একজন অপদার্থ বাবা

শিশুরা বেড়ে উঠুক বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে

প্রথম আলোতে দুই বছর আগে ‘একজন ফালতু বাবা’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখার বিষয়বস্তু ছিল বাচ্চাদের লেখাপড়ার ছুঁচোর দৌড় প্রতিযোগিতা। তাদের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার বানানোর তালে আমরা কীভাবে তাদের জীবনকে বিষয়ে তুলি, সেই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছিলাম। সঙ্গে এসেছিল বিশ্বব্যাপী শিক্ষার বর্তমান স্বরূপ। পাশাপাশি এসেছিল ‘শ্যাডো এডুকেশন’র মাত্রা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় শ্যাডো এডুকেশনই এখন আসল এডুকেশন। আর মূল শিক্ষাব্যবস্থা শুধু একটা ফর্মালিটিজ।

অবশ্য পৃথিবীর সব দেশে শ্যাডো এডুকেশন সমানভাবে তার থাবা বসাতে পারেনি। আর একটা দেশের সব মানুষ শ্যাডো এডুকেশনকে সমান গুরুত্ব দিয়ে নেয়নি। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে যাদের আমরা অজি বলে থাকি, তারা একাডেমিক এডুকেশনটাকেই তেমন গুরুত্ব দেয় না, শ্যাডো এডুকেশন তো অনেক দূরের ব্যাপার। বরং তারা কারিগরি শিক্ষাটাকে অনেক গুরুত্ব দেয়। কারণ, কাজের ক্ষেত্রে হাতে–কলমে প্রাপ্ত কারিগরি শিক্ষাটা অনেক বেশি দরকারি।

একগাদা ডিগ্রি নিয়ে মগজের ওপর বাড়তি বোঝা না চাপিয়ে দিন আনি দিন খাইয়ের জন্য কারিগরি শিক্ষা খুবই মানানসই। কিন্তু আমাদের মতো দেশে বছর বছর ডিগ্রি নিয়ে মানুষ বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ায়; কিন্তু কেউই কারিগরি শিক্ষা নিয়ে প্লাম্বার, ইলেকট্রিশিয়ান, কার্পেন্টার হতে চাই না। কারণ, এগুলোকে ছোটলোকের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। আর এগুলোর বাংলা শব্দগুলোও খুব বেশি সম্মানজনক না, তাই মানুষ তেমন একটা আগ্রহ পায় না। যেমন প্লাম্বারের সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায় মেথর।

আমাদের দেশে সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষ হচ্ছে এ মেথর সম্প্রদায়। তাদের এতটাই অচ্ছুত গণনা করা হয় যে তাদের কোনো কিছু ছুঁতে পর্যন্ত দেওয়া হয় না। তারা যদি কোনো কিছু ছুঁয়ে দেয়, আমাদের মতে সেটাও অচ্ছুত হয়ে যায়। কিন্তু অস্ট্রেলিয়াতে আমার জানামতে প্লাম্বারদের ঘণ্টাপ্রতি বেতন অন্য সবার চেয়ে অনেক বেশি। আর এখানে তাদের সম্মানও আছে।

এই পেশাগুলোর একটা আলাদা নামও আছে ‘ট্রেডি’। এই ট্রেডিদের জীবনযাপন আমাকে খুবই আকর্ষণ করে। ওনাদের একটা বড় ইউট (ছোট ট্রাকের মতো যান) থাকে। যার পেছনে সব সরঞ্জাম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এক একটা ইউট যেন এক একটা অফিস। আর এক একজন ট্রেডি তিনি নিজেই তাঁর অফিসের বস। নিয়মিত সকাল সাড়ে সাতটায় কাজ শুরু করেন আর বেলা সাড়ে তিনটায় কাজ শেষ করেন। এর বাইরের সময়টুকু পরিবার–পরিজনের সঙ্গে কাটান। বছরান্তে ছুটি কাটাতে দেশে–বিদেশে ঘুরে বেড়ান। টাকা জমিয়ে আমাদের মতো প্রতিবছর বাড়ি কিনে মগজের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন না।

