এই শহরে একা

সিডনি শহর। সংগৃহীত
সিডনি শহর। সংগৃহীত

প্রথমে সিডনি শহরটা আমার একদম ভালো লাগেনি। কারণ? অনেক ঘুরেছি আমি। বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে। আসলে বলতