একটি আন্দোলনের ময়নাতদন্ত, শিক্ষার্থীদের আস্থায় এখনো একজন শিক্ষক

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ।
ছবি: আনিস মাহমুদ

এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে শাবিপ্রবিরই সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর স্ত্রী সাবেক অধ্যাপক ইয়াসমিন হককে সঙ্গে নিয়ে অনশনকারীদের কাছে ছুটে যান।

জাফর ইকবালের অনুরোধে অবশেষে নানা জল্পনাকল্পনা শেষে অনশন ভাঙলেন ক্লান্ত শ্রান্ত শিক্ষার্থীরা, বস্তুত রক্ষা পেল তাঁদের প্রাণ। স্বীকার করতেই হবে, শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গের মাধ্যমে গোটা জাতি এক অজানা আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, জাফর ইকবাল কি শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে সেখানে গিয়েছিলেন? নাকি সরকারের প্রতিশ্রুতির কোনো বার্তা বয়ে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন? যাঁদের মনে এমনতর প্রশ্ন জাগছে, তাঁদের কাছে সবিনয় জানতে চাইব, জাফর ইকবালের স্থলে আপনি বা আপনারা সেখানে গেলে কী হতো? শিক্ষার্থীরা কি আপনার এ অনুরোধ, উপরোধ মেনে নিতেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা কী দেখি, সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর উপাচার্যদের দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, অমানবিকতা ও নির্লজ্জতার সব ঘটনা শিক্ষাঙ্গনগুলোকে চরমভাবে কলুষিত করেছে। জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন হককে প্রথমেই ধন্যবাদ দিন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কারণ, তাঁরা এখনো শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গায় রয়েছেন, সম্মানের জায়গায় রয়েছেন, অভিভাবকের জায়গায় রয়েছেন।

এ কথা কি অস্বীকার করা যাবে যে এ আন্দোলনে মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে একটি তথাকথিত শ্রেণির। যারা এ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধাপে ধাপে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছে ও তাঁদের জীবনকে সংকটাপন্ন ও প্রশ্নের মুখে এনে দিয়েছে। এটা মনে করা অসংগত হবে না, বিভিন্ন প্রবিধান ও নির্দেশিকা লঙ্ঘন করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা নিচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ওপর অপর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা যখন বিপন্ন, যখন একাডেমিক বা ব্যবস্থাপনাগত সিদ্ধান্ত বিতর্কিত, তখন সরকার হাত উঁচু করে বসে থাকতে পারে না। এ আন্দোলন ছিল শিক্ষার্থীদের আত্মসম্মানবোধের ওপর বড় আঘাতের একটি প্রতিবাদ।

শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন অবশ্যই সফল হয়েছে আর তা দেশের ছাত্র আন্দোলনকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারেনি তৃতীয় কোনো পক্ষ! ওরা প্রমাণ করেছে, শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গায় এখনো রয়েছেন শিক্ষক, শিক্ষকেরা এত বড় জুলুমের সময়ও সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াননি, সর্বমহল তাঁদের চিহ্নিত করে রেখেছে। সরকারের উচ্চ মহলের বোধোদয় কেন এতটা বিলম্বিত, তা জানার আগ্রহ দেশবাসীর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনে এ আন্দোলন। সে তৃতীয় পক্ষকে খুঁজে পেতে সরকারকে খুব বেশি দূরে যেতে হবে না, যারা এ উত্তেজনার সৃষ্টির জন্য সুনিপুণভাবে কাজ করেছে।

আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন এক গভীর সংকটে নিপতিত, আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতিতে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বৈষম্যহীন শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা যেন জেঁকে বসেছে। অর্থবহ শিক্ষালাভের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধাভেদে শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে বিদেশে পড়াশোনার কথা ভাবতে শুরু করেছেন। শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল যে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংস্কার প্রযোজন—তার পরিকল্পনা কোথায়? কোথায় সে জনবল? কোথায় সে শিক্ষক? কোথায়বা সে রাজনৈতিক সদিচ্ছা?

দৈনিক প্রথম আলোর দূর পরবাসে গত বছরের ১২ নভেম্বর ‘বাংলাদেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ জনশক্তি সরবরাহে ব্যর্থ’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। এ ছাড়া অপর কয়েকটি নিবন্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধনের কিছু প্রস্তাবনাও তুলে ধরেছিলাম। খুবই আশান্বিত হয়েছিলাম, সরকারের শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার উদ্যোগ দেখে। এরই মধ্যে শুরু হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সাদামাটা একটি আন্দোলন। উত্তেজনা সৃষ্টির সুনিপুণ কৌশলে এ আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেল একটি শ্রেণি, শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ, লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস—যা কিছু করা দরকার! সরকারের ইগো বা প্রেস্টিজ ইস্যুর ধোঁয়া তুলে জটিল করা হলো সমস্যার সমাধান।

একধরনের ‘গোঁয়ার্তুমির’ আশ্রয় নিয়ে অমানবিক কিছু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেও শেষতক সফল হয়নি প্রশাসন। শুধু সরকার নয়, দেশকে স্বস্তি এনে দিলেন একজন শিক্ষক। বিপর্যয়কর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পর আমরা আশান্বিত যে সরকার শিক্ষার্থীদের সব দাবির সম্মানজনক সমাধান করবে এবং শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে একজন শিক্ষকের মাধ্যমে, তার হুবহু প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন ঘটাবে, যা দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় দেশবাসী।

লেখক: দেলোয়ার জাহিদ, সাবেক রিসার্চ ফ্যাকাল্টি মেম্বার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবা, (সেন্ট পলস কলেজ) কানাডা, প্রাবন্ধিক ও রেড ডিয়ারনিবাসী (আলবার্টা)।