এক জাপানি কলম

ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সামনে সাকুরাগাছ
ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সামনে সাকুরাগাছ

আমি তখন জাপানের রাজধানী টোকিওতে। ২০০৩ সালের এপ্রিল মাস, সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট। আমি টোকিও ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ‘ওকায়াম’ ক্যাম্পাসের সাকুরাগাছের নিচে বসে বিশ্রাম নিচ্ছি। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কফিব্রেকের সময়। তখনো হালকা শীতের আমেজ। আমার মতো আরও অনেক ছেলেমেয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে। একা একা বসে ভাবছি জাপানিদের কথা। কোথায়ও কোনো চিৎকার নেই, চেঁচামেচি নেই, মাস্তান নেই, মারামারি নেই, কীভাবে এটা সম্ভব!
হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার পাশেই পড়ে আছে খুব সুন্দর একটা কলম। ভাবলাম, কোনো একটা ছেলে বা মেয়ে হয়তো কলমটা আজকেই কিনেছিল। হারিয়ে ফেলেছে। হাত দেওয়া ঠিক হবে না মনে হয়। তাই মাথা একটু নিচু করে ভালোভাবে দেখলাম, এটা একটা মাল্টিকালার কলম, জাপানের তৈরি। কলমের গায়ে দামটাও পরিষ্কার লেখা, ৫০০ ইয়েন, মানে প্রায় ২৫০ টাকা (তখন এক ইয়েন সমান ৫০ পয়সা)। কফিব্রেকের সময় শেষ, কলমটা রেখেই ল্যাবে চলে গেলাম।

ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সামনে সাকুরাগাছ
ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সামনে সাকুরাগাছ


পরের দিন আবার সকালের বিরতির সময় সাকুরাগাছের নিচে কলমটাকে ওই অবস্থায় দেখতে পেলাম। অবাক হয়ে ভাবছি, এত সুন্দর একটা কলম, অথচ কেউ নিচ্ছে না! তখন মনে হলো আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাপানের) অফিস​কক্ষেও তো কেউ কারও জিনিস স্পর্শ করে না। জাপানে আমরা এক রুমে ১৪ জন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বসতাম। কোনো শব্দ ছিল না। কোন হইচই ছিল না। ১২ জন জাপানি, একজন কোরিয়ান আর আমি বাংলাদেশি। প্রতিদিন কফিব্রেকের সময় কলমটাকে দেখি। এভাবে পাঁচ দিন চলে গেল। বুঝলাম, ওর আসল মালিক ছাড়া কেউ ধরবে না।
সপ্তম দিনে খেয়াল করলাম, আকাশে বেশ মেঘ জমেছে। ভাবছি, বৃষ্টি হলে তো কলমটা নষ্ট হয়ে যাবে। কী করা যায়? শুনেছি, কলমের ক্ষমতা নাকি তলোয়ারের চেয়েও বেশি। কলমটা যারই হোক, এটা বাঁচানো দরকার। কলমটার ওপর একটা পলিথিন দিয়ে রাখলাম। এভাবে আরও এক দিন অপেক্ষা করলাম। মনে মনে ভাবছি, ওই মালিক মনে হয় আর আসবে না। এবার কলমটা হাতে নিয়ে কাগজের ওপর দাগ দিয়ে দেখলাম, ভালো আছে। একটু পানি ঢুকেছে। এভাবে থাকলে কলমটাকে আর বাঁচানো যাবে না। কী করা যায়, তা-ই ভাবছি।
নবম দিনে কলমটা পকেটে নিলাম। মহান প্রভুকে বললাম, ‘তুমি আমাকে ক্ষমা করো।’ আমি যে কলম ভীষণ ভালোবাসি, এটার ধ্বংস হতে দিতে পারি না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, টাকা না দিয়ে কলমটা ব্যবহার করব না। জাপানে ৫০০ ইয়েন দেওয়ার মতো কোনো ফকির পাওয়া গেল না। কলমটাও ব্যবহার করতে পারছিলাম না। সেপ্টেম্বরে ঢাকা পৌঁছেই ২৫০ টাকা এক ফকিরকে দিয়ে বিধাতার কাছ থেকে কিনে নিলাম জাপানি কলম।
রুহুল খান
ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, কানাডা