এক অসাধারণ বাবার গল্প

প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত
প্রতীকী ছবি। সংগৃহীত

ছেলেটির বাবা সরকারি চাকরিজীবী। মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে পেস্টিং। চল্লিশ ও পঞ্চাশ দশকের কথা বলছি। তখনকার বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই অনুন্নত। তাই কালেভদ্রে বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের কাছে আসা হয়। ছেলেটাও তাই জন্মের পর বাবার সান্নিধ্য পায়নি বললেই চলে। তরপর এই বাবাও একদিন সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যান। তখন ছেলেটির বয়স মাত্র ছয়। সাত মাস বয়সী ছোট বোনসহ পরিবারে মা ও আরও তিন ভাই, বড় দুই বোন। পরিবারটিও যথেষ্ট সচ্ছল নয়। তাই বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের কষ্ট লাঘবের জন্য ছেলেটি চলে যায় তার ফুপুর বাড়িতে। এমনই শৈশবে বড় হওয়া ছেলেটি আমার বাবা, আমাদের চার বোনদের প্রিয় আব্বু।

আব্বু ছোটবেলা থেকেই কঠিন বাস্তবতা ও কষ্টের মধ্যে বড় হন। ম্যাট্রিক পাসের পর ঢাকায় এসে উপার্জনের চেষ্টা করেন। তারপর সরকারি চাকরিতে যোগদান ও বর্তমানে অবসর জীবনযাপন। কিন্তু এই আপাতদৃষ্টিতে গতানুগতিক জীবনচক্রে আব্বু কোনো গতানুগতিক ব্যক্তি নন। চার কন্যার জনক; কিন্তু কোনো দিন সমাজের অন্যান্যদের মতো একটি পুত্র সন্তানের আফসোস তার কোনো দিনই ছিল না, এখনো নাই। বরং হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসা বলে যদি কিছু থাকে, আব্বু তার কন্যাদের সেভাবেই ভালোবাসেন। তার কন্যারা সবাই বর্তমানে ত্রিশ ঊর্ধ্ব। তারপরও তাদের নাবালিকা জ্ঞান করে সেভাবেই ভালোবাসেন, যত্ন করেন। কিছু উদাহরণ না দিলেই নয়। এখনো সত্তর ঊর্ধ্ব বয়সে তার কন্যাদের বিশেষ অফিস মিটিং, বিশেষ অনুষ্ঠানে তার নিজ হাতে ইস্ত্রি করা কাপড় পড়ে যেতে হবে, কারণ এই কাজে তিনি খুব পারদর্শী, এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ছয় বছরের প্রবাস জীবনে প্রায় ফি-বছরই দেশে যাওয়া-আসা করেছি। প্রতিবারই লাগেজ গোছানো, প্রতিটি জিনিস শৈল্পিকভাবে বাঁধা, প্যাক করাসহ লাগেজ ওজন করে তৈরি করা অবস্থায় পেয়েছি। বিদেশে প্রতিটি ঈদে কন্যার জন্য নতুন পোশাক পাঠাবেন এবং এটা তাকে নিজেই পোস্ট করতে হবে। রমজান বা কোরবানির হাটের দীর্ঘ যানজটে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়েও এটা নিয়মিতভাবে করে আসছেন। এই ভালোবাসা তার প্রবাসী কন্যাকেও ছুঁয়ে যায়। সেও এটা দারুণভাবে অনুভব করে। তাইতো পাঠানো পোশাকের তার আব্বুর অনেক যত্ন করে করা প্যাকেটটিও সে সহজে ফেলতে চায় না। ফেলার সময় দুফোটা অশ্রুবিসর্জন হয়। ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি ঘর-গৃহস্থালির প্রতিটি কাজে আব্বুর সক্রিয় অংশগ্রহণ। তার নিজ মা-ভাই-বোনদের সামনে এসব কাজে কোনো দিন জড়তা দেখিনি। আম্মার ন্যূনতম কষ্ট ও অসুবিধা কখনো হতে দেন না। নিজের কোনো কাজ আম্মাকে বা আমাদের এখনো করতে দেওয়ায় অস্বস্তিবোধ করেন। যা বাংলাদেশি ছেলেদের সাধারণ চরিত্র নয়। শুধু তাই নয়, কন্যাদের জন্য বাড়ির ছাদে শীতের দুপুরে লেপ রোদ দিয়ে রাখেন এবং তার কন্যারা এই লেপের উষ্ণতায় তাদের আব্বুর ভালোবাসা অনুভব করে ঘুমাতে যায়। শীতের রাতে ফজর ওয়াক্তে নিজ হাতে ওজুর পানি গরম করা, তারপর সঠিক উষ্ণতার পানি রেডি করে কন্যাকে নামাজের জন্য ডেকে দেওয়া—এগুলো কিন্তু খুব সাধারণ মনোযোগ বা ভালোবাসা নয়। শক্ত আখ যা দাঁত কামড়ে খেতে তার স্ত্রী-কন্যাদের কষ্ট হতে পারে, তাই এটা নিজে ছোট টুকরা করে কেটে ফ্রিজে রেখে তারপর তাদের সামনে উপস্থাপন করা; আব্বু ছাড়া অন্য কেউ ভাবতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই। এ রকম অসংখ্য ব্যতিক্রমী উদাহরণ আছে। আমরা বলি ভালোবাসা-যত্নে আমাদের আব্বু সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল ও সৃজনশীল।
ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে অসম্ভব সৎ ও নির্লোভ এই মানুষটির তার কন্যাদের প্রতি কড়া নির্দেশ—যাই হোক বা করো না কেন কখনো মিথ্যা বা অসত্য বলবে না। সততার জন্য এই প্রাথমিক পাঠের যে কত বড় ভূমিকা তা এখন বেশি অনুভব করি। কারণ মিথ্যাই সকল অন্যায়ের জনক। কঠিন শাসন ও ভালোবাসা এই দুটির সমন্বয়ে কন্যাদের বড় করেছেন। তাই তার কন্যাদের ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনের এখন পর্যন্ত যেকোনো অর্জন, প্রশংসা শুধু তাদের একার নয়, তাদের আম্মা-আব্বুরও বটে। কন্যাদের পড়ালেখা ও ক্যারিয়ারের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ-প্রচেষ্টা যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটা আব্বু, আম্মাকে সঙ্গে নিয়ে করেছেন। সামাজিক গোঁড়ামি ভেঙে, ছেলেমেয়ের কাজের পার্থক্য না করে কন্যাদের আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর, উদ্যমী করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। যেকোনো কাজ যেটা শুধু পেশাগত নয়, যেমন দৈনন্দিন বাজার থেকে শুরু করে বাড়ি নির্মাণের সরঞ্জামাদি কেনা পর্যন্ত সবই তিনি কন্যাদের করতে উপযোগী করেছেন এবং সফলও হয়েছেন বলা যায়। কন্যার ইচ্ছার প্রতি প্রাধান্য দিয়ে বিয়ের যোগ্য কন্যাকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাঠিয়েছেন। তারপর কন্যার কৃতিত্বের সঙ্গে প্রেস্টিজিয়াস বার-এট-ল ডিগ্রি অর্জনে অন্যদের মতো আবেগের বাড়াবাড়ি নয়, বরং নফল নামাজের মাধ্যমে আল্লাহপাকের শোকরিয়া আদায় করেছেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল কন্যারা তাকে কোনো দামি ঘড়ি, জুতা, পাঞ্জাবি কিনে দিতে পারে না। কারণ তার এসব জাগতিক কিছুর প্রতি আগ্রহ নাই। তিনি অসমর্থ ও অসচ্ছলদের দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। তাই কন্যারা আব্বুকে ভালোবাসা ও সম্মান দেওয়ার চেষ্টাই করে। তিনি তার কন্যাদের এখনো সবচেয়ে প্রিয় সঙ্গী, সবচেয়ে নিশ্চিত আশ্রয়। তার কন্যারা তাদের ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনের সব ভালোমন্দ, সুখ-দুঃখসহ যেকোনো অভিজ্ঞতা তার সঙ্গেই শেয়ার করে, তার মতামতকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়।
আব্বুর ভালোবাসা শুধু তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সীমাবদ্ধ নয়; যেকোনো অসহায়, আর্তের সেবা (অপরিচিত হলেও সমস্যা নেই) আব্বুর মতো কেউ করতে পারবে না। গ্রাম থেকে রোগী এনে হাসপাতালে ভর্তি, সীমিত আর্থিক সামর্থ্যের মাঝেও তাদের চিকিৎসার চেষ্টা, তাদের নিয়মিত সেবা, পরিচর্যা, রক্তদান ইত্যাদি করেছেন। ঈদের পরের দিন টিফিন ক্যারিয়ারে করে যে কোনো হাসপাতালে খাবার নিয়ে গেছেন। এখনো এই বয়সে এলাকায় বা পরিচিত কেউ অসুস্থ হলে প্রতিদিন নিয়ম করে দেখতে যান, সাহস দেন। এলাকায় এমন কোনো বাড়ি নেই যাদের আব্বু গাছ নিজ হাতে লাগিয়ে দেন না বা গাছের চারা তৈরি করে এবং নিজ গাছের ফল, সবজি বিতরণ করেন না। তাদের যেকোনো বিপদে সবার আগে পাশে দাঁড়ান। সবাইকে সব সময় সবচেয়ে সৎ উপদেশ প্রদান করেন। শুধু তাই নয় এলাকার কোনো বিড়াল, কুকুর এমনকি পাখিরাও তার স্নেহ বঞ্চিত নয়। বিড়াল, কুকুরদের জন্য বাজার থেকে খাবার আনা, ছাদে সব সময় পাখিদের জন্য খাবার ও পানি রাখা আব্বুর প্রতিদিনের রুটিন।
পৃথিবীর সব বাবাই শ্রেষ্ঠ বাবা; সব বাবাই তার সন্তানদের সর্বোচ্চ ভালোবাসেন। তারপরও ভালোবাসার একাগ্রতা বা মনোযোগ, যত্ন ও প্রকাশ ভঙ্গিতে পার্থক্য থাকে। মাত্র ছয় বছর বয়েসে পিতৃহীন, পরবর্তীতে নিজ পরিবারের সান্নিধ্যহীন হয়ে বড় হওয়া এই ব্যক্তিটি কীভাবে এত যত্নশীল, এত আধুনিক, এত বেশি সংবেদনশীল, এত প্রগতিশীল আর কীভাবে সত্যিকারভাবে সু ও স্বশিক্ষিত—এই প্রশ্ন আব্বুকে অনেকবারই করেছি। আব্বু প্রতিবারই হেসে বলেন, এটা শুধু আমার মনের ভাবনা, আসলে আব্বু খুব সাধারণ। কিন্তু আব্বু কী শুধুই সাধারণ, কখনোই না। এটা আমাদের কথা নয়; আত্মীয়-পরিজন ও প্রতিবেশীদের কথা। তারা বলেন, কন্যা সন্তানের জনক হয়েও আমাদের আব্বুর মতো করে কাউকে মেয়েদের এত ভালোবাসা-যত্ন করতে পারেনি বা করতে দেখেননি। সুতরাং আমরা যেন আব্বুর প্রতি সেরকমই ভালোবাসা প্রকাশ করি ও যত্নশীল হই। তাদের এই উপলব্ধি ও উপদেশ আমাদের একই ভাবে গর্বিত ও সচেতন করে। আব্বুকে নিয়ে কথা, লেখা শেষ হওয়ার নয়, তবুও অত্যন্ত পরিচিত একটি বাণী দিয়ে শেষ করছি। সেই উত্তম, যে তার পরিবারের কাছে উত্তম—আমাদের আব্বু উত্তম, অতি উত্তম; আমাদের কাছে, সবার কাছে। মহান আল্লাহ তালা আমাদের আব্বুকে সুস্থ রাখুন, হায়াত দান করুন, আমাদের তার সেবা করার তৌফিক দান করুন।