এভাবে জীবন খারাপ না!
২০১০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আমার ফ্রান্স আগমন দিবস। চলুন গল্পটা বলি, কি হলো সেই মহা আগমনের পরে। তার আগে একটা বেদ বাক্য শোনেন, দেশ থেকে শিখে আসা ‘তুমি একজন বাংলাদেশি, অতএব পৃথিবীর যেখানেই যাইবে, বাঙালি খুজিয়া লইবে’। আমিও সেই বেদবাক্য মাথায় নিয়ে আমার ফ্রান্সের জীবন শুরু করলাম।
দিন যায়, রাত যায়। মানুষ স্বপ্ন দেখে, পারলে অন্যকেও স্বপ্ন দেখায়। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। আমাকে স্বপ্ন দেখানো শুরু হলো। শোনো ইরফান ফ্রান্সে চলে আসছ এটাই বিশাল ভাগ্য। তারপর যদি এখানে স্থায়ী থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়, তাহলে তো তুমি রাজা। আমি বাধ্য ছাত্রের মত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলি, তারপর কি? তারপর, তারপর হলো একটা কাজ নিবা। দেড়-দুই লাখ টাকা বেতন পাবা, দেশে জায়গা জমি কিনবা, বাড়ি বানাবা। তারপর যেইটা করবা সেইটা হলো, একটা সরকারি বাসার জন্য আবেদন করবা। সবাইরে কিন্তু দেয় না, কাউরে কাউরে দেয়। তারপর দেশে যাবা, বিয়া করবা, পোলাপান হবে, লাল পাসপোর্ট করবা, তারপর ইংল্যান্ড যাবাগা। এইডা হইলো গিয়া তোমার স্বপ্ন, খাঁচায় ভইরা দিলাম বাসায় নিয়া পাইলা পুইসা বড় কর, যাও। কিন্তু...আবার কিন্তু কি? না মানে আমি চাইছিলাম একটা ভার্সিটিতে ঢুকব, কিছু পড়াশোনা করলাম, ঘোরাঘুরি করলাম...এই আর কি।
কিহ! তুমি কি ফরাসি? এই কালা চামড়া লয়া তুমারে কোন ভার্সিটিত নিব? আচ্ছা কিসু মন কইরো না ভাই। এই সমস্ত উল্টা পাল্টা কথা শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু শুনো ছুটু ভাই দেশে তোমার রেজাল্ট কি? এ-মাইনাস? এই রেজাল্ট লয়া বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় খাড়ানোর যোগ্যতা নাই, তুমি ফরাসি ভার্সিটি টাইনা আনো কোন আক্কেলে? আর ঘুরাঘুরি? ওই সব বহুত হুনছি। একটা বছর যাক এমনেই নেতায়া যাইবাগা। বয়স অল্প, তোমার মাথা ভর্তি শয়তানি...যাও যাও! তারপর আর কি, যাহা শুনিলাম তাহাই মানিব স্থির করিয়া কত কিছুইনা করিলাম। টাকা কামাইলাম, ইহা উহার পিছে দৌড়িলাম, কিন্তু মনের খোরাক পাইলাম না, মনঃকষ্টে ভুগিতাম প্রায়ই। একদিন সকাল বেলা ঘুম থাকিয়া উঠিয়া ক্ষিপ্ত কণ্ঠে মনে মনে বলিলাম তোমাদের ওই সব ‘বেদ বাক্যের’ গুল্লি মারি। আমি চলিব আমার স্বপ্নেরা যেই পথে চলে।
আজ আমি মানুষের সঙ্গে মিশি, জাতপাত, ধর্ম, বিদ্বেষ বাছবিচার না করে চলি অবিরত, কে ছোট আর কে বড়, কার কি পরিচয় এসব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে দেখার চেষ্টা করি। দেশে দেশে ঘুরি মানুষ দেখার জন্য তাদের ইতিহাসের কিছুটা হলেও ছোঁয়া পাওয়ার জন্য। এখন আমি জানি সবকিছুতেই ভারসাম্য মানে শান্তি আর সুখ। কিছুটা অর্থ সম্পদ, কিছুটা প্রেম, কিছুটা বিদ্বেষ আর অনেকটা জীবনানন্দ। এভাবে জীবন খারাপ না একেবারেই!