০ এবং ২০০৬ সালে নিউইয়র্কের প্রবাসী বাঙালিরা ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে সাড়ে চার হাজার আসন সমৃদ্ধ হলে অনুষ্ঠান করেছিলেন। এরিনা থিয়েটারে এটাই বাংলাদেশিদের প্রথম আয়োজন। প্রায় ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের এ সুবিশাল অনুষ্ঠানে কেন জর্জ হ্যারিসন, রবিশঙ্কর পরিবারের কাউকে সম্পৃক্ত করা হয়নি? কনসার্ট উপলক্ষে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনস্যুলেট অফিসে ৪ মে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বলেছিলেন, ‘আমরা জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নামটি ব্যবহার করতে দিতে চাননি।
তিনি ১৯৭১ সালের কনসার্ট ফর বাংলাদেশ এর স্মৃতি নিয়ে আজীবন বেঁচে থাকতে চান। রবিশঙ্কর পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছি। তারা কেউ যুক্ত হতে চাননি। এটি আমাদের অপরাগতা।’
নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘এত বড় একটি আয়োজনের সঙ্গে থাকতে পেরে গর্ববোধ করছি। আমাদের এই আয়োজন আমেরিকা সরকারের সঙ্গে আরও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহযোগিতা করবে বলে বিশ্বাস করি। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে এসেছিলেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম. শহীদুল ইসলাম, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা।’
কনসার্ট সফল ও সার্থক করতে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে বাংলাদেশের সিটি গ্রুপ, ওয়ালটন, আবুল খায়ের স্টিল (একেএস), ইউনাইটেড গ্রুপ, বিকাশ, দারাজ এবং এডিএন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল এ আয়োজন নিউইয়র্কে বসবাসরত পাঁচ লাখ বাঙালির মাথা উঁচু করেছে। তাই অনেক বাঙালি কনসার্ট শেষে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন থেকে বের হয়ে মধ্য ম্যানহাটনে গলা ছেড়ে স্লোগান দিয়েছে ‘জয় বাংলা’ বলে।