ভিডিওটি দেখা ইউটিউবে। কে নির্মাণ করেছেন, মনে রাখতে পারিনি। দুই শ্বেতাঙ্গ তরুণী। তাদের একজন ক্যামেরার সামনেই বোরকা পরে নিল। লোকেশন সম্ভবত কোনো এক টার্মিনাল। তারপর এক তরুণী ব্যাকপ্যাক বা হাতব্যাগ নিয়ে টার্মিনালের বিভিন্ন প্রান্তে বসা অপেক্ষমাণ বিভিন্ন যাত্রীর কাছে গিয়ে অনুরোধ করছে, সে রেস্টরুমে যাবে। অল্পক্ষণের জন্য ব্যাগটি কি তারা রাখতে পারবে? সবাই তার অনুরোধ রাখল। পরের দৃশ্য: বোরকা পরিহিত তরুণীটি একই ব্যাগ নিয়ে চার-পাঁচজনকে এক এক করে অনুরোধ করল, কেউ-ই তার ব্যাগটি রাখল না। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করল। কেউ বলেন, ভিডিওটি মুসলমানদের হেয় করা অথবা ভীতি সঞ্চারের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। আবার কেউ বলেন, চলমান বাস্তবতাই তুলে ধরা হয়েছে। মুসলমান সম্পর্কে যে ভীতি পশ্চিমাদের মনে কাজ করছে, তা-ই ফুটে উঠেছে এতে।
ওই যেমন বলা হতো প্লেনে বা ট্রেনে কোনো যাত্রায় কেউ যদি জানতে পারে তার পাশের যাত্রীটি একজন মুসলমান, এক অজানা অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে যাত্রীটি।
মনে পড়ে দুটি ঘটনা। সম্ভবত ২০০৪ সাল। আমি তখন বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। শেখ হাসিনা ফ্লোরিডায় তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদের বাসায় অবস্থান করছেন। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারের জন্য আমরা আবেদন করলে তিনি সম্মতি দেন। শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য আমি ও নির্বাহী সম্পাদক আবু তাহের (বর্তমানে সম্পাদক) রওনা হলাম ফ্লোরিডায়। নিউইয়র্কের লা-গোর্ডিয়া এয়ারপোর্টে পৌঁছে স্পিরিট এয়ারলাইনসের কাউন্টারে বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। হাই-হ্যালোর পর তাহের কাউন্টারের তরুণীটিকে অনুরোধ করল, সামনের দিকের দুটি আসন যেন সে আমাদের দেয়। তরুণীটিও অপূর্ব হাসি ঝরিয়ে দুটি বোর্ডিং পাস তাহেরের হাতে তুলে দিয়ে বলল, যাত্রা শুভ হোক। প্লেনে ঢুকে সিট খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে পেলাম সর্বশেষ সারির দুটি আসন আমাদের ভাগ্যে জুটেছে। আমাদের কারও মুখে কথা নেই। শুধু একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। কিছুক্ষণ পর প্লেনটি যাত্রা শুরু করল। সম্ভবত ইঞ্জিনটি ছিল আমাদের দুটি আসনের পাশেই। সে কী বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা। আমাদের গ্রামের রাইচমিলের যে আওয়াজ, সেই একই আওয়াজ। থেমে থেমে গুড়গুড় বিশ্রী শব্দ। মুখ খুললাম, মেয়েটির হাসি যে এত বেদনার তা কি জানতাম? অবশ্য নিউইয়র্কে ফেরার পথে কোনো অনুরোধ না করায় মধ্যভাগের দুটি আসন জুটেছিল।
আরেকবার, সাল মনে নেই। সম্ভবত ডালাসে যাচ্ছি। কাউন্টারে টিকিট ও পরিচয়পত্র দিলাম। ভদ্রলোক আমার পরিচয়পত্র দেখে বললেন, আপনি পাশে অপেক্ষা করুন। এই বলে পাশের অপর এক কর্মচারীর হাতে আমার পরিচয়পত্রটি তুলে দিলেন। তিনি সেটা নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। দেখলাম, লাইনে আমার পেছনের যাত্রীরা দ্রুত একের পর এক বোর্ডিং পাস নিয়ে চলে যাচ্ছেন। আর আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষায়। বুঝতে অসুবিধে হয়নি, এটা আমার নামের ফসল। দশ-পনেরো মিনিট পর ভেতর থেকে এলেন ওই কর্মচারী, হাতে আমার পরিচয়পত্র। তারপর পেলাম বোর্ডিং পাস।
আমার মনে অনেক প্রশ্ন। শতকোটি মুসলমানের মতো আমিও একজন সাধারণ মুসলিম। শান্তিপ্রিয়। জঙ্গিবাদকে ঘৃণা করি। ধর্মীয় র্যাডিক্যালিজমের নিন্দা করি। মানবতার জয়গান গাই। এই আমি এখানে এলাম কী করে? আমার মুসলমান পরিচিতিতে কে কালিমা লেপন করল? আমার ভাবমূর্তির এই সংকট কী করে সৃষ্টি হলো? অ-নে-ক প্রশ্ন। কেন হলো, কেমন করে হলো, কী এর কারণ, কারা দায়ী? মুসলমানরা নিজে? অথবা অন্য কেউ? দায়ী কি উগ্রতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, অবিচার, শোষণ? না কি ষড়যন্ত্র? আমি উত্তর খুঁজি। উত্তরও আসে। ডজন ডজন। কোনটি সঠিক বুঝে উঠতে পারি না। সমাধানও জানি না। তাই ভুগি। যন্ত্রণায় দগ্ধ হই। অসহায়ত্ব প্রকাশ করি।
চিন্তায় নতুন খোরাক পাই, যখন শুনি, আইএস জঙ্গিদের নিষ্ঠুর-নির্মম পৈশাচিকতার বলি যারা, তাদের অধিকাংশই মুসলমান। নাইন ইলেভেনে টুইন টাওয়ারে অনেক মুসলমান নিহত হয়েছে। সালাউদ্দিন, নুরুল হক দম্পতিসহ ছয়জন বাংলাদেশিও ছিলেন। তাহলে প্রশ্ন, এরা কারা? মুসলমান মুসলমানকে এভাবে হত্যা করে? এরা তো মুসলিম নয়, মানুষও নয়। মানুষরূপী পশু।
লেখক নিউইয়র্কপ্রবাসী সাংবাদিক