একটি চলচ্চিত্রের ব্যবচ্ছেদ: সখী, ভালোবাসা এরে কয়

‘বেলাশেষে’ ছবিতে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম আলোর ফাইল ছবি
‘বেলাশেষে’ ছবিতে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রথম আলোর ফাইল ছবি

এক বয়স্ক প্রকাশক। তাঁর সঙ্গে একদিন দেখা করতে এলেন অস্থির-উদ্‌ভ্রান্ত এক নারী। ওই নারীর স্বামী একজন লেখক ছিলেন। লেখক ভদ্রলোক হঠাৎ মারা গেছেন। ভদ্রমহিলা অথই পাথারে পড়েছেন। কারণ, তাঁর জানা নেই স্বামীর কাজকর্মের নমুনা ও প্রাপ্তির সীমানা। কার কাছে কী পাওনা, কিছুই জানেন না স্বামীহারা ওই নারী।

বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে বসা প্রকাশকের হঠাৎ আবার চোখে পড়ল সেই নারীকে। অসহায় ও বিচলিত নারীর চেহারা। এলোমেলো পা ফেলে হেঁটে যাচ্ছেন। একা। সেই চেহারা প্রকাশককে গভীর ভাবনায় ফেলে দিল।

এদিকে বাড়িতে ফিরে প্রকাশক দেখেন, তাঁর স্ত্রী মগ্ন গৃহস্থালিতে। প্রায় ৫০ বছরের জীবনসঙ্গিনী এই নারী। যিনি কখনো নাতির দেখভালে, আবার কখনোবা টিভি সিরিয়াল দেখা নিয়ে মেতে থাকেন। আজ স্ত্রীর ওপর বিরক্তি ঢাললেন প্রকাশক।

কী ঘটল ভদ্রলোকের মনে? কী কারণে তিনি স্ত্রীর ওপর বিরক্ত? কেন আজ তাঁর স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণা?

বিবাহিত জীবন তাঁদের ৫০ বছরের। আজ অবধি তাঁর স্ত্রী স্বামীর জন্য পায়েস রাঁধার কাজটি নিজ হাতে সযত্নে করেন। কেন? কারণ, তিনি জানেন কাজের লোকের রান্না করা পায়েস তাঁর স্বামী খেতে পারেন না। ভালোবাসা এরে কয়!

তারপরও স্বামী আজ তাঁর ওপর নাখোশ।

কোনো এক না বলা ক্ষোভ থেকে ভদ্রলোক একপর্যায়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ওই দম্পতির বিবাহিত সন্তানেরা এই সিদ্ধান্তের কারণ খুঁজে না পেয়ে হতভম্ব ও ব্যথিত।

প্রকাশক স্ত্রীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করলেন। বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রীর পক্ষে উকিল নিয়োগ পর্যন্ত করলেন। মজার ঘটনা ঘটল আদালতে যাওয়ার দিন। যে স্বামী স্ত্রীকে বিচ্ছেদ দিতে আদালতে যাচ্ছেন, সেই স্বামীর সঙ্গেই এক গাড়িতে স্ত্রীও আদালতে রওনা দিলেন। কারণ, স্বামীর ওপর একাত্মভাবে নির্ভরশীল এই নারী কোনো দিন স্বামীকে ছাড়া একা কখনো বাইরে কোথাও যাননি। ভদ্রলোক স্ত্রীর দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। ওই দৃষ্টিতে কী ছিল? মমতা, নাকি নির্ভরশীল নারীর প্রতি হতাশা মেশানো বিরক্তি? বোধ হয় দুটিই। তারপরও বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন প্রকাশক।

ভদ্রলোক অন্য নারীতে আসক্ত নন। বন্ধুবান্ধবের আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা যায়নি তাঁকে একবারও। মাঝেমধ্যে টিভিতে ডিসকভারি চ্যানেল দেখাটাই ছিল তাঁর একমাত্র বিনোদন। তবে কেন? কিসের আকর্ষণে তিনি স্ত্রীকে ত্যাগ করতে চাইছেন?

