একজন ফাহিম সালেহ

ফাহিম সালেহ

১.
ড. ড্যারুন আসেমগ্লু। এমআইটি অর্থনীতির অধ্যাপক। এমনই একজন বড়মাপের অর্থনীতিবিদ, অনেকেরই মতে, তিনি যে একদিন নোবেল পুরস্কার পাবেন, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাঁর অনেক আলোচিত একটি গবেষণার ফলাফল ছিল এ রকম। ইউরোপিয়ান ঔপনিবেশিকেরা কোনো দেশ দখল করার পরে সেখানে কী সুশাসন নাকি দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে দুটি বিষয়ে বিশেষভাবে নজর দিত—ওই দেশে বিভিন্ন রোগবালাইয়ে ঔপনিবেশিকদের মৃত্যুর হার আর জনবসতির ঘনত্ব। যদি দেশের পরিবেশ এমনই প্রতিকূল হয় যে ঔপনিবেশিকেরা খুব সহজেই কাবু হয়ে যেত, তখন তাদের সেই দেশে ইউরোপ থেকে মানুষ এনে নতুন বসতি করার কোনো পরিকল্পনা থাকত না। তাদের লক্ষ্য থাকত সেই দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে একেকটি শোষণের হাতিয়ার বানিয়ে যত বেশি সম্ভব সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে ইউরোপে পাচার করা। একইভাবে সেই দেশে মানুষের ঘনত্ব যদি অনেক বেশি হয়, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে খুব লাভজনক হয়, যদি মানুষগুলোকে শ্রমনির্ভর শিল্পে আচ্ছামতো খাটিয়ে এবং শ্রমের ন্যায্যমূল্য না দিয়ে যত বেশি মুনাফা বাড়ানো যায়।

আসলে হুট করে একটা দেশ গরিব হয়ে যায় না। এর পেছনে থাকে শত বছরের প্রক্রিয়া। আবার আমরা যে উন্নত দেশগুলো দেখি, তারা সবাই যে খুব সৎভাবে খেটেখুটে বড়লোক হয়েছে, এমন নয়। বিশেষ করে শিল্পায়নের পেছনে যে বিপুল পরিমাণের রসদের দরকার ছিল, তার একটা বড় অংশ সরবরাহ করা হয়েছিল বিশ্বের তৎকালীন কলোনাইজড অঞ্চলগুলো থেকে। আমাদের বাংলাদেশ সেই রসদের জোগান দিতে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল অনেক আগেই। তার সঙ্গে ছিল অনেক বছরের ক্রমাগত বঞ্চনা আর স্বাধীনতার পরে বৈদেশিক দাতাগোষ্ঠীর হস্তক্ষেপে একের পর এক কৃত্রিম অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রয়োগ। এত কিছুর পরও গত কয়েক দশকে অল্প সময়ে আমাদের দেশ যে বিপুল পরিমাণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে, সেটি আমাদের যেনতেন অর্জন নয়।

কিন্তু এরপরেও আমাদের দেশের মানুষের, বিশেষ করে আমরা যারা বিদেশে থাকি, তাদের একটি নিত্যদিনের স্বভাব হচ্ছে এই দেশকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করা। দেশ গোল্লায় যাচ্ছে, সুশাসনের সু-ও নেই, দুর্নীতিতে ভরে যাচ্ছে ভাই। প্রবাসের কথা যদি বলি, সেখানে তিন ধরনের মানুষের দেখা পাবেন আপনি। বিশেষ করে দাওয়াত খেতে গেলে এদের সবার সঙ্গে পরিচিতি হবে। একধরনের মানুষ আছেন, যাঁরা বাংলাদেশের কথা টানলেই ঘৃণায় মুখ সরিয়ে নেবে, মনে হয় বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল। উন্নত দেশের সিটিজেনশিপ পাওয়ার পরে সেই ট্র্যাজেডির অনেকাংশই দূর হয়েছে। গর্ব তাদের ছেলেমেয়ে—বাংলা ভুলেও মুখ দিয়ে আসে না। আবার কিছু প্রবাসী আছেন, যাঁরা দেশকে সদা অনুভব করেন, দেশের মানুষের দুঃখে মন খারাপ করেন, কিন্তু তাঁদের যা কিছু, সব সেই অনুভবেই সীমাবদ্ধ। দূর থেকে কিছু করার মতো ব্যাকুলতা নেই।
আরেক ধরনের প্রবাসী আছেন, যাঁদের মনেপ্রাণে দেশ, চিন্তায় দেশ। তাঁদের সন্তানেরাও দেশের প্রতি মা–বাবার সেই ব্যক্ত ও অব্যক্ত ভালোবাসায় বিলীন হয়ে যায়। ফাহিম সালেহ, আমাদের সবার পরিচিত একজন অত্যন্ত সফল উদ্যোক্তা, যিনি গত বছরের ১৩ জুলাই খুব মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাঁর বাবা–মা সেই ধরনের গুটিকয় মানুষের ভেতর পড়েন। আপনারা কি জানেন ফাহিমের বাবা বাংলায় একটি উপন্যাসও লিখেছিলেন?

ভেনচার ক্যাপিটালিস্টরা সিলিকন ভ্যালির প্রাণ। তারা ব্যবসায়ে বড় অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ করেন অংশীদারির বিনিময়ে। প্রচলিত ব্যাংকের মতো নির্দিষ্ট সুদ আর পুঁজির সুরক্ষার জন্য মুহূর্তে মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় না। যথেষ্ট সময় দেয় একটা স্টার্টআপকে পুরোপুরি মুনাফার মুখ দেখার জন্য। ভেনচার ক্যাপিটালিস্টদের সুবিধা হচ্ছে, তারা এমনভাবে বড় অঙ্কের অর্থ অনেকগুলো স্টার্টআপে বিনিয়োগ করে, একটি বা দুটি স্টার্টআপ সফল হলেই তারা মূলধনের চেয়ে অনেক গুণ বেশি অর্থ উপার্জন করতে পারেন। যেহেতু পুরো প্রক্রিয়াটাই ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ, ভেনচার ক্যাপিটালিস্টরা সাধারণত পরিচিত, স্বচ্ছ এবং উন্নত মার্কেটগুলোতেই ভিড় করে বেশি।
২.
একধরনের উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা নিজস্ব কোনো পরিকল্পনা বা সৃজনশীলতা নিয়ে চলেন না, কিন্তু অন্যের দেওয়া সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা পেলে তাঁরা সেটা যে কারও চেয়ে অসাধারণ দক্ষতায় বাস্তবায়ন করতে পারে। আরেক ধরনের উদ্যোক্তা আছে, যাদের সৃজনশীলতার বা পরিকল্পনার কোনো সীমা নেই, কিন্তু তাঁদের জন্য দরকার হয় দক্ষ মানুষ, যিনি সেটার বাস্তবায়ন করতে পারেন। খুব কম উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা একইসঙ্গে পরিকল্পনা তৈরি ও তার বাস্তবায়ন—দুই বিষয়েই অত্যন্ত দক্ষ। তার চেয়েও অনেক অনেক কম উদ্যোক্তা আছেন, যাঁরা পরিকল্পনা তৈরি ও তার বাস্তবায়ন করে একটা ভিশন নিয়ে, কাজের একটা দর্শন নিয়ে। ফাহিম তাঁদেরই একজন ছিলেন।

৩.
ফাহিম সালেহ যে গতিতে এগোচ্ছিল, এখন থেকে আর দশ বছরের মধ্যে সে হতে পারত বাংলাদেশ এবং উন্নয়নশীল জাতির উদ্যোক্তাদের একটা আইডল। যাকে দেখে তরুণদের একটা বড় অংশ ঝাঁপিয়ে পড়ত নতুন নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন পরিবর্তনের কাজে। বিদায় নেওয়ার সময় তার সেই বিশাল হাসি, দুই কান ছুঁই–ছুঁই। যেই হাসি নাইজেরিয়া, কলম্বিয়ার মতো অর্থনৈতিকভাবে অন্তর্মুখী অঞ্চলের মানুষগুলোর মনও খুব কম সময়েই জয় করে নিয়েছিল।
৪.
যেকোনো পেশায় বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থানে যাওয়ার রাস্তাটা হচ্ছে একটা unchartered territory. যাওয়ার পথে অনেক কাঁটা, মোহ, ষড়যন্ত্র। যে জাতিই সেই প্রথমবারের মতো সেই সর্বোচ্চ স্থানে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তাকে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার মোকাবিলা করতে হয়েছে। কিন্তু একবার যাওয়ার রাস্তাটা চেনা হয়ে গেলে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য পুরো ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে যায়। ফাহিম সালেহ সেই রাস্তাটাই দেখাতে চেয়েছে। বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই প্রচেষ্টার প্রথম ত্যাগ। বেঁচে থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
৫.
ফাহিম সালেহর সঙ্গে থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। পারিবারিক সম্পর্ক। মৃতদেহ যখন কবরে শোয়ানো হচ্ছিল, তার বাবা আমার পাশেই ছিলেন। খুবই ভদ্র, নম্র, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা একজন মানুষ। তাঁর শোক প্রকাশের ভেতরও একটা ভদ্রতা, কারও যাতে কানে না লাগে। কিন্তু কবর দেওয়ার শেষ মুহূর্তে হঠাৎ করে তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ‘ফাহিম, কল দিবি না বাবা, কল দিবি না?’
লেখক: ড. ইব্রাহীম সিরাজ, সহকারী অধ্যাপক, কলেজ অব ম্যানেজমেন্ট, লং আইল্যান্ড ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক, আমেরিকা