এক আশ্চর্য আনন্দ উৎসব
খরতপ্ত থাইল্যান্ড ভিজছে উৎসবের পানিতে। থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব ‘সংক্রান’। এটি পানি উৎসব নামেও পরিচিত। সৌভাগ্য বয়ে আনার উৎসবও বলা হয়। শুধু থাইল্যান্ডের অধিবাসীরা নন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটক ও থাইল্যান্ডে বসবাসকারী অন্য দেশের নাগরিকেরা সমান আনন্দ নিয়ে অংশগ্রহণ করছেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পানি উৎসবে। সরকারিভাবে ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল—এই তিন দিন উৎসব উদ্যাপন হয়। এ উৎসব আবার ক্ষেত্রবিশেষ ১০ দিনব্যাপী হয়ে থাকে। সংক্রান থাই নববর্ষকে স্বাগত জানানোর উৎসব। ছেলে-বুড়ো, দেশি-বিদেশি ও সব ধর্মের মানুষ অংশগ্রহণ করেন এই উৎসবে। এ সময় রঙিন থাইল্যান্ড আরও বর্ণিল, আনন্দময় ও বিনোদনময় হয়ে ওঠে।
থাইল্যান্ডবাসী হয়েও গত বছর পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন করতে ঢাকায় ছিলাম। এ কারণে সে বছর দেখা হয়নি সংক্রান উৎসব। এবার সংক্রান উৎসবে অংশ নিয়ে মিল পেলাম আমাদের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে। তবে দেশে ক্ষুদ্র জাতিসত্তা মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সংক্রানের সঙ্গে মিল খুঁজে পাবেন এই উৎসবের। কেবল থাইল্যান্ডই নয়, আশিয়ানভুক্ত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বোডিয়া আর চীনের দাই জাতিগোষ্ঠীরাও মেতেছে এই উৎসবে। তবে একেক দেশে এর একেক নাম।
সংক্রানের মূল উৎসব শুরু হয় থাইল্যান্ডের প্রাচীন রাজধানী আয়ুত্থায়া শহরে। সেখানে হাতির কুচকাওয়াজ, ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা আর জলকেলি করে তারা দিনটি উদ্যাপন করে। হাতির দেশ হিসেবে বিখ্যাত থাইল্যান্ডের আয়ুত্থায়ায় এখন সাজ সাজ রব। এখানকার হাতির আশ্রমগুলোর মাহুতরা ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁদের প্রিয় হাতিকে গোসল করিয়ে বিভিন্ন রঙে সাজাতে।
পূজা-অর্চনা, স্নানপ্রক্রিয়া ও আশীর্বাদ অনুষ্ঠানের পর দিনটির প্রধান আকর্ষণ পানিখেলা, পানিযুদ্ধ বা জলকেলি উৎসব। এ এক আশ্চর্য আনন্দ উৎসব। এই পানি উৎসবে নানান রঙে সজ্জিত হাতি মানুষের গায়ে পানি ছিটায়। মানুষও হাতির দিকে পানি ছোড়ে। হাতির দিকে পানি ছুড়লে হাতি রেগে যায় না, বরং আরও জোরে আপনার দিকে পানি ছুড়বে। পানির এই আনন্দ উৎসবে যোগ দেন হাজারো পর্যটক। শুধু মানুষের জন্য নয়, উৎসব প্রাঙ্গণে হাতির জন্যও থাকে নানা রকমের ফলমূল। এসব পেয়ে হাতিগুলোও আনন্দ নিয়ে ফল সাবাড়ে মেতে ওঠে।
পর্যটক আকর্ষণ করতে থাইল্যান্ডের যেকোনো উৎসবে হাতির উপস্থিতি অপরিহার্য। কিন্তু সম্প্রতি দেশটির হস্তী সংরক্ষণ সংগঠন হাতির পিঠে চড়ে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। হাতির পিঠে না চড়লেও উৎসব উদ্যাপন আনন্দে কারও একবিন্দু ভাটা পড়েনি।
হাতে পানিবন্দুক, গায়ে বাহারি ফুলেল পোশাক ও চোখে পানিচশমা পরে অংশ নিচ্ছে জলকেলিতে। এ সময় যাঁরা প্রথমবার এসেছেন এই দেশে, চমকে উঠছেন হঠাৎ গুলির আঘাতে! ভয় পেলেন নাকি, গুলি অবশ্য পানির। থাই ইমিগ্রেশন হিমশিম খাচ্ছে সংক্রান উপলক্ষে আসা পর্যটক সামলাতে। গত তিন দিনে প্রায় লাখো পর্যটক এসেছেন থাইল্যান্ডে। থাইল্যান্ডে, বিশেষ করে ব্যাংকক, পাতায়া ও ফুকেটের হোটেল, মোটেল, শর্টটার্ম ভ্যাকেশন হোম—কোথাও তিল ঠাঁই আর নাহি রে। এই এক সপ্তাহ ট্র্যাফিক জ্যামের শহর ব্যাংকক মোটামুটি ফাঁকা থাকবে। কারণ, সংক্রান পালনের জন্য অধিকাংশ মানুষ ব্যাংকক ছেড়েছেন গ্রাম ও মফস্বলে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে উৎসব উদ্যাপন করতে। যেন ঈদ উৎসব উদ্যাপনে ঢাকা ফাঁকা হয়ে গেছে।
থাইদের জন্য সংক্রান সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। উৎসবের আনন্দে আরও বাড়াতে দোকানে দোকানে চলছে বিশেষ উৎসব ছাড়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে নারী-পুরুষের ফুলেল পোশাক আর ওয়াটারগান বা পানিবন্দুক। সেই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে মুঠোফোন ও পাসপোর্ট রাখার বিশেষ পানিরোধক প্লাস্টিক ব্যাগ। বাংলার ঘরে ঘরে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে যেমন দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তুতি নেওয়া হয়, তেমনি থাইরা প্রস্তুতি নেয় সংক্রান উদ্যাপনের। বাংলাদেশের মতো ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার ভেতর দিয়ে থাইল্যান্ডে উদ্যাপন করা হয় সংক্রান। আমার মতে, ব্যাংককে বেড়ানোর এই হলো আসল সময়, কারণ পথে জ্যাম থাকে না, শপিংপ্রেমীরা দিলখুশ করতে পারবেন। কারণ, মলগুলোয় চলে বিরাট মূল্যছাড়।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্তি’ থেকে ‘সংক্রান’ শব্দের উৎপত্তি। যার বাংলা অর্থ ‘পরিবর্তন’ বা ‘রূপান্তর’। ভারতে মকরসংক্রান্তি থেকেই এই উৎসবের রীতি থাইল্যান্ডে এসেছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু থাইল্যান্ডবাসীর এ নিয়ে কোনো অনুযোগ নেই। নতুন বছরের শুরুর দিন তাঁরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে স্থানীয় মন্দিরে মিলিত হন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জন্য বিভিন্ন উপহার নিয়ে যান।
থাই বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, সংক্রানের সকালের আলো যাঁর শরীরে স্পর্শ করে, তিনিই পবিত্র হয়ে যান এবং তাঁর স্থান হয় বুদ্ধের চরণে। এদিনে তাঁরা বুদ্ধমূর্তির মাথায় পানি ঢালেন। সেই সঙ্গে চলে বয়োজ্যেষ্ঠ বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্নান অনুষ্ঠান। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, এই স্নানপ্রক্রিয়ায় ধুয়েমুছে যায় সব দুর্ভাগ্য আর নতুন বছরের জন্য বয়ে আনে সৌভাগ্য। সংক্রানের শরীর শুদ্ধিকরণ অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরেই শুরু হয় উৎসবের দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণী, শিশু-কিশোর—সবাই ব্যস্ত হয়ে যায় পানিখেলায়। বয়োজ্যেষ্ঠ বৌদ্ধসন্ন্যাসীদের অনেকেই মনে করেন, ধর্মীয় গুরুত্ব কমে পানিখেলার উৎসবই দিনে দিনে মুখ্য হয়ে উঠেছে থাইবাসীর কাছে। সন্ন্যাসীদের কথা অমূলক নয়, কারণ ছেলে-বুড়ো সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে পূজা শেষে পানিখেলা আরম্ভের। যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় একে অপরকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার। এরপর বিকেলের দিকে ওই মন্দিরেই পূজা-অর্চনার ব্যবস্থা করা হয়। সেই মন্দির থেকে পুরোহিত সবার মঙ্গলের জন্য বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করেন এবং আশীর্বাদপুষ্ট ফুল সবাইকে দেওয়া হয়। সেই ফুল বাড়িতে নিয়ে যায় থাইরা। সন্ধ্যায় বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা করে নতুন পোশাক পরে, আশীর্বাদের ফুল মাথায় ছুঁইয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে আশীর্বাদ নেওয়া সংক্রান উৎসবের একটি অন্যতম অংশ। এ সময় বড়রা বাড়ির ছোটদের বিভিন্ন উপহার দেয়।
সকাল থেকে পানিখেলা শুরু হয়। সন্ধ্যার পর পানিখেলা নিষেধ। দিনভর এ খেলায় লাখো থাইবাসীর সঙ্গে মেতে ওঠেন হাজার হাজার পর্যটক নারী-পুরুষ, শিশু কিশোর, বৃদ্ধ–যুবা। সরকার থেকে নির্ধারণ করে দেওয়া হয় শহরের নির্দিষ্ট কিছু পথে ও এলাকায় চলবে পানিখেলা; যদিও আবাসিক এলাকাগুলোয় প্রতিবেশীরা মিলে দিনভর উৎসব উদ্যাপন করে। পথের মোড়ে মোড়ে থাকে বন্দুকগুলোর পানি ভরার ব্যবস্থা। কেউ বিনা মূল্যে দিচ্ছে পানি, কেউ পানি বিক্রি করছে। ব্যাংককের বড় বড় মলে চলছে সংক্রান উদ্যাপন অনুষ্ঠান। রেস্টুরেন্টে ও বাড়িতে পরিবেশন করা হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী খাবার ও পানীয়।
লাখো মানুষের মুখরিত উৎসবে আমার দুটি ছোট মেয়েকে নিয়ে যেতে একটু বুক কাঁপেনি অজানা কোনো আশঙ্কায়। চিন্তা লাগেনি নিজের ও বাচ্চার শরীরে কারও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো স্পর্শের। সবার হাস্যোজ্জ্বল মুখ। নেই নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি (শুধু হুঁশিয়ারি মাতাল চালকদের জন্য। মাতাল চালকের কারণে মৃত্যু হলে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড)। বুকে ক্যাঙারুব্যাগে দুই মাসের বাচ্চা ঝুলিয়ে নবীন মা পানিবন্দুক নিয়ে সমানে যেমন পানি ছুড়ে মারছেন চেনা–অচেনা সবাইকে। তেমনি ৯০ বছরের বৃদ্ধাও এসেছেন ৭০ বছরে ছেলে, ৪৫ বছরে নাতি ও ১৫ বছরে নাতনিকে সঙ্গে করে, পানিযুদ্ধে অংশ নিতে। হিজাব পরা মেয়ে হেসে পানি খেলছেন সংক্ষিপ্ত পোশাক পরা ছেলেমেয়ের সঙ্গে সমানতালে। কেউ কাউকে অসম্মান করছে না। কেউ কাউকে কটূক্তি করছে না। কেউ কাউকে বাজে স্পর্শ করছে না। লাখো মানুষের আনন্দে উৎসবে কেউ পালিয়ে যাচ্ছে না মুখ ঢেকে, চোখে পানি নিয়ে।
আমাদের পয়লা বৈশাখ এমনই নির্মল হোক। সবাই উৎসবে মেতে উঠুক প্রাণখুলে সব শঙ্কা, দ্বিধা, ভয় দূরে ছুড়ে ফেলে।