ও বন্ধু আমার

শুধু ১৯৮৯–এর বন্ধুদের নিয়ে কিছু লিখব লিখব করছি কয়েক দিন থেকে। সবে বন্ধু দিবস গেল। সব বন্ধুকে নিয়ে লিখতে গেলে একটা উপন্যাস হয়ে যাবে। তাই ’৮৯ গ্রুপ নিয়েই লিখে গেলাম আজকে।

বুঝে না বুঝে ছোটবেলা থেকেই আমি একটু বজ্জাত গোছের। খুব ছোটবেলায় আম্মি পাশের বাসার বুলবুল আন্টির কাছে আমাকে রেখে কলেজে যেতেন। প্রায়ই বুলবুল আন্টি ভাত খাওয়ানোর সময় আরেকটু আনতে গেলেই আমি হাঁটা দিতাম, কলোনির যার বাসায় ইচ্ছা তার বাসায়। বিকেলে আম্মি এসে খুঁজে বের করতেন। কীভাবে, তা জানি না। কোনো একদিন সহপাঠী একজনের বাসায় হাজির হলাম। আন্টি জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাসায় বলে এসেছি কি না। এত ঘন ঘন মাথা নেড়েছি, পালানোর কথা কেউ কল্পনাও করবে না। অতঃপর বিকেলে আম্মির আম্মুজান বাচ্চা বলে বাসায় নিয়ে যাওয়ার সময় আন্টির হতভম্ব চেহারার কথা মনে করে এখন কিঞ্চিত খারাপ লাগছে। আমি কিন্তু একই বাসায় দুইবার যেতাম না।

ওপরের বাসায় থাকত সুজন। প্রতিদিন ওদের বাসায় যেতাম খেলতে, সুজন থাকত নানির কাছে। আম্মির নিষেধ ছিল, চা যাতে আমাকে কিছুতেই খেতে দেওয়া না হয়। আমার করুণ চেহারার কাছে পরাস্ত হয়ে সুজনের কান্নাকাটিতে ওর নানির কাছ থেকে চা আমি ঠিকই পেতাম। বাসায় ভাব করতাম, জীবনে চা খাইনি। অতঃপর একদিন আম্মির চায়ের কাপের তলানিটুকু চোখ বুজে খেয়ে চোখ খুলতেই হাতেনাতে ধরা খেয়েছি। যে বকাটা খেয়েছিলাম, সেটুকু নাইবা বললাম। শুধু এতটুকু বলে রাখি, বাগানে প্রজাপতি বা ফড়িং ধরার আইডিয়া সব সময়ই আমার ছিল, সুজনের না। আম্মি এখনো সে কথা জানে না। সুজন, এই গ্রুপে তুই থাকলে মাফ করে দিস কিন্তু।

একটু বড় হতেই কলোনির মাঠ দখল নিয়ে এই ব্যাচের একজনের সঙ্গে মোটামুটি শত্রুতা হয়ে গেল। আমাদের কলোনিতে দুটি মাঠ ছিল। বড় মাঠে বড় ছেলেরা ফুটবল খেলত, ছোটদের বরাদ্দ মাঠে ’৮৯ ব্যাচের বন্ধুবেশী শত্রু ছিল লিডার। সে গরমের দিনে মাঠ ছেড়ে দিত বিকেল ৪টায় আর শীতের দিনে মাঠ ছাড়ত সন্ধ্যা ৬টায়। যখন গরমে হয় খেলা শুরু করা যেত না অথবা আজানের কাছাকাছি সময়ে খেলার আর সময় থাকত না। কত সহ্য হয় এই অবিচার। তাই কোনো এক শীতের বিকেলে বলে দিলাম, গরমের বরাদ্দ সময় ৪টাতেই এই মাঠে আমরা খেলব। ছেলেরা যেন ৬টায় আসে। ’৮৯ ব্যাচের বন্ধুবেশী শত্রু কি আর সে কথা শোনে? ফলে ওরা ফুটবল আর আমরা বুড়ি চিঁ খেললাম একসঙ্গে। কয়েকটা মেয়ের গায়ে বল লাগার পর ঘোষণা দিলাম, আমার গায়ে বল লাগলে কিন্তু খবর আছে। যথারীতি এক পিচ্চি ছেলে গোলের আশায় দিল বলের বাড়ি আমাকে। তাকে উত্তমমধ্যম দিয়ে নিজেও কয়েক ঘা খেয়ে বাসায় ফিরেছিলাম। ঘটনাটা ঘটেছিল আম্মির সামনে। তারা বান্ধবীরা সামনের রাস্তায় হাঁটছিল। যাক, সেদিনের পর থেকে কী সমঝোতা হয়েছিল মনে নেই, তবে আগে এলে আগে মাঠ পাবে জাতীয় কিছু ছিল বোধ হয়।

