একটি গতানুগতিক পারিবারিক গল্প

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘তোমার সেই ফুল ফুল পেনডেন্টসহ চেইনটা কোথায় মা? ওটার দিকে অনেক দিন ধরে আমার নজর ছিল। চেইনটা আমি নেব।’ বলতে বলতে হালকা ফিরোজা রঙের বেনারসিটা নিজের গায়ে ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়ায় বেগম মেহেরুন্নেসার ছোট মেয়ে চুমকি।

শাড়িটা বেগম মেহেরুন্নেসাকে দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকীতে মাজেদ সাহেব দিয়েছিলেন। হাসপাতাল থেকে ফিরতে সেদিন মাজেদ সাহেবের খানিক দেরিই হয়েছিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা যখন রাতের বুকে নিজেকে সঁপে দেওয়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত, সে সময়টাতে বেলি ফুলের মালা আর শাড়ির প্যাকেট সমেত, সব ভুলিয়ে দেওয়া হাসি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন মাজেদ সাহেব। তাঁর দেরির কারণটা বোঝা গিয়েছিল তখন। স্বামীর মন জুড়িয়ে দেওয়া হাসিমুখ মেহেরুন্নেসার বড় প্রাপ্তি, তার পাশে দামি উপহারও ম্লান। তাদের নতুন সংসার, এখন এত অহেতুক খরচ কেন? মেহেরুন্নেসার প্রশ্নটাকে তেমন পাত্তা দেননি মাজেদ সাহেব। বরং বাইরের ধরাচুড়া না ছেড়ে, স্ত্রীকে সে শাড়ি পরার জন্য কেমন ছেলেমানুষি জেদ ধরেছিলেন। স্বামীর ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেননি মেহেরুন্নেসা। শাড়ি পরে, খোঁপায় ফুল জড়িয়ে যখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, মাজেদ সাহেব ভীষণ নাটুকে ভঙ্গিতে গেয়ে উঠেছিলেন—‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাঁস গ্যেয়ি।’

কত যুগ আগের ঘটনা এসব। অথচ আজও সব কেমন জীবন্ত। বুকের ওমে দিব্যি সবুজ-সতেজ। সেগুন কাঠের কারুকাজখচিত আলমারির লাগোয়া আয়নায় চামড়া জড়িয়ে যাওয়া নিজের শীর্ণ শরীরটার দিকে তাকিয়ে, বেগম মেহেরুন্নেসা স্মৃতির প্যান্ডোরার ঝাঁপি বন্ধ করেন আলগোছে। এসব শাড়ি, গয়না ইত্যাদি ঘিরে তাঁর জীবনের কত টুকরো স্মৃতি, কত গল্প জমে রয়েছে। ছেলেমেয়েদের কাছে সেসব গল্পের খুব একটা মূল্য হয়তো নেই...মেহেরুন্নেসা একাই বিগত সেসব যাপিত জীবন গল্পের একনিষ্ঠ পাঠক।

একটা দীর্ঘশ্বাস সযত্নে বুকের খাঁজে জমা রেখে মেয়ের উদ্দেশে বলেন, শাড়িটা তোকে মানাবে ভালো।

: হুম, সে আমি যা পরব সবই মানায়। কিন্তু চেইনটা তো দিলে না মা?

বেগম মেহেরুন্নেসা কী বলবেন কিছু বুঝে উঠতে না পেরে কথা ঘুরিয়ে, ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর বড়পার সঙ্গে কথা হয়েছে?

আগেভাবে কোন কোন শাড়ি নেওয়ার তালিকায় রাখবে, সে আগ্রহে চুমকির দুই চোখ তখন মায়ের আলমারির পরিপাটি করে সাজানোর শাড়ি কাপড়ের ওপরে আটকে আছে। সবটা মনোযোগও সেদিকে। মায়ের প্রশ্নটা যে কারণে হয়তো তার কানে পৌঁছায় না কিংবা পৌঁছালেও আমল দেওয়ার প্রয়োজন দেখায় না চুমকি।

প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ায় বুকের খাঁজ খুলে চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাসকে বেরোবার পথ করে দেন মেহেরুন্নেসা। বিশাল উঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, একটা ছেলেমেয়েও বাবার কোনো গুণ পায়নি। সব কটা নিজের স্বার্থের ব্যাপারে ষোলো আনা। এতটা অতিকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা ওরা রপ্ত করল কোথা থেকে? অপ্রিয় এ সত্যিটা অগ্রাহ্য করতে চাইলেও নানাভাবে নিরন্তর মেহেরুন্নেসাকে সত্যিটার মুখোমুখি হতে হয়।

