গর্জন করে ট্রাক থেমেছে বিশাল পার্কিং লটে। চালকের আসন থেকে নেমে আসা নারীকে দেখেই বুকের মাঝে গর্জন টের পাই। শ্বেতাঙ্গ সুন্দরী লোরেইন। প্রায় চার বছর পর। এমন এক আচমকা জায়গায় আবার দেখা হয়ে গেল!
শপিং মলের বাইরে তাঁবু খাটানো হয়েছে। করোনাকালের নতুন স্বাভাবিকতা। স্থানীয় কমেডি ক্লাব অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যায়। ঘণ্টাখানেক আগেই সবাইকে পৌঁছার সমন জারি করেছেন জর্জ। অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে প্রশস্ত অপেক্ষমাণ এলাকা। শুরু হয়েছে হালকা পানাহার।
বাফেলো উইংসের সঙ্গে পানীয় অর্ডার করা হয়েছে। খাবার পরিবেশনের অপেক্ষার মধ্যেই লোরেইনের আবির্ভাব।
চার বছর আগে পেডিংটন নামের একটি ব্রিটিশ ফরাসি সিনেমা দেখতে গিয়েছিলাম। লোরেইনের চাপাচাপিতেই যাওয়া। কৌতুকপ্রিয় লোরেইনকে সঙ্গ দিতে, নাকি সিনেমা দেখতে যাওয়া—এমন প্রশ্ন নিয়ে তর্ক হতেই পারে। অবশ্য তর্কটা এখন আর জরুরি নয়।
নিকোল কিডম্যান, কলিন ফার্থ, জুলি ওয়াল্টার যে দারুন অভিনয় করেছে, এ নিয়ে লোরেইনের বকবক শুনছিলাম।
–নিকোল কিডম্যানের মতোই সুন্দরী তুমি।
হলিউডের লোকজনের প্রচণ্ড বিরোধিতার পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পথে। হলিউডের লোকজন নিজেদের একটা বায়বীয় জগৎ সৃষ্টি করেছে। পশ্চিমা জগতে এরা নিজেদের যতটা প্রভাবশালী মনে করে, বাস্তবতাটা ভিন্ন। এসব বলে সেলিব্রিটি আর বায়বীয় চিন্তার লোকজনকে একহাত নেওয়ার সুযোগ নিলাম।
হঠাৎ লোরেইনকে প্রচণ্ড বিরক্ত হতে দেখা যায়।
–যুক্তিগুলো সব ট্রাম্পের অন্ধ সমর্থকদের মতো শোনাচ্ছে। হলিউডের লোকজন সম্পর্কে এমন ধারণা একদমই ঠিক নয়।
সিনেমা দেখতে এসে এমন একটা বিতর্কে জড়িয়ে পড়াটা ভালো হয়নি। আমেরিকায় কলেজজীবনের বন্ধু লোরেইন। সেদিনই বিচ্ছেদ হয়ে গেল। ফোন নম্বরটাও বদলে ফেলেছিল।
লোরেইনের শেষ বার্তা ছিল, ‘হোপ অ্যা বেটার লাইফ ইন আমেরিকা আন্ডার ট্রাম্প’।
মার্কিনরা এমন কত তুচ্ছ কারণেই সম্পর্কচ্ছেদ ঘটায়! কত তুচ্ছ কারণে এদের বিবাহ বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটে! শুনলে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
–ইব্বি, ট্রাক টার্ন করতে করতেই তোমাকে দেখছিলাম।
বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গনে লোরেইনের জুড়ি নাই। মোবারক আর জর্জের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।
লোরেইন কমেডি ক্লাবের অন্যতম পরিচালক। ট্রাক নিয়ে নগর–বন্দর ঘুরে বেড়ানোর কাজ এখন। কমেডি ক্লাবের মঞ্চ ব্যবস্থাপনাও তাকে করতে হয়। এসব কথা দ্রুত জানায়। কাজে নামতে হবে বলেই ত্রস্ত পায়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়।
নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া লোরেইন এখন কমেডি ক্লাব করে। যাওয়ার সময় ফোন নম্বর আগেরটাই আছে কি না জানতে চাই। এবার জর্জ একটা কাশি দিলেন।
–সুন্দরীরা এমনই হয়। লক্ষ্য করলাম ইব্বি, মেয়েটি তোমাকে তার ফোন নম্বরটি না দিয়েই চলে গেল!
এর মধ্যে শাহানা আর ফাতিমা চলে আসায় লোরেইনকে নিয়ে কথা আর এগোয়নি। এমন বিপদেআপদে পুরুষ জাতির মধ্যে একটা ঐক্য হয়ে যায়। নীরবতার এ ঐক্যের জন্য মনে মনে ধন্যবাদ জানাই জর্জ আর মোবারককে।
ফাতিমা জানালেন, টিকিট কিনতে গিয়ে একটি ফ্রি পেয়েছেন। চারটার সঙ্গে একটি ফ্রি। শাহানা মার্কিন কান্ট্রি কমেডি ক্লাবের কোন অনুষ্ঠানে আগে যাননি। প্রথমবারের মতো এ অভিজ্ঞতার সুযোগ করে দেওয়ায় ফাতিমাকে আবারও ধন্যবাদ জানালেন।
ফ্রি কথাটি ফাতিমার মুখে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জর্জ হাসতে শুরু করেছেন।
–মনে আছে ইব্বি কয়েক বছর আগের কথা? মোবারকের ফ্রি সেবা নেওয়ার উদ্যোগের কথা?
হাসতে থাকলেন মোবারকও। জর্জ ঘটনাটির বর্ণনা শুরু করেন। ‘ফ্রি’ কিছু পাওয়া যাচ্ছে শুনলেই মোবারক উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। ফ্রি খাবার, ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা, কাজকর্ম ছাড়া সপ্তাহ শেষে ফ্রি ভাতা!
একটি ভ্রাম্যমাণ গাড়িতে ‘ফ্রি’ ডিএনএ টেস্ট করা হচ্ছে শুনে মোবারক দৌড়ে গেছেন। স্যাম্পল দিয়ে এসে জানালেন, ২০০ ডলারেও এমন টেস্ট করা যায় না। ফ্রি পেয়েছেন বলে সুযোগটা নিয়েছেন। নিজের ডিএনএ বিশ্লেষণটা ফ্রি পেয়ে যাচ্ছেন!
–আরে বোকা! রেজাল্ট নেওয়ার দিন একদল লোক ‘ড্যাডি মোবারক’ বলে ডাক দেবে। তখন ফ্রি ডিএনএ টেস্ট করার মাজেজা বুঝতে পারবে!
–সে ভয় আমার নেই! সারা জীবন মুক্ত জীবনযাপন করেছ জর্জ। পুরো শহরে তোমার কত সন্তান নিজেই জানো না! সন্তানেরাও বাবার খোঁজ জানে না! যুক্তরাষ্ট্রের দশজন মানুষের একজন এমনই। তাদের বায়োলজিকাল জন্মদাতার পরিচয় নিশ্চিত নয়!
মোবারককে বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখা গিয়েছিল। ফলাফল সংগ্রহ করেছিলেন কি না, পরে আর জানা যায়নি। নতুন সপ্তাহের আড্ডায় পুরোনো ঘটনাটি চাপা পড়ে যায়।
জর্জ আবার মনে করিয়ে দিলেন আজ।
–জর্জ, ভিয়েতনামের যে শহরে যুদ্ধ করেছিলে, সেখানে গিয়ে তোমার ডিএনএ টেস্ট করাতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক অভিবাসনের তালিকায় যে আরও বেশ কিছু লোক যোগ হবে, এ আমি নিশ্চিত।
মোবারক বন্ধু জর্জকে আক্রমণ করে যেতে লাগলেন। ফাতিমাই প্রসঙ্গ থেকে উদ্ধার করলেন।
মার্কিন জনগণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর সবচেয়ে বিরক্ত তাঁর ভদ্রতা নিয়ে। এবারের বিতর্কে ট্রাম্প নিজেকে সংযত দেখিয়েছেন। কোন দুষ্টু ছেলে ভালো ব্যবহার করলে আমরা পিঠ চাপড়ে দিই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ কারণেই পিঠ চাপড়ে দেওয়া যায়। জো বাইডেন পরিচিত রাজনীতিবিদ। আমেরিকান সৌজন্য, সহমর্মিতা ও রাষ্ট্রনায়কদের মতো আচরণ ছিল তাঁর
–মি. জর্জ, ট্রাম্প ও বাইডেনের শেষ বিতর্কটি কেমন হলো? একজন খাঁটি মার্কিনের কাছ থেকেই তা শুনতে চাই।
–মার্কিন জনগণ ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর সবচেয়ে বিরক্ত তাঁর ভদ্রতা নিয়ে। এবারের বিতর্কে ট্রাম্প নিজেকে সংযত দেখিয়েছেন। কোন দুষ্টু ছেলে ভালো ব্যবহার করলে আমরা পিঠ চাপড়ে দিই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এ কারণেই পিঠ চাপড়ে দেওয়া যায়। জো বাইডেন পরিচিত রাজনীতিবিদ। আমেরিকান সৌজন্য, সহমর্মিতা ও রাষ্ট্রনায়কদের মতো আচরণ ছিল তাঁর।
গড়গড় করে মন্তব্য করলেন জর্জ। আলোচনা ক্রমশ ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে চলে যাওয়ায় বিরক্ত বোধ করছেন মোবারক। প্রসঙ্গ থেকে সরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন। বললেন, ৩ নভেম্বরের পর যুক্তরাষ্ট্র কেমন হবে?
–আমরা কেউ জানি না। ট্রাম্প বা বাইডেনও জানেন না। জাগ্রত জনতার রায় অনেক কিছুই পাল্টে দেবে। আবার হয়তো দেবেও না।
একটি বাক্য আমাদের শুনতে হবে বেশি। মাথা ঝুলিয়ে মুখ বাঁকা করে তারা বলবেন—‘বলেছিলাম না’!