প্রবাসী বাংলাদেশি প্রজন্ম দেশ বদলালেও খাসলত বদলাননি। তিনি নিজে যেহেতু দেশে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে পারেননি, তাই ছেলেমেয়েকে এবার ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বেন। আর যাঁরা নিজেরা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার, তাঁদের নিজেদের স্ট্যাটাস ধরে রাখার জন্য হলেও ছেলেমেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতে হবে। এমনই একটা মনোবাঞ্ছা মোটামুটি সব প্রবাসী বাংলাদেশির মনেই কাজ করে। কারণ, তাঁদের ভাষ্যমতে ট্রেডি হলো ছোটলোকদের কাজ। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান, একটা দেশ চালাতে গেলে সব পেশারই মানুষের দরকার হয়।

শিশুরা বেড়ে উঠুক প্রকৃতির নিবিড় স্পর্শে

আর বর্তমানের এই পৃথিবীতে কোনো কাজকেই ছোট করে দেখার উপায় নেয়। যেমন এখানে যদি আপনি কোনো অফিসে ক্লিনিংয়ের কাজ করেন, তাহলে আপনাকে ততটাই সম্মান দেওয়া হবে, যতটা সেই অফিসের বস সম্মান পান। এবং তাঁরা আপনার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এটাও বলবেন: তোমরাই পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে মহৎ কাজ করছ; কারণ তোমরা না থাকলে এই পৃথিবীটা কবেই ডাস্টবিন হয়ে যেত।

যেহেতু ছেলেমেয়েদের ডাক্তার–ইঞ্জিনিয়ার বানাতে হবে, তাই সব অভিভাবকই তাঁদের সন্তানদের শ্যাডো এডুকেশনের ছুঁচোর দৌড়ে শামিল করে দেন। অস্ট্রেলিয়াতে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে বছর বছর কোনো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় না। অবশ্য প্রাইভেট স্কুলগুলোর কথা আলাদা বিশেষ করে প্রাইভেট মুসলিম স্কুলগুলো একেবারে যেন বাংলাদেশের স্কুলগুলোর অস্ট্রেলিয়ান সংস্করণ। এত বেশি হোমওয়ার্ক দেওয়া হয় যে বাচ্চাদের আর অন্য কিছু করার সময় থাকে না।

তবে চতুর্থ শ্রেণির পর একটা পরীক্ষা হয়, যার নাম ওসি (অপরচুনিটি ক্লাস) পরীক্ষা। এটাতে ভালো করলে ভালো স্কুলে প্লেসমেন্ট হয়। আর ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় একটা পরীক্ষা হয়, যার নাম সিলেকটিভ স্কুল টেস্ট, যেটাতে ভালো করলে সপ্তম শ্রেণিতে ভালো হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। এসব পরীক্ষা নিয়ে আমাদের অভিভাবকেরা একেবারে বাংলাদেশের মতো করে আদাজল খেয়ে লেগে থাকেন তাঁর সন্তানের পেছনে। এবং গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যদি এখানে কোনোভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস করার উপায় থাকত, ওনারা সেটারও চেষ্টা করতেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে বরাবরই মনে করি একটা বাচ্চাকে সব সময়ই স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে দেওয়া উচিত। তাদের ওপর বাড়তি চাপ দিলে কখনোই ভালো কিছু হবে না। হয়তোবা সে একদিন অনেক টাকাপয়সার মালিক হবে, কিন্তু সুকুমার গুণগুলোর আর বিকাশ ঘটবে না। যেটা বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ক্ষত। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মগজের ধারণক্ষমতা যখন বাড়বে, তখন সে এমনিতেই অনেক বেশি পড়াশোনার বোঝা নিতে পারবে। কিন্তু আমরা ছোটবেলা থেকেই বাচ্চাদের এর চেয়ে ওর চেয়ে ভালো করার প্রতিযোগিতায় নামিয়ে দিয়ে প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার পথ বন্ধ করে দিই।