মাঝেমধ্যে মাঠ না পেলে সাইকেল চালাতাম বিরস বদনে। সাইকেল ছিল একটা, আমার আর ভাইয়ের, সাইজে বড়। কোনো একদিন কিছু বিচ্ছু ’৮৯ গ্রুপের ছেলে দেখে উল্টো পথে ঘোরার চেষ্টা করতেই খেলাম রাস্তায় আছাড়। বিচ্ছুদের হাসি মনে হয় এক মাইল দূর থেকে শুনলাম। পাত্তা না দিয়ে সাইকেলে উঠে তাড়াতাড়ি চালাতে গিয়ে এক চাচা–চাচির গায়ে তুলে দিলাম সাইকেল। ঠিক আমার বাসার সামনে। যথারীতি আব্বু–আম্মি বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন। আম্মি বলেই ফেলল, ‘এত বাঁদরামি করার কী দরকার? তোর জ্বালায় মানুষ কি একটু হাঁটতেও পারবে না?’

কলেজে গিয়ে দুজন বন্ধু চুরি করে কবিতা আর কাঁঠালিচাঁপা ফুল দিত ব্যাগে। দুজনই আজও দাবি করে, ফুলগুলো তার নিজের সংগ্রহ। একজন অন্তত স্বীকার করে ফেল, তুই শুধু কবিতা দিতি। তারপর স্যারের বিড়াল দিয়ে তোদের একজন অনেক ভয় দেখিয়েছিস প্রাইভেট পড়ার সময়। তোরা তো কেউকেটা একেকজন এখন। দেব নামটা ফাঁস করে?

কলোনির ওই ফ্রেনেমি (ফ্রেন্ড+এনিমি) কলেজেও পড়েছে আমার সঙ্গে। একদিন শুনলাম, আমাদের কয়েকজনের নামে সে কবিতার বই বের করেছে, একটা লাইন এখনো মনে আছে, ‘বাহিরেতে ওমুকতমুক, দুধের মতো সাদা ভিতরেতে চৌদ্দ কোটি শয়তানের দাদা’
তত দিনে ডিবেট চ্যাম্পিয়ন হয়ে আমার একটু কিঞ্চিত দাম হয়েছে। চৌদ্দ কোটি শয়তানের দাদা শুনে রীতিমতো প্রেসটিজে লেগে গেল। কী করি কী করি…স্যার চলে যাওয়ার পর ‘ইতর অমুক’ বোর্ডে লিখে বাসায় চলে গেলাম। আব্বুর কাছে হাপুস নয়নে কাঁদলাম ওমুক আমাকে চৌদ্দ কোটি শয়তানের দাদা বলেছে। অতঃপর আব্বু ফ্রেনেমির ভাইকে জানাল এবং পরদিন কলেজে গিয়ে দেখি, পুরো কলেজে আমার বান্ধবীর নামের আগে ইতর লিখে ভরে ফেলা হয়েছে। ভাইয়ের কাছে ঝাড়ির ভয়ে বোধ হয় আমাকে সে আর ঘাঁটায়নি।

মেডিকেলে থেকেছি হোস্টেলে। যে পরিমাণ ভালোবাসা আমার মতো সামান্য মানুষকে তোরা দেখিয়েছিস, তা তুলনাহীন। লেখাটা পুরোপুরি মজা করে লেখা। তাই স্কুল–কলেজ–মেডিকেলজীবনে ফেরেশতারূপী বন্ধু–বান্ধবীর কথা আজকে লিখব না।

মেডিকেলে গিয়েই কমন রুমে থাকতে হয়েছিল আমাদের ফাস্ট ইয়ারের শুরুতে। প্রতিদিন আয়োজন করে কাঁদতে বসতাম আমি বাসার সবার কথা মনে করে। একদিন এক মেয়ে এমন ধমকাল, ‘অ্যাই তুমি সারা দিন কাঁদো কেন? আমাদের কষ্ট লাগে না? খারাপ লাগলে যাও বাসায় যাও।’ থতমত খেয়ে কান্নার পরিমাণ কিঞ্চিত কমিয়েছিলাম মনে হয়।

স্কলারশিপের ২ হাজার ৮০০ টাকা পেয়ে ফাস্ট ইয়ারে ৪ বান্ধবী মুহূর্তে আড়ং গিয়ে একই জামা কিনে ফেললাম। সব জায়গায় একই জামা পরে যেতাম। কী ফূর্তি। আমরা এখনো বোনের মতোই আছি। কোনো এক বৃষ্টিমুখর দিনে খুব গান শুনতে ইচ্ছা করছিল। তোরা কারও কাছ থেকে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ধার করে ঠিকই সারা রাত গান শোনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলি। ওই দিনের বৃষ্টির ছন্দে গান শোনা আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়ের কিছু অংশ।

কিছুদিন পর রুম পেলাম এক্সটেনশনে। চারতলায়। ওপরে ছাদ। তত দিনে একটা ক্যাসেট প্লেয়ারের মালিক হয়েছি আমি। সিনিয়র আপুরা ছাদে পড়তে যেত, যাওয়ার আগে বলে যেত, তোমরা প্লিজ গান জোরে শোনো না। তারা ছাদে যেতেই বিকট শব্দে ‘রূপ তেরা মাস্তানা, পেয়ার মেরা দিওয়ানা’ বাজিয়ে দিতাম। দৌড়ে এসে বকা দিতেও তো সময় লাগত।

এক্সটেশনে সবাই নিলে ছাদে উঠতাম। তিনটা–চারটা পর্যন্ত গান আর আড্ডা। পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছিস এখন তোরা। হয়তো আবার দেখা হবে কোনো এক জ্যোৎস্নারাতে।

এ দেশে এসে কাজে জয়েন করে আমার বজ্জাত স্বভাবের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমাদের ব্যাচমেট এক ছেলেকে বললাম, হসপিটালে ইঁদুরের উপদ্রব হয়েছে খুব। বলেই গিফট শপ থেকে কেনা প্লাস্টিকের ইঁদুর ছেড়ে দিলাম। সে যে সেই টেবিলের ওপর লাফ দিয়ে উঠল, সেদিন আর নামল না। মাঝেমধ্যে কাজে অ্যাডমিশনের দায়িত্বে থাকি। এক ছেলেকে একদিন বললাম, ‘প্লিজ এসে অ্যাডমিশন করো, আমরা অনেক ব্যাক্ট আপ।’ সে বাসা থেকে এসে দেখে, কোনো পেশেন্ট নেই লগে। সে যে বাসায় চলে গেছে, আমি তো আর জানি না। সেদিন একজন বলেই বসল, ‘ফারহানার সঙ্গে কাজ আজকে, না জানি কি বিপদে পড়ি।’

’৮৯ গ্রুপের একজন আমার বাসার কাছেই থাকে, বউসহ আসে–যায় ঢাকা আর লং বিচ। ওদের বাচ্চাটা এ দেশে পড়ে। আমাদের বাসায় বেড়াতে এল একদিন ওরা। গেলাম বাইরে ঘুরতে। অত্যন্ত কনজাস্টেড পার্কিং লটে তাকে বললাম, ‘দোস্তো পার্ক করো। আমি পারব না।’ সে পার্ক করল। বেরিয়ে ফিরে আসার সময় পিলার আর গাড়ির মধ্যে অতি কম জায়গা থাকাতে প্রায় গাড়িতে উঠতে পারি না, এই অবস্থা। যাক, অন্যদিক দিয়ে গাড়িতে উঠে বসতেই তার বউ–বাচ্চা নিয়ে সে এমন হায়েনা হাসি হাসি শুরু করল। অতিষ্ঠ হয়ে বললাম, ‘যা তুই যদি এদিক দিয়ে গাড়িতে উঠে দেখাতে পারিস, তোকে ১০ টাকা দেওয়া হবে। বাঁদর আঁকাবাঁকা হয়ে ঠিকই উঠে বসল গাড়িতে। সেই থেকে ১০ টাকার আশায় আছে সে, দেব না বলার পরও। বাজিতে হেরে টাকা দিয়ে দেওয়ার মতো ভালো মানুষ আমি না। আরেকজন বেড়াতে এসে সাগরের পাড়ে প্যারালাল পার্কিং করা দেখে হাসতে হাসতে শেষ। কী যে করি। তোদের মতো ছোট থাকতেই গাড়ি দেখলেই দৌড়ে চালাতে বসার মতো ছ্যাঁচড়া স্বভাব কি আর আমাদের ছিল?

যাক, ছোট্ট থেকে তোদের/ তোমাদের সখ্যে এই যাপিত জীবন মন্দ না। সবাই খুব ভালো থেকো, ভ্যাক্সিন নিয়ো। হয়তো কোনো দিন করোনামুক্ত পৃথিবীতে দেখা হবে। বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা সবাইকে।