বেগম মেহেরুন্নেসা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর অস্থাবর সম্পত্তি, ব্যবহৃত যাবতীয় শাড়ি-কাপড়, গয়না, যা তিনি আর ব্যবহারে ইচ্ছুক নন, সেগুলো, ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দেবেন নিজ হাতে। তাঁর নিজের ঘরের আসবাবগুলো বাদে, বাকি সবই ওরা পছন্দমতো নিতে পারে। বিদেশে থাকা তিন ছেলেমেয়ে বছরকার দর্শন দিতে এখন দেশে অবস্থান করছে। বিলিবণ্টনের জন্য এ সময়টাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছে তার। সে কারণে গত পরশু রাতে খাওয়ার টেবিলে উপস্থিত সব ছেলেমেয়েকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, সবাই যেন আজ হাজির থাকে।

এখনই তিনি তাঁর যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তির বণ্টনে যাচ্ছেন না জেনে ছেলেমেয়েরা হতাশই হয়েছে। তাদের খুব ইচ্ছে ছিল মা এখনই স্থাবর সম্পত্তির ভাগাভাগিটাও করে দিক। কিন্তু এই বোকামিটা মেহেরুন্নেসা এত জলদি করে ফেলতে চান না। বছর বছর তিন ছেলেমেয়ের দেশে আসার উৎসাহ তাহলে হয়তো দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে।

এতটা বেলা হয়ে গেল, বড়–মেজো ছেলে বা মেয়ের, কারওই দেখা নেই এখন পর্যন্ত। ছুটির দিন। দুজনের অফিস না থাকায় চুমকি স্বামীসহ সকাল সকাল চলে এসেছে। মেহেরুন্নেসা তাঁর ছোট মেয়ের জামাইটিকে বিশেষ স্নেহ করেন। কোনো রকম ঝুট–ঝামেলা নেই। একটা বই নিয়ে এক কোণে বসিয়ে দিলে তার আর কিচ্ছু চাই না। এখানে আসার পর শাশুড়ির সঙ্গে কুশল বিনিময়ের পর্ব চুকিয়ে সে সোজা শ্বশুরের লাইব্রেরি রুমে গিয়ে বসেছে। এতক্ষণে হয়তো নিজের পছন্দমতো বইয়ে ডুবেও গেছে। মেহেরুন্নেসার ইচ্ছে, স্বামীর ডাক্তারি বইগুলো কোনো লাইব্রেরিতে দান করে বাকি সব বই, শেলফ ইত্যাদি ছোট জামাই নিক। ওর কাছে শ্বশুরের জিনিসগুলো আদর পাবে। যোগ্য মানুষের হাতে কিছু দেওয়ার শান্তি অপার। কিন্তু এতে বাকিদের কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটাও তাঁকে ভাবিত করছে খানিক। নিজের হাতে এসব ভাগ–বাঁটোয়ারা করে না দিয়ে গেলে তাঁর মৃত্যুর পর হয়তো এসব সামান্য জিনিস নিয়ে ছেলেমেয়েরা বা ছেলেদের বউয়েরা নিজেদের মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি করবে, তার আলামতও স্পষ্ট।

দুই.

বেগম মেহেরুন্নেসা অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে। তাঁর ডাক্তার মা-বাবা সহায়–সম্পত্তি ভালোই রেখে গেছেন। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হিসেবে সবই মেহেরুন্নেসার প্রাপ্য। স্ত্রীর সম্পত্তির ব্যাপারে মাজেদ সাহেবের বাড়তি উৎসাহ কোনো দিনই ছিল না। অত্যন্ত নিঃস্ব পরিবারের সন্তান হলেও মাজেদ সাহেবের আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল প্রবল। জীবনের সব অর্জনই তাঁর নিজের অক্লান্ত পরিশ্রমে পাওয়া। মেডিকেলের মেধাবী-পরিশ্রমী ছাত্র হওয়ার সুবাদে, প্রিয় শিক্ষক রশিদ চৌধুরীর শুধু নজর কাড়তে সক্ষম হননি তিনি। সে সঙ্গে তাঁর একমাত্র কন্যার জামাতা হিসেবেও মনোনীত হয়েছিলেন। দরকারি বই, নোটস ইত্যাদি সাহায্যের উৎস হিসেবে শিক্ষক রশিদ চৌধুরীর বাড়ির দ্বার মাজেদের জন্য ছিল অবারিত। সে সূত্রে শিক্ষকের স্নেহবৎসল স্ত্রী আর অনার্স ফাইনালপড়ুয়া কন্যার সঙ্গে পরিচয়পর্বটা ঘটে যেতে সময় লাগেনি তেমন। অনিন্দ্যসুন্দরী মেহেরুন্নেসার ব্যবহারের মাধুর্যে খুব অল্প সময়েই মাজেদ ধরাশায়ী হন।

সুযোগ্য পাত্র হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ডাক্তারি ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই মেহেরুন্নেসার বাবা তাঁদের চার হাত এক করার তোড়জোড় শুরু করেন। মাজেদ সাহেবের পরিবার হাতে চাঁদ পাওয়ার আহ্লাদে ভেসে যায়। দুটো পরিবারের আকাশ-পাতাল ব্যবধান এই বৈবাহিক সম্পর্কে তেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। পাস করার আগেই বিয়ে করায়, উপার্জনের প্রাথমিক অধ্যায়টা বেশ কষ্টবহুল ছিল। শ্বশুরের কোনো রকম সাহায্যের আবেদন মাজেদ সাহেব সবিনয়ে গ্রহণ করা থেকে বিরত থেকেছেন। মেহেরুন্নেসা টিপিক্যাল বড়লোক বাবার মেয়ের মতো তাতে চাপপ্রয়োগের উৎসাহ না দেখিয়ে, স্বামীর ইচ্ছেকে সম্মান দেখিয়েছেন। তিনি নিজেও সংসারের আয় বাড়াতে মাস্টার্স পাস করার পরপরই চাকরিতে ঢুকে পড়েন। তা না করলে তাঁদের সংসার জীবনের সূচনাটা আরও দুর্বিষহ হতে পারত।

শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালনে দুই পক্ষই সাধ্যমতো চেষ্টা করে গেছে। এ ক্ষেত্রে মেহেরুন্নেসার আত্মত্যাগ ছিল মুগ্ধ হওয়ার মতো। নিজেদের উপার্জন থেকে প্রতি মাসে শ্বশুরের কাছে টাকা পাঠানোর নিয়ম রক্ষায় কোনো হেরফের ঘটতে দেননি তিনি কখনো। বিয়ের পর তাঁদের মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া হয়নি বলে মাজেদ সাহেব মাঝেমধ্যে মন খারাপ করতেন। কিন্তু সেসব নিয়ে মেহেরুন্নেসার কোনো অভিমান-অভিযোগ প্রকাশ পায়নি। বরং ঘোরাঘুরির পেছনে যে টাকা ব্যয় হতো, সেটা একমাত্র ননদের বিয়ের জন্য জমা করার তাগাদা দিয়েছেন স্বামীকে। এমন স্ত্রী পাওয়া ভাগ্য মানতেন মাজেদ সাহেব। স্ত্রীকে সে কারণে ভালোও বাসতেন ভীষণ। সংসার শুরুর দিকে যত অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা ছিল, একসময় প্রায় সবই পূরণ করেন। স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় যান বিয়ের আড়াই বছরের মাথায়।

সেখান থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে প্রথম সন্তান আগমনের আভাস দেখা দেয় মেহেরুন্নেসার শরীরে। খবরটা জেনে কী যে ছেলেমানুষি আনন্দে ভেসে ছিলেন মানুষটা! এমন একটা সুখবরকে স্মরণীয় করে রাখার উৎসাহে, স্ত্রীকে কিছু একটা উপহার দেওয়ার জন্য কেমন মরিয়া হয়েছিলেন মাজেদ সাহেব। তড়িঘড়ি সেদিন হাসপাতাল থেকে ফিরে স্ত্রীকে নিয়ে সোজা চলে গিয়েছিলেন নামি এক জুয়েলার্সে। অনেক বাছাবাছির পর, চমৎকার ফুল ফুল নকশার পেনডেন্টসহ ওজনদার চেইনটা স্ত্রীর জন্য পছন্দ করেছিলেন। স্বামীর ছেলেমানুষি আবদার রাখতে দোকানে দাঁড়িয়েই চেইনটা মেহেরুন্নেসাকে পরতে হয়েছিল। প্রথম সন্তান আগমনের স্মৃতি সততই সুখের। এ সুখের আমেজ পরের সন্তান আগমনের সময় উবে না গেলেও, প্রথমটার সঙ্গে তুলনায় বেশ পিছিয়েই থাকে যেন। অন্তত মেহেরুন্নেসার জীবনে এ কথা সত্যি। ফুল তোলা লকেটের চেইনটা মেহেরুন্নেসার সবচেয়ে প্রিয়। তাঁর অন্যান্য ভারী জড়োয়া গয়নার পাশে চেইনটা হয়তো মামুলি। কিন্তু সুখস্মৃতির ভারে ওটা সবচেয়ে ওজনদার। প্রথম সন্তান হিসেবে বড় ছেলে তাঁকে হতাশ করলেও তার জন্ম সময়ের সুখস্মৃতিতে মেহেরুন্নেসা এতটুকু মলিনতা লাগতে দেননি।

চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার জন্য বড় ছেলের আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তাবে মেহেরুন্নেসার আপত্তি ছিল। মাজেদ সাহেব তখন বেশ অসুস্থ। মেহেরুন্নেসা চাননি এমন অবস্থায় বাইরে গিয়ে ছেলে পড়াশোনা করুক। মাজেদ সাহেব নিজের অসুস্থতা নিয়ে ছেলের ইচ্ছের পথে বাধা হতে চাননি। স্ত্রীকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে রাজি করাতে তাঁর বেশি সময় ব্যয় করতে হয়নি। বাকি তিন ছেলেমেয়ে তো রইলই দেশে। বড় ছেলে যাচ্ছে যাক ফিরে আসবে আরও যোগ্যতর হয়ে। মায়ের জন্য, দেশের জন্য, ঠিক ফিরবে, দেখো। ছেলেও মাকে ছুঁয়ে কথা দিয়েছিল, পড়াশোনা শেষ করে ফিরে আসবে।

সে কথা রাখেনি ছেলে। নিজে তো ফিরেইনি, বাকি ভাইবোনদেরও নিজের কাছে টেনেছে লেখাপড়া-চাকরির ভালো পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদির প্রলোভনে। ছোট মেয়ে চুমকির কাগজপত্র হয়ে যাওয়ার পরও, স্বামী তার মাকে ছেড়ে যেতে রাজি না বলে এখনো দেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। নইলে সে–ও কবে বাকি তিন ভাইবোনের পথ ধরে দেশ ছাড়ত। মা–বাবাকে ছেড়ে, দেশ ছেড়ে, অন্য দেশকে আপন করে নিলেও মন্দের ভালো একটা ব্যাপারে তাদের হতাশ হতে হয়নি। মা–বাবার আশীর্বাদ নিয়ে, দেশেই প্রত্যেকের বিয়ে হয়েছে।

তিন ছেলেমেয়ের দেশ ছাড়া নিয়ে মেহেরুন্নেসার যতটা না আক্ষেপ, তার চেয়ে অধিক যা তাঁকে পোড়ায়, সেটা স্বামীর মনোবেদনা। এই বেদনা নিয়েই মানুষটা পৃথিবী ছেড়েছেন। বড় আস্থার সঙ্গে বলেছিলেন, বড় ছেলে ডিগ্রি নিয়ে ঠিক ফিরবে। তাঁর আস্থা ভেঙে যাওয়ার মর্মপীড়ায় তিনি কত যে কাতর হয়েছেন। কতভাবে স্ত্রীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। যে মানুষ জীবনের শত কষ্টেও ভেঙে পড়েননি, সন্তানের কারণে সেই মানুষের মানসিক ভঙ্গুরতা প্রত্যক্ষ করা মেহেরুন্নেসার জন্য অসহ্য পীড়াদায়ক ছিল। এ নিয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে তাঁর কোনো অভিযোগের প্রশ্নই ছিল না। সন্তানের কৃতকর্মের দায় স্বামীর না, কথাটা বহু চেষ্টাতেও মানতে রাজি ছিলেন না মাজেদ সাহেব। একতরফা নিজেকেই অপরাধী ভেবে গেছেন, যত দিন বেঁচে ছিলেন। স্বামীকে কষ্ট পেতে দেখে সন্তানদের ওপর তাঁর যে হিমশৈল অভিমান জন্ম নিয়েছে, তার হদিস তারা রাখে না সম্ভবত। কেন মা তাদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও একবারের জন্যও ওদেশে গিয়ে তাদের সংসার দেখার আগ্রহ দেখান না, মায়ের অভিমানের খোঁজ রাখলে ব্যাপারটা বুঝতে তাদের সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না।

তিন.