ওই যে মৃত লেখকের বিধবা স্ত্রীর বিপন্ন মুখ। যে মুখ দেখে প্রকাশকের অবর্তমানে নিজের স্ত্রীর অসহায়ত্ব ও বিপন্নতার কথা ভেবেই হয়তো তিনি শিহরে উঠেছিলেন। বিপন্ন বোধ করছিলেন। তাঁর একাত্ম আপন নারী নিতান্ত গৃহবধূ মাত্র। সেই স্ত্রীকে আত্মনির্ভরশীল, শক্তিময়ী করার অভিপ্রায় নিয়েই নিজেকে সরিয়ে নিলেন প্রকাশক। স্বনির্ভর, শক্তিময়ী স্ত্রীকে দেখার বাসনা! ভালোবাসা এরে কয়।

স্ত্রী আদালতে নিজস্ব কোনো মতামত, কোনো ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন না। বৈবাহিক সম্পর্কে ক্লান্ত স্বামী বিচ্ছেদ চাইছেন। তবে তা-ই হোক। স্বামীর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। এটাই ছিল স্ত্রীর বক্তব্য।

আদালত চূড়ান্ত বিচ্ছেদ অনুমোদন না করলেও আলাদা বা স্বতন্ত্র বসবাস অনুমোদন করলেন। শুরু হলো তাঁদের স্বতন্ত্র বসবাস।

দিন যায়। স্ত্রী ধীরে ধীরে ঘরে-বাইরে সব কাজই শিখে নিলেন। বাজার, ব্যাংক, সব ঝামেলা সামলে উঠলেন। স্বামীকে ছাড়াই জীবন বয়ে চলল আপন গতিতে।

অবশেষে স্বামী ফিরে এলেন একদিন স্ত্রীর কাছে। কারণ, স্ত্রীকে ছাড়া জীবনযাপন তাঁর জন্য বড় কষ্টকর। সখী, ভালোবাসা এরে কয়!

এই হচ্ছে নন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা নন্দিতা রায় ও শিবপ্রসাদ মুখার্জির ‘বেলাশেষে’ সিনেমার মূল গল্প। তবে এই নির্মাতা দুজন অন্য সব নির্মাতার মতো ওই লেখকের স্ত্রীর করুণ মুখ বারবার পর্দায় দেখাননি বা দু-দুবার অস্কার বিজয়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা আসগার ফারহাদীর বহুল প্রশংসিত কৌশলমতো সময় নিয়ে ওই নারীর মুখের ওপর ক্যামেরাও ধরে রাখেননি। তবু কোনো জাদুবলে দর্শক বুঝে নেন নির্মাতার ভাষ্য বা তৈরি করে নেন নিজের ভাষ্য।

পরিণত বয়সের দুজন নর-নারীর ‘অঙ্গবিহীন আলিঙ্গন’ (কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে চয়ন) হচ্ছে ছবিটির মূল প্রাণ আর তাঁদের ভালোবাসার মূল বাঁধন। ঘটনাপ্রবাহে জানা হয়, এঁদের দুজনের পরস্পরের কাছে সামান্য সব প্রত্যাশা যে পূরণ হয়েছে তা নয়। তাঁদের দুজনের অপূর্ণ বাসনার গল্প শুনে মনে হয় ভালোবাসার ভুবনে সামান্য চাওয়া (সে হোক স্বামীর কাছে স্ত্রীর প্রত্যাশা একটি দেয়াল ঘড়ি বা স্বামীর এক দিনের আশা ঘরে ফিরে পাবদা মাছের ঝোল) বা একটুকু ছোঁয়াও কী অমূল্য ধন!

(‘বেলাশেষে’ চলচ্চিত্র বিষয়ে এই ভাষ্যটি সম্পূর্ণ লেখকের নিজস্ব বোধ থেকে উৎসারিত।)

চলচ্চিত্র ‘বেলাশেষে’