আমাদের মেয়েটাকে আমি সব সময়ই চাইতাম একটা স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বড় করে তুলতে। প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার অনেকগুলো কারণের এটাও ছিল একটা কারণ যে ওরা প্রতিযোগিতাহীন একটা সুস্থ সুন্দর জীবন পাবে। তাই আমি কখনোই ওকে পড়াশোনা নিয়ে বাড়তি চাপ দিইনি। স্কুলে যা পড়ে আসে, তাই শেষ। পড়াশোনা নিয়ে বাসায় কোনো ঝামেলা করিনি কখনো। মেয়ের মা চাইলেও আমি ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতাম। ফলে সে পড়াশোনাটা করে নিজের খুশিমতো। এর ফলাফলও হাতেনাতে পাওয়া যেত। স্কুলে বছর শেষের অনুষ্ঠানে সেই সব বাচ্চার মা–বাবাকে চিঠি দিয়ে দাওয়াত করা হয়, যাদের ছেলেমেয়েরা কোনো না কোনো একটা পুরস্কার পায়। আমরা একবারই তেমন একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেবার সে স্কুলের লাইব্রেরি থেকে সবচেয়ে বেশি বই ধার নেওয়ার জন্য একটা পুরস্কার পেয়েছিল।

শিশুদের শৈশব হোক আনন্দময়

এরপর এল ওসি টেস্ট। সেখানেও মেয়েটা যথারীতি অংশ নিতে চায়নি। আমি বলেছিলাম শুধু অভিজ্ঞতার জন্য পরীক্ষাটা দাও। ফলাফল নিয়ে চিন্তা করো না। ফলাফল আমার ই–মেইলে এসেছিল এবং আমি সেই ই–মেইল ডিলিট করে দিয়েছিলাম। তারপর এল সিলেকটিভ স্কুল টেস্ট। যথারীতি মেয়ে বাগড়া দিয়ে বসল। এইবারও আমি বললাম অভিজ্ঞতাটা নিয়ে রাখো। এগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। এইবারও ফলাফল মোটামুটি পূর্বনির্ধারিতই ছিল। ফলে আমাদের বিভিন্ন হাইস্কুল বরাবর আবেদন করতে হলো। এতে একটা লাভ হলো। আমরা বাপ–বেটি গোটা তিনেক স্কুলে মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। আমি মেয়েকে বললাম, দেখো তুমি অন্যদের থেকে এগিয়ে গেলে। তখন সে জিজ্ঞেস করল কীভাবে? আমি বললাম এই যে তুমি ভাইভা দিলে। এখন তুমি জানো কীভাবে ভাইভা দিতে হয়। এই অভিজ্ঞতাটা ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।

আমি সব সময়ই চাইতাম মেয়েটার একটা আলাদা ব্যক্তিত্ব তৈরি হোক, যেন নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারে। ছোটবেলা থেকেই এই প্র্যাকটিসটা করার ফলে এখন আর তার ওপর কোনো কিছু সহজেই চাপিয়ে দেওয়া যায় না। বেশি চাপাচাপি করলেই সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এটা বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য আসলে খুবই জরুরি একটা বিষয়। কোনো মেয়েকে কোনো সিদ্ধান্ত যেন তার বাবা, মা বা ভাই চাপিয়ে দিতে না পারে। সেদিন মেয়ের মা বলছিল, যতই বড় হচ্ছে ততই বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, এটাই স্বাভাবিক কারণ ও একটা আলাদা সত্তা, ওর সবকিছুই হবে তোমার আমার চেয়ে আলাদা।

মেয়েটার বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাকে আমি সব সময়ই চাইতাম স্বাভাবিক রাখতে। সে যেন তার সহপাঠীদের সঙ্গে বন্ধুবৎসল আচরণ করে ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে। আমার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সে ভাবনা শেয়ার করে। এটা আমাকে খুবই আপ্লুত করে। মাঝেমধ্যে স্কুল থেকে ফিরে কোন সহপাঠী কী করেছে, তার বর্ণনা দিয়ে জিজ্ঞেস করে তার কী করা উচিত ছিল। আমি বলি, আসলে কোনো কিছুই আগে থেকে ঠিক করে রেখে করা যায় না। পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে হয়।

শিশুদের শৈশব হোক আনন্দময়

আর বন্ধুত্বের স্বরূপ বোঝাতে আমি একদিন বললাম, আমার যেমন চরম আস্তিক বন্ধু আছে, তেমনি চরম নাস্তিক বন্ধুও আছে। আমি এদের কাউকেই ত্যাগ করব না; কারণ তারা আমার বন্ধু। তাদের সব ভাবনার সঙ্গে হয়তোবা আমি সব সময় একমত না–ও হতে পারি, কিন্তু তাদের ছেড়ে যাব না। যদি ওদের কোনো মতের সঙ্গে আমার না মেলে, তাহলে আমি চুপ করে থাকব। আর একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, যদি কোনো মানুষ বিপদে পড়ে তাহলে তোমার সর্বোচ্চ সাধ্য অনুযায়ী তাকে সাহায্য করতে হবে।

আর লেখাপড়া নিয়ে আমার মতামত খুবই পরিষ্কার। এখানে ছেলেমেয়েরা হাইস্কুলে থাকতেই পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম কাজ করে। ফলে কোনো একটা ডিগ্রি যখন শেষ হয় পাশাপাশি চার–পাঁচ বছরের কাজের অভিজ্ঞতাও হয়ে যায়। ফলে পরবর্তী সময়ে যখন প্রফেশনাল জবে ঢোকে, তখন সহজেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে।

আর উচ্চতর শিক্ষাটা এখানে মোটেও বোঝা না। কেউ চাইলে ট্যাফে (টেকনিক্যাল অ্যান্ড ফারদার এডুকেশন) থেকে একটা কোর্স করে যেকোনো জীবিকা পছন্দ করে নিতে পারে। পরবর্তী সময়ে যদি তার আরও পড়তে ইচ্ছা করে তাহলে কাজের পাশাপাশি সেটাও করতে পারবে। আর এখানে কেউই সারা জীবন একই পেশায় কাজ করে জীবনটাকে পানসে বানিয়ে ফেলে না। বরং জীবনের যেকোনো পর্যায়ে গিয়েই একটা ডিপ্লোমা কোর্স করে পছন্দনীয় পেশায় কাজ শুরু করে।

যাহোক, এ বছর সে প্রাথমিক শেষ করে পরের বছর মাধ্যমিক শুরু করবে। বস্তুগত অর্জনের দিক দিয়ে দেখলে মেয়েটার তেমন কোনো অর্জন নেই। বছর বছর স্কুল থেকে একগাদা সার্টিফিকেট পায়নি। ওসি টেস্টে ভালো করে ভালো স্কুলে ক্লাস করেনি। সিলেকটিভ স্কুল টেস্টে ভালো করে ভালো স্কুলে মাধ্যমিক পড়ার সুযোগ পায়নি।

কিন্তু অন্য দিকের অর্জনগুলোও কি কম। সহপাঠীরা তাকে প্রচণ্ড রকমের পছন্দ করে। সে এ বয়সেই কয়েক শ বই পড়ে ফেলেছে আর সেটা অবশ্যই পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই, যেটাকে আমরা আউটবুক বলি। নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শিখে গেছে। আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণায় মেয়েটা মোটামুটি গোল্লায় চলে গেছে। আর এর পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার। তাই ইদানীং মাঝেমধ্যে নিজেকে প্রচণ্ড অপরাধী মনে হয়। মনে হয় আমি যেন একজন পুরোপুরি অপদার্থ বাবা।