আরেক দল চশমার কাচ ঘষতে ঘষতে ব্যাখ্যা করবেন, যা হওয়ার তা কেন হয়নি!
মিনমিন করে কেউ বলবেন, আমার সন্দেহের কথা আগেই পিন পিন করে বলে রেখেছিলাম!
এদের কেউ হারবেন না। বরাবরের মতোই হারবে জনতা। হেরে যাবে ভালোবাসা!
–সু, সপ্তাহান্ত কেমন কাটল আপনার?
মোবারক প্রসঙ্গ থেকে একেবারেই সরে যেতে চাচ্ছিলেন। শাহানা বললেন, তিনি রোববারে থাউজেন্ড আইল্যান্ডস ঘুরে এসেছেন।
নিউইয়র্কে থাউজেন্ড আইল্যান্ডস নামে একটা এলাকা আছে। ১ হাজার ৮৬৪টি দ্বীপ নিয়ে এলাকাটি। কানাডা সীমান্তের কাছাকাছি। প্রতিটি দ্বীপে আলাদা বাড়ি ঘর। আলাদা মালিকানা।
থাউজেন্ড আইল্যান্ডস দেখতে গিয়েছিলেন শাহানা। দ্বীপটির অবারিত ভূ-প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা করছিলেন।
হাসলে শাহানা না ফাতিমাকে সুন্দর দেখায়, পরখ করার চেষ্টা করছিলাম।
জর্জ হঠাৎ গুরুগম্ভীর হয়ে বললেন, বন্ধুদের তিনি একটি জরুরি খবর জানাতে চাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী নাতালিয়া ফিরছেন কিনা, এ নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। নাতালিয়া নাকি টেক্সট মেসেজ পাঠিয়েছেন, তিনি এখনই ফিরছেন না। জর্জকে যোগাযোগ না করতে বলেছেন। প্রয়োজনে নাতালিয়া নিজেই যোগাযোগ করবেন।
–এর মানে কী? কাঁপা গলায় শাহানার প্রশ্ন!
–মানে জটিল কিছু নয়। নাতালিয়া মার্কিন স্বামীকে বিয়ে করে নাগরিকত্ব চেয়েছিলেন। পেয়ে গেছেন। দেশে ফিরে গেছেন তাঁর সাবেক কোন বন্ধুকে বিয়ে করে আনতে। প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। ডাকযোগে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেবেন। এমন ঘটনা যে ঘটবে, আমি আগেই জর্জকে সাবধান করে আসছিলাম!
মোবারকই উত্তর দিলেন।
হালকা কথাবার্তার মধ্যে জর্জ তাঁর পারিবারিক বিপর্যয়ের কথা জানিয়ে দিলেন। মার্কিনরা পারেও! চেহারা দেখে ধারণা করার কোন উপায় নেই, মনে কী খেলা করছে!
ডিভোর্স লেটার আসলে কোন কন্টেস্টই করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—জর্জ জানালেন। নিজেকে হালকাই লাগছে। বন্ধনহীন মুক্ত মানুষ।
বলছিলেন, একজন সৈনিক কখনো ফিরে তাকায় না। বিয়েকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠান বলেই মনে করেন জর্জ।
কেউ কিছু বলছেন না।
জর্জ আমার চেনা তিন দশক ধরে। তাঁর জীবন দর্শন খুবই জোরালো। বিকারহীন এক সুখী মানুষ। এক নাতালিয়ার জন্য তাঁর মন ততক্ষণই কাঁদবে, যতক্ষণ নাতালিয়া পাশে থাকবে।
কারও মুখে কোন কথা নেই। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাচ্ছে। কমেডি ক্লাবের লোকজন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সবাইকে বসাচ্ছে। আলো–আঁধারের আবহ। মৃদুলয়ে গান বাজছে।
বন্ধুর কাছে বসে মোবারক যেন সংহতি জানাচ্ছেন। পাশাপাশি বসে আছেন শাহানা ও ফাতিমা। জর্জ আর মোবারকের বিমর্ষ বদন। অন্য দুই মুখ দেখতে গিয়েও কমেডি মিস করতে চাই না! ফাতিমা ও শাহানা দুজনই পাশে বসার অনুরোধ জানালেন।
কমেডি ক্লাবের একজন কর্মী একটি চিরকুট নিয়ে উপস্থিত। জানাল, এখানে আমার জন্য একটা বার্তা পাঠিয়েছেন অনুষ্ঠানের সহপরিচালক!
বুঝলাম, লোরেইনের চিরকুট।
‘Ibby, how is life under Trump's America? Get used to it!’
শো শুরু হবে মিনিট দু-একের মধ্যে। হঠাৎই খেয়াল হলো মৃদুলয়ে গানটি বাজছে!
I used to reach for you when
I got lost along the way
I used to listen
You always had the just right thing to say
I used to follow you
Never really cared where we would go
Fast or slow
To anywhere at all
We used to have this figured out
We used to…
ক্রিস ডাউট্রির গান। অনেক দিন পর শুনলাম। লোরেইনের প্রিয় গান!