ওয়েলকাম টু দ্য ট্রাম্পল্যান্ড

বোস্টন এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সপরিবারে একটা ছবি তুললাম, আর সেটা প্রকাশ করলাম ফেসবুকে, গুড আফটারনুন, বোস্টন। এরপর অন্তত তিনজন বন্ধু আমাকে লিখলেন, ওয়েলকাম টু দ্য ট্রাম্পল্যান্ড।

আমেরিকায় এটা কি সবচেয়ে চালু কৌতুক?
আমাকে একজন তরুণ বাংলাদেশি আমেরিকান আড্ডার ছলে জিজ্ঞেস করলেন, বাংলাদেশে ট্রাম্পকে নিয়ে কী ভাবা হচ্ছে?
আমার মেয়ে জবাব দিল, বাংলাদেশে এটা নিয়ে কেউ খুব কেয়ার করছে না।

এবার বোস্টন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে কী রকম ব্যবহার করবে, তা নিয়ে খানিকটা উদ্বিগ্ন ছিলাম। গত মার্চ মাসে যখন এসেছিলাম, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার প্রকাশনা উৎসবে অংশ নেব বলে, হাতে কোনো কাগজ ছিল না। ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন, কেন এসেছ। যেই বলেছি, আমাদের পত্রিকার উত্তর আমেরিকা এডিশন বেরোবে, তখনই বলে ফেললেন, তাহলে তো এই ভিসায় হবে না। আমি বললাম, আমি চাকরি করতে আসিনি, অনুষ্ঠান করতে এসেছি। তখন বললেন, প্রোগ্রাম কই। আমি বললাম, মোবাইলে আছে। বললেন, খোলো, মোবাইল খুলে ই-মেইল দেখালাম, আমার অনুষ্ঠান আছে, আমি বক্তৃতা দেব, দেখে তারপর ছেড়েছিলেন। এবার আবার কী বলে না বলে।
কিন্তু এবার এত সুন্দর আর মোলায়েম ব্যবহার করলেন ইমিগ্রেশন অফিসার যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।
কাজেই আমার বন্ধুদের মন্তব্য ‘ওয়েলকাম টু দ্য ট্রাম্পল্যান্ড’ এখনো আমার জন্য প্রাসঙ্গিক হয়নি।
বোস্টনে গাড়ি নিয়ে ঘুরছি, আরেক নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশি হাত তুলে দেখাল, এখানে ডানপন্থীদের ফ্রি স্পিচ সমাবেশ ছিল। পরে বোস্টনের লিবারেলরা হাজার হাজার জড়ো হয়ে তাদের ম্লান করে দিয়েছিল। জায়গাটা দেখলাম। ইন্টারনেটে সার্চ করে জেনে নিলাম ওই প্রোটেস্ট আর কাউন্টার-প্রোটেস্টের খবর। দেখলাম, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একবার টুইট করেছেন। বলছেন, বোস্টনে দেখা যাচ্ছে পুলিশবিরোধী অনেকে আছে। পরে টুইট করে বলেছেন, বোস্টন দেখিয়ে দিল, তারা ঘৃণার পক্ষে নয়। বর্ণবাদের পক্ষে নয়। অ্যান্টি সেমিটিজমের পক্ষে নয়।
ট্রাম্পের এই টুইটটা পড়লে মনে হবে, তিনি নিজেই এখন লিবারেলদের হয়ে প্রচার করতে নেমেছেন।
ভদ্রলোক কি একটু পরপর টুইট করেন?
আমেরিকায় এসেছি মাত্র দুদিন হলো, কাজেই আমেরিকা সম্পর্কে আমি যদি আপনাদের কিছু বলি, তাহলে তা মায়ের কাছে মামাবাড়ির গল্প বলার মতো হবে।
বরং দেশের খবর কিছু বলতে পারি।
বন্যা দেখা দিয়েছে। বেশ বড় ধরনের বন্যা। কিছু কিছু ত্রাণকাজ চলছে। সমাজের নানা অংশও তৎপর হয়েছে। আমার নিজের ধারণা, বন্যায় যাঁরা কষ্ট পাচ্ছেন, তাঁদের বড় সহায় এবার হবে যোগাযোগের উন্নতি, বিশেষ করে মোবাইল ফোন আর বিকাশ। চরের মানুষেরা অনেকেই ঢাকায়, চট্টগ্রামে বা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেন, তাঁদের পরিবারের কাছে টাকা পাঠাবেন তাঁরা। প্রবাসীরাও নিশ্চয়ই টাকা পাঠাবেন স্বজনদের কাছে।
দুই. ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় এবং সরকারের প্রতিক্রিয়া নিয়ে রাজনীতি সরগরম।
তিন. ঈদ আসছে। বাংলাদেশে ঈদ দোসরা সেপ্টেম্বর।
আমরা ঢাকা হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আসি ২৪ আগস্ট রাতে। বৃহস্পতিবারের রাত। বিমানবন্দরের কাছের গোল চত্বরে গাড়ি আটকে থাকল এক ঘণ্টা। গাড়ি থেকে নেমে পুলিশকে জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি বিমানবন্দরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? পুলিশ বলল, টার্মিনালের দোতলায় গাড়ির জট। কোনো গাড়ি বিমানবন্দর থেকে বেরোতে পারছে না। কারণ, ময়মনসিংহ সড়কে প্রচণ্ড ভিড়। বুঝলাম, ঈদ উপলক্ষে মানুষ ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। প্রচুর বাস দেখলাম রাস্তায়।
আমরা এক ঘণ্টা গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরের কাছের গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখলাম, অনেক যাত্রী, দেশি-বিদেশি, নারী-পুরুষ, বড় বড় স্যুটকেস টানতে টানতে হেঁটেই চলেছেন বিমানবন্দরের দিকে।
ছোট একটা দেশ। এত মানুষ। পরিস্থিতি সামলানো আসলেই কঠিন।
প্লেনে যখন উঠে পড়লাম, কোনো আসন খালি তো দেখলাম না। এই ভিড় ঠেলে সবাই এসে পৌঁছেছেন। মনে প্রশ্ন দেখা দিল, দেশটা আসলে চলছে না, আবার দেশটা ঠিকই চলছে। কত চড়াই-উতরাই পেরিয়েও মানুষ ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে।
একজন বিদেশি একবার আমাদের প্রথম আলো অফিসে এসে বলেছিলেন, আসলে তোমাদের এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেও একটা শৃঙ্খলা আছে। তা না হলে সবাই তো সারা রাত রাস্তাতেই থাকত। তা তো থাকে না। ঠিকই বাড়ি ফিরে যায়।
বোস্টন এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এলেন ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডাক্তার রুহুল আবিদ। তিনি বললেন, আমি টানেলের মধ্যে ৪৫ মিনিট বসে ছিলাম। গাড়ি একদম নড়ছিল না। টানেলে আটকা পড়লে তো আর কিছুই করার থাকে না।
আমেরিকা চলে নিয়ম দিয়ে, বাংলাদেশ চলে নিয়ম ছাড়া। দুটোই কিন্তু চলে।
ভাবি, বাংলাদেশে যদি শৃঙ্খলা আনা যায়, তাহলে কী রকম সুন্দরভাবে চলত দেশটা।