টেবিলে দুপুরের খাবার লাগানোর মিনিট পনেরো আগে একে একে সবাই এসে পড়ে। বড় জামাইয়ের হুল্লোড় স্বভাব। এসেই খাওয়ার মেনুতে তার পছন্দের কোন কোন খাবার আছে, তার সুলুক সন্ধানে ব্যস্ত হয়। মাজেদ সাহেবের বোনের ছেলে জালালের বউ শরিফা খাওয়া–দাওয়ার তদারকিতে হাত লাগিয়েছে। জালাল আর তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী শরিফা মেহেরুন্নেসার সঙ্গে এ বাড়িতেই থাকে। জালালের মা-বাবা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর এতিম ছেলেটাকে নিজেদের কাছে রাখার ব্যাপারে দুবার ভাবেননি বেগম মেহেরুন্নেসা। মাজেদ সাহেব তখন বেঁচে। তিনি তাঁর স্পর্শকাতর স্ত্রীকে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বলার পরও মেহেরুন্নেসা তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে পিছপা হননি। নিজের ছেলেমেয়েরা পরে অশান্তি করতে পারে, সে কথা ভেবে একমাত্র বোনের ছেলেটার বিষয়ে স্ত্রীকে ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন মাজেদ সাহেব। ভাগ্যিস সেদিন স্বামীর কথায় সায় দেননি। এখন তো জালালই তাঁর ভরসা। চুমকি কাছাকাছি থাকলেও মায়ের ডাক্তার দেখানো, বাড়ি ভাড়া, দোকানের ভাড়া তোলা, ফার্মেসির দেখাশোনার কাজে সে মোটেও আগ্রহী না। প্রবল আত্মসম্মানের কারণে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার চুমকিকে অনুরোধ করেননি। ছোট জামাইকে অনুরোধ করলে সে হয়তো আপত্তি করত না। কিন্তু মেয়ে সেসব নিয়ে নিজের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে ভেবে বিরত থাকেন। সমস্ত দায় দায়িত্বে তাঁর হাতের লাঠি এখন জালাল। নিজের ছেলেমেয়েরা তো থেকেও নেই। জালাল তার নিজের চাকরি সামলে, অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে মামিমার যাবতীয় কাজ দেখাশোনা করে।

মামার চেহারার হালকা আদল আছে ভাগনে জালালের মুখটায়। স্বভাবে মামার পুরো উল্টো, ভীষণ অন্তর্মুখী। মামির কাছে দীর্ঘদিন থাকার ফলে মেহেরুন্নেসার সঙ্গে আচরণে খোলামেলা হলেও, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে মেশার ব্যাপারে তার কেমন জড়তা কাজ করে। অবশ্য মুখচোরা এই ফুফাতো ভাইয়ের জড়তা বা উপস্থিতি নিয়ে তাঁর ছেলেমেয়েদের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এ বাড়িতে আশ্রিত হিসেবে তাকে কেয়ারটেকারের মর্যাদার বেশি দিতে তাদের যেন বাধে। সেটা আবার চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর নিষ্ঠুরতাও চলে মাঝেমধ্যে। এবার সে আচরণ কম দেখা যাচ্ছে।

মেহেরুন্নেসা কঠোরভাবে ছেলেমেয়েদের আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, জালালের সঙ্গে ভদ্র আচরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব না হলে এ বাড়িতে ওঠার দরকার নেই। দেশে যার যার শ্বশুরবাড়িতে এসে উঠতে পারে। এতে তাঁর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তাদের সুযোগ-সুবিধামতো মাকে দেখা দিয়ে গেলেও চলবে। সহায়সম্পদের শক্তির চেয়ে বড় শক্তি বুঝি এই পৃথিবীতে নেই। একই সঙ্গে সম্পদ থাকা বালাইও বটে। আজকে মেহেরুন্নেসার নিজের অধিকারে প্রচুর সহায় সম্পদ আছে বলে সন্তানেরা তাঁর কথার মূল্য দিচ্ছে। অন্তত ব্যবহারে বোঝাতে চেষ্টা করছে মায়ের আদেশ শিরোধার্য। তাঁর যদি এত সব না থাকত? ভাবনাটা ভুস করে ভেসে উঠতেই মেহেরুন্নেসা দ্রুত সেটা চাপা দিয়ে বিশাল টেবিল ঘিরে বসে থাকা মুখগুলো জরিপ করে নেন। টেবিলে সবার উপস্থিতি চোখে পড়লেও জালালকে না দেখে মেহেরুন্নেসার ভ্রুতে ভাঁজ পড়ে।

বড় ছেলে আর মেয়ে তাদের সন্তানদের আনেনি এবার। দেশে এলে তারা বেশির ভাগ সময়ই বোর হয়, তাই এবার গরমের ছুটিতে এদিকে না এসে ক্যাম্পিংয়ে গেছে। মেজো ছেলে তার দুই মেয়ে নিয়ে এসেছে। ফুটফুটে পরির বাচ্চা দুটো। দাদির সঙ্গে কুটকুট করে ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে। মেহেরুন্নেসাও ওদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে একটা–দুটো বাক্য ইংরেজিতে বলেন। নাতনিরা মজা পায় তার ইংরেজি শুনে, তাদের বাংলা শুনে দাদিও মজা করেন। এ নিয়ে হাসি গল্প জমে ওঠে বেশ। মেজো ছেলের বউ যত্ন নিয়ে মেয়েদের বাংলা শেখাচ্ছে। শাশুড়িকে বলে, ‘মা ওদের বাংলা না শিখিয়ে তো উপায় নেই। আমার মাতো আপনার মতো ইংরেজি বলতে জানেন না।’

নাতনিদের পছন্দের মিটবল টেবিলে না দেখে গলা তুলে বাবুর্চি বাচ্চুমিয়াকে ডাকেন, বাচ্চুমিয়া জানায়, দুপুরে মুরগির রোস্ট থাকায় ওটা রাতের মেনুতে রাখা হয়েছে।

শরিফা মামির প্লেটে খাবার তুলে দিতে এলে, হাত তুলে বারণ করায় প্রশ্নভরা চোখে সে তাকায় মেহেরুন্নেসার দিকে। বাকিরাও খাওয়া মুখে তুলতে গিয়ে থমকে যায়।

: জালালকে ছাড়া আজ পর্যন্ত আমি খেয়েছি বউমা?

থমথমে কণ্ঠে লেপ্টে থাকা চাপা রাগটা মেহেরুন্নেসা গোপনের চেষ্টা করেন না।

শরিফা সামান্য থতমত খেয়ে যায় মামিমার কণ্ঠস্বরে। আজ পর্যন্ত তিনি তার সঙ্গে এমন রূঢ় স্বরে কথা বলেননি। আজ কী হলো মামিমার?

: জালাল কই? নিজ হাতে বাজার করে আনল, এখন খাবার সময় উধাও কেন সে!

: মা তোমার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি। জালাল হয়তো ব্যস্ত কিছু নিয়ে। পরে খাবে।

বাঁ পাশের চেয়ারে বসা বড় মেয়ের কথা আমলে নেওয়ার প্রয়োজন দেখান না মেহেরুন্নেসা। জালালকে ডাকার জন্য শরিফাকে বলতে যাবেন, এমন সময় গুটি গুটি পায়ে জালাল এসে দাঁড়ায়। ওর ফরসা মুখটা লালচে দেখাচ্ছে কেমন। সেদিকে তাকিয়ে অস্থির গলায় মেহেরুন্নেসা জানতে চান, কী রে তোর জ্বরটর এল নাকি?

মুখে হাসি টেনে জালাল মামিমাকে শান্ত করে। জানায় সামান্য মাথা ধরায় এতক্ষণ শুয়ে ছিল সে।

বড় জামাই কই মাছের মাথা চিবোতে চিবোতে বলে, ভায়া, কই মাছটা জব্বর! ও দেশে কই মাছে কেমন মাটি মাটি গন্ধ। বসে যাও, বসে যাও, ভাগে পাবে না পরে।

চার.

মেহেরুন্নেসার মনে একটা খচখচানি তৈরি হয়েছিল জালালের লালচে মুখ দেখে। খাওয়ার টেবিলে সে উপস্থিত হওয়ায় আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া পর্ব শেষ করেন। খাওয়া–দাওয়ার পর ছেলে বউ, মেয়ে জামাই, সবাই তাঁর ঘরে জড়ো হয় মায়ের কথামতো। জালাল আর শরিফাকে বিশ্রামে পাঠিয়ে মেহেরুন্নেসা মনে মনে তৈরি হন একটা নাটকের মহড়ার জন্য। জালালদের বিলিবণ্টনের অংশীদার হতে না দেখে সবার মধ্যে কেমন একটা চাপা আনন্দ লক্ষ করে অলক্ষ্যে দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন বেগম মেহেরুন্নেসা।

‘হরিলুট’ শব্দটা শুনে এসেছেন এত দিন। আজ স্বচক্ষে সেটা প্রত্যক্ষ করেন বেগম মেহেরুন্নেসা। প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে তাঁর শিক্ষিত- প্রাচুর্যের অধিকারী ছেলেমেয়েরা, সামান্য জিনিস নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে আচরণ দেখাল, সোজা ভাষায় সেটা কাঙ্গালপনা। তার জন্য মনে মনে প্রস্তুত থাকলেও, সত্যিই ভাবেননি নিজেদের প্রচুর থাকার পরও তাঁর সন্তানেরা ভেতরে-ভেতরে এতটা নিঃস্ব!

চা–বিরতিতে উঠে নামাজ সেরে, এক ফাঁকে জালালের ঘরে গিয়ে মনে উঁকি দেওয়া প্রশ্নের সত্যতা যাচাই করতে ভোলেন না। মনে মনে যেটা আঁচ করেছিলেন বাস্তব ঘটনা তার চেয়েও পীড়াদায়ক। ছেলেরা জালাল আর তার বউকে এ বাড়ি দ্রুত ছেড়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীসহ ভাইটাকে একপ্রকার তাড়িয়ে দেওয়ার এমন নিষ্ঠুরতা কোন হৃদয়ে দেখাতে পারল তাঁর সন্তানেরা! মানুষ হিসেবে উচ্চমানের হয়ে ওঠায় সন্তানদের যথেষ্ট খামতি আছে, মা হিসেবে এই তিতকুটে সত্যির ভারটা তিনি গোপনে বয়ে বেড়ান। সেই সত্যের এমন ভয়ানক প্রকাশে কেমন অসাড় লাগে মেহেরুন্নেসার।

সব ভুলিয়ে দেওয়া হাসিমাখা লোকটার অনুপস্থিতি বহুদিন পর তাঁকে কেমন কাঁপিয়ে দিয়ে যায়। জালাল মামিমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে ওদের কথা মোটেও অযৌক্তিক না। শিগগিরই সে মাথা গোঁজার ঠাঁই খুঁজে সরে যাবে শরিফাকে নিয়ে। ভাইবোনেরা তো চাইবেই হকের দাবি আদায় করতে। এত দিন থাকতে পেরেছে এটাই তো অনেক।

হকের দাবি? কিসের হক আমার সম্পদের ওপর? ওয়ারীর এই বিশাল জায়গার ওপর দোতলা বাড়িটি তাঁর বাবার তৈরি। মাজেদ সাহেবের মৃত্যুর পর ধানমন্ডির বাড়ির আনাচকানাচে, স্বামীর ছড়িয়ে থাকা স্মৃতির ভার বইতে না পারায়, ওয়ারীর এই বাড়িটায় চলে এসেছিলেন তিনি। তখন মাও বেঁচে ছিলেন। বিশাল এই বাড়িতেই মেহেরুন্নেসার জন্ম। এ বাড়ি তাঁর। তিনি যাকে খুশি এ বাড়িতে থাকতে দিতে পারেন, যাকে খুশি সেটা দেওয়ারও অধিকার রাখেন। ছেলেমেয়েদের এতে টুঁ শব্দের অধিকার নেই।...মনটা কেমন বিষাক্ত হয়ে যায় মেহেরুন্নেসার।

বিলিবণ্টনের শেষে বড় মেয়ে মুখ কালো করে মায়ের উদ্দেশে বলে, তোমার বিয়ের সেই জড়োয়া সেট আর শাড়িটা তো কোথাও দেখলাম না মা? ওটা তোমার বড় নাতির বউয়ের প্রাপ্য বলেই তো জানতাম।

বড় ছেলের বউও কম যায় না, সে বলে, তা কেন? বড় ছেলের ছেলেমেয়েদের রাইট আগে, ঠিক না মা?’

চুমকি তার বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত ফুল ফুল লকেটসহ চেইনটার হদিস না পেয়ে গুম মেরে গেছে। জীবিত মায়ের ব্যবহৃত সেগুন কাঠের খাট–আলমারির ওপর কারও অধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় মেজো ছেলের আফসোসও কম না।

ওদের প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে, বেগম মেহেরুন্নেসা কেটে কেটে বলেন, জালালকে তোমরা এ বাড়ির কেয়ারটেকারের ওপরে ভাই হিসেবে ভাবতেই পারোনি কোনো দিন। যদি তোমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হতো, তবে এতিম ভাইটার বিয়েতে উপস্থিত থাকতে। আর বিয়েতে এলেই দেখতে পেতে আমার বিয়ের শাড়ি–গয়না কত যোগ্য মানুষের প্রাপ্য হয়েছে।

ছোট মেয়ে চুমকির উদ্দেশে বলেন, জালালের বিয়ে এড়াতে তোমাদের তখন নেপাল ট্যুরে যেতেই হলো। ফিরে এসেও ভাইয়ের বিয়ের ব্যাপারে বিন্দুমাত্র উৎসাহ দেখাওনি। তাই তোমার অজানা থেকে গেছে সবটাই। ফুল ফুল চেইনটার আশা তুমি ছেড়ে দাও। ওটার যোগ্য তুমি নও। চেইনটাও আমি যোগ্য মানুষকেই দেব ঠিক করেছি। আর শোনো, দ্বিতীয়বার কেউ জালালকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা উচ্চারণের সাহস দেখাবে না আশা করি। এই বাড়ির নিচতলাটা আমি জালালের নামে দিয়ে যাব। ফার্মেসিটাও জালালের নামে হয়ে যাবে। এটা নিয়ে আমি কারও কোনো দ্বিতীয় মত শুনতে রাজি নই। এবার তোমরা এসো। আমার শরীরটা ভালো লাগছে না, আমি একটু শোব।

জালালের বিষয়ে ঘোষণাটা এখনই দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল না মেহেরুন্নেসার। কিন্তু তাকে বাড়ি থেকে উৎখাতে ছেলেমেয়েরা মরিয়া হয়ে উঠছে আঁচ করে, মাথা ঠিক রাখতে পারেননি। বলেই ফেললেন। ঘরের ভেতর পিনপতন নীরবতা নেমে আসে হঠাৎ। বাকশক্তিরহিত ভাইবোনেরা বাজ পড়া তালগাছের মতো খানিক দাঁড়িয়ে থেকে, একে অন্যের মুখ চাওয়া–চাওয়ি করে, যে যার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

ধীর পায়ে ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ান বেগম মেহেরুন্নেসা। আজ কী পূর্ণিমা? বাইরেটা কেমন ধবল জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে! চুইয়ে পড়া জ্যোৎস্না দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ দুধের বাটি উল্টে দিয়েছে। এমন জ্যোৎস্নাকেই কী গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না বলে? সত্যিই কী জ্যোৎস্নার হাতছানি মানুষকে ঘর ছাড়ার শক্তি জোগায়?

অনেক আয়োজন করে ঘর–গৃহস্থালির গল্প সাজায় মানুষ সংসার নামের মায়ায় পড়ে। তার বাঁধন ছেঁড়া কজনের পক্ষে সম্ভব হয়! হয়তো হয়। কাগজে–কলমে ঘর ছেড়ে পথে না নামলেও কত গৃহী মনে মনে সংসার ত্যাগী, তার খবরই বা কে জানে।

কত মমতা দিয়ে মাজেদ সাহেব আর তিনি এই সংসার গড়ে তুলেছিলেন। আজ এত বছর পর তাঁদেরই ঔরসজাত সন্তানেরা সেই সংসারে টেনে আনছে মায়া–মমতাহীন স্বার্থপর একটা জগৎকে। হতাশা আর ক্ষোভে কেমন হাঁসফাঁস লাগে তাঁর। বুকের কপাট খুলে দীর্ঘশ্বাসগুলোকে রাতের বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলেন মেহেরুন্নেসা। খাটের মাথার কাছে নাইট স্ট্যান্ডের ওপরে রাখা ছবিটা তুলে নেন দুই হাতে। ঘাড় ঈষৎ কাত করে মুখভরা হাসি নিয়ে ছবির মানুষটা তাঁর দিকেই চেয়ে আছে অপলক। ছোট্ট শিশু ঘুমের সময় যেভাবে তার প্রিয় টেডিবিয়ার আঁকড়ে ধরে আশ্রয় খোঁজে, সে রকম আস্থায় বেগম মেহেরুন্নেসা ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরেন। সারা দিনের অসহ্য সময় উজিয়ে তিনি বড় ক্লান্ত। তাঁর দুই চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে।
...

নাহার তৃণা: ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।