এরাই বিশ্বময় আলো ছড়াবে
স্থান: কিগালি, রুয়ান্ডা
তাঁর স্বামী একটি আইটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে ট্যাক্সি চালান তিনি। বেশ কিছুদিন থেকেই তাঁকে দেখছিলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে তাঁর অন্য সহকর্মীদের সঙ্গে বসে কাজের ফাঁকে আড্ডা দিচ্ছেন। কখনো তাঁর ট্যাক্সি ধোঁয়ামোছা করছেন। কখনো ট্যাক্সির স্টিয়ারিংয়ে বসে যাত্রী বহন করে চলেছেন। তাঁর সবকিছুই অতি স্বাভাবিকভাবে চলতে দেখে অনেক দিন থেকেই তাঁর সঙ্গে কথা বলব বলব করেও বলা হয়ে ওঠেনি। সেদিন হঠাৎই অফিসের গাড়িতে একটু সমস্যা হওয়ায় এক পরিচিতজনকে ফোন করে ট্যাক্সি পাঠাতে বললে, দেখা গেল তাঁকেই পাঠানো হয়েছে।
যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো অবস্থা। আমিও সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইনি।
আমাকে গন্তব্যে পৌঁছানোর পর তাঁর অনুমতি নিয়ে কথা বলা শুরু করলাম। এ পেশায় আসার কাহিনি জানতে চাইলে জানালেন, আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে ফিন্যান্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করে চাকরির জন্য অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। কোথাও চাকরি মেলেনি। হতাশ হয়ে যখন ঘরে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন, তখনই তাঁর মাথায় এই চিন্তা এল এবং স্বামীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে তাঁরও সম্মতি পাওয়া গেল। যে চিন্তা সেই কাজ। যেহেতু ড্রাইভিং জানা আছে, গাড়ি চালানোর লাইসেন্স আছে, সেহেতু ট্যাক্সি চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
প্রথমে ভাড়া করা ট্যাক্সিতে কাজ শুরু করলেন। তবে বর্তমানে নিজের কেনা গাড়িতেই তাঁর কাজ চলছে। স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার বেশ ভালো চলছে। কথা শেষে তাঁর অনুমতি নিয়ে একটা ছবি তুলে সেদিনই (গত বছরের ২৭ অক্টোবর) ফেসবুকে ‘কিগালি গার্ল’ শিরোনাম দিয়ে স্ট্যাটাস দিলে অনেকেই তাঁকে অভিনন্দন জানান।
পরেরবার দেখা হলে তাঁকে জানালাম, ‘আমি আপনার ছবি ও পেশা নিয়ে একটা লেখা ফেসবুকে দিয়েছিলাম। অনেক মানুষ আপনার প্রশংসা করেছেন এবং শুভকামনা জানিয়েছেন।’ তিনি মুচকি হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানালেন।
স্থান: ঢাকা, বাংলাদেশ
সূত্র: প্রথম আলো, ১৭ ডিসেম্বর ২০২১
নাম ভাবনা আক্তার। বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। স্বামী দিনমজুরের কাজ করেন। লেখাপড়াটা তেমন নেই বলা যায়। কাজ করলে দৈনিক ৪৫০ টাকা আয় করেন, কিন্তু কাজ না থাকলে আয় নেই। তাঁদের একটি মেয়ে গ্রামে দাদির কাছে থাকে।
ভাবনা আক্তার অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলেন। এ পেশায় আসার আগে একটি দোকানে কাজ করতেন, কিন্তু নানা সমস্যার কারণে পেশা বদলেছেন। বাসের সহকারী হিসেবে কাজে তাঁর দায়িত্ব হলো যাত্রী ওঠানো-নামানো এবং ভাড়া আদায় করা। তাঁর কথায় বোঝা গেল তিনি এ কাজে বেশ আনন্দ উপভোগ করছেন। মাসে বেতন পাচ্ছেন ও এর পরিমাণ বর্তমানে ১০ হাজার ৫০০ টাকা। করোনার শুরু থেকে দীর্ঘদিন বাস সার্ভিস বন্ধ থাকলেও তিনি মাসের বেতন মাসেই পেয়েছেন এবং এ নিয়ে কোনো ঝামেলাই হয়নি।
ভালো লেগেছে এটা জেনে যে তাঁর কাজ নিয়ে তাঁর স্বামী কখনোই আপত্তি করেন না ও বেতনের টাকার খরচ নিয়েও তাঁর কোনো সমস্যা নেই। তিনি আরও বললেন, গরিব মানুষ দুজনের টাকা মিলিয়েই সংসার চালান। আমি ভাবনা আক্তারকে গরিব বলতে একেবারেই রাজি নই। কারণ, তাঁর কাজ করার চ্যালেঞ্জ, তাঁর সরলতা তাঁকে ধনীদের চাইতেও ধনী বানিয়ে রেখেছে।
আমাদের দেশের বাস্তবতায় ভাবনা আক্তার যে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রায় চার বছর বাসচালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন, তা শুধু অসীম সাহসিকতারই বিষয় নয় বরং তিনি অসংখ্য যুবক-যুবতী, নারী-পুরুষের জন্য এক বিশাল উদাহরণ হিসেবেই জীবনভর বিবেচিত হয়ে থাকবেন। মিউতেছি এবং ভাবনা আক্তার দুই উপমহাদেশের দুই সাহসী নারী। একজন পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডার বাসিন্দা, আরেকজন দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশ বাংলাদেশের বাসিন্দা। গায়ের রং বা চলনবলনে ফারাক থাকলেও সাহসিকতার দিক থেকে দুজনের কোনো ফারাক নেই, বরং তাঁদের কর্মের মাধ্যমে তাঁরা বিশ্বব্যাপী অনেকেরই প্রেরণার উৎস হয়ে উঠবেন নিশ্চিতই।
মিউতেছি এবং ভাবনা, আমাদের স্যালুট গ্রহণ করুন।
*লেখক: জামিলুর রহমান চৌধুরী, কিগালি, রুয়ান্ডা