একুশের চেতনা ও বিশ্বে সাংস্কৃতিক কূটনীতির অনুশীলন
বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশের ভাষা ও সাংস্কৃতিক পদ্ধতির নিজস্ব একটি অবস্থান গড়ে তোলার সুযোগ বারবার যেন হাতছাড়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হলো ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তা প্রচারের জন্য বিশ্বব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত একটি বার্ষিক পালন। বিশ্বব্যাপী ভাষা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বহুভাষিকতার সচেতনতা বৃদ্ধি করার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন বাংলাদেশ। বাংলাদেশেরই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এ দিবসের পটভূমি হলো ১৯৫২ সালে বাংলা ও উর্দু ভাষার বিতর্কের কারণে বাংলাদেশে চার তরুণ ছাত্র বিক্ষোভের সময় নিহত হয়েছিলেন। এ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এবং বহু বছরের অস্থিরতার পর জাতিসংঘের শিক্ষাগত বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে একটি বার্ষিক অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা সারা বিশ্বে উদ্যাপিত হয়। বাংলাদেশের জন্য তা এক ঈর্ষণীয় গৌরবের বিষয়। বাংলাদেশের বাঙালি জাতিসত্তায় গলে যাওয়া পাত্রের মতো আমাদের সংস্কৃতি। এর রয়েছে মিশ্র সংস্কৃতি। এর স্থাপত্য, নৃত্য, সাহিত্য, কবিতা, নাটক, সংগীত এবং চিত্রকলার শিকড় ও ঐতিহ্য ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত। দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেক বৈচিত্র্যের একটি সুখী সংমিশ্রণ।
ইউনেসকো ২০২২ সালের জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের একটি থিম নির্ধারণ করেছে, ‘বহুভাষিক শিক্ষার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ’। বহুভাষিক শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে এবং সবার জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষা ও শিক্ষার বিকাশে সহায়তা করতে প্রযুক্তির সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হবে এবারের উদ্যাপনে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় কানাডার তার পরিচয়কে বিকশিত করতে ও রাষ্ট্রের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সাংস্কৃতিক বিনিময় শুরু করে ছিল। বিশেষ করে কানাডার পারফর্মিং আর্ট এবং সরকারি ও বেসরকারি খাতগুলোকে উপস্থাপনের সুযোগ তৈরি করা ছিল এর উদ্দেশ্য। কানাডার সাংস্কৃতিক উদ্যোগ সে সময় যেমন একটি জাতিগঠনের উদ্দেশে সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করেছে, তেমনি বাংলাদেশেরও এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাজ করার অনেক ইস্যু রয়েছে। কানাডিয়ান সাংস্কৃতিক কূটনীতির অনুশীলনের মতো বাংলাদেশেরও সে সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশে ভাষানির্ভর তথ্য ও প্রযুক্তি আজ শিক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসেছে, যা আমাদের মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং সবার জন্য ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আজীবন শিক্ষার সুযোগকে নিশ্চিত করার প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করতে হবে। যদি এটি অন্তর্ভুক্তি এবং সমতার মূল নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়, তবে মাতৃভাষাভিত্তিক বহুভাষিক শিক্ষার এটি একটি ভালো উপাদান হবে আধুনিক প্রযুক্তি।
একুশের চেতনাকে সামনে রেখে বিশ্বে সাংস্কৃতিক কূটনীতির অনুশীলন শুরু করতে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জোরদার করতে পারে বাংলাদেশ। যেমন: এক্সপো, ওয়ার্ল্ড ফেস্টিভ্যাল অব আর্টস এবং আন্তর্জাতিক ও গার্হস্থ্য সাংস্কৃতিক সম্পর্কের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে আসতে পারে বিনোদন। আধুনিক কূটনীতির ওপর অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (মে ১৯৯৭) ড. জর্জ এফ ভেলার উদ্বোধনী ভাষণে কূটনীতিকে প্রভাবিত করে, এমন আধুনিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রধান কিছু পরিবর্তনকে চিহ্নিত করেন। এটি আঞ্চলিক সহযোগিতা, প্রতিরোধমূলক কূটনীতিসহ বিভিন্ন বর্তমান উদ্বেগের ওপর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। ড. ভেলা মানবসমাজে সমস্যা সমাধানের একটি পদ্ধতি হিসেবে কূটনীতি এবং পেশা হিসেবে কূটনীতির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তা প্রায়ই উপেক্ষিত বলে জানান। যদিও কূটনীতি মানবসমাজে, বিশেষ করে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ককে সামঞ্জস্য করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি ছিল, আছে এবং থাকবে, একটি পেশা হিসেবে কূটনীতি বেসরকারি সংস্থা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং অন্যান্য যারা দ্রুত কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জন করছে, তাদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা আশা করতে পারে। আধুনিক কূটনীতির প্রবণতা ও পরিবর্তনশীল প্রকৃতির ওপর আলোকপাত করেন অধ্যাপক পল শার্প। তিনি আধুনিক কূটনীতির দুটি প্রবণতার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন: একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার লক্ষ্যে ক্রমবর্ধমান প্রাতিষ্ঠানিক বহুপাক্ষিকতাবাদ এবং ‘কূটনীতিকদের তাঁদের দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখার প্রবণতা এবং তাঁরা যাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তার চেয়ে ভালো তাঁরা যে কাজগুলো করেন।’ এ উভয় প্রবণতাই সার্বভৌম রাষ্ট্রের পেশাদার প্রতিনিধি হিসেবে কূটনীতিকদের তাঁদের ভূমিকা থেকে কিছুটা হলেও দূরে সরিয়ে দেয়।
একুশের চেতনা ও বিশ্বে সাংস্কৃতিক কূটনীতির অনুশীলনের শুরু হতে পারে এখনই। আমরা বাঙালি, ভাষার জন্য রক্ত ঢেলে দিয়েছি। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘদিন সংগ্রাম করে ১৯৭১-এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় প্রথম ভাষণ দিয়ে জানান দিয়েছিলেন আমাদের বাঙালি জাতিসত্তার। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষা আজ মর্যাদার আসনে আসীনের পথ ধরে বাঙালির রাজনৈতিক-সংস্কৃতির প্রতি মানুষের আগ্রহ, বোঝাপড়া ও উপলব্ধিকে অনুপ্রাণিত করার জন্য; নতুন প্রজন্মকে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সংলাপে যুক্ত করার জন্য; বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি শক্তিশালী ও ইতিবাচক জাতি হিসেবে তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিকল্প নেই।
লেখক: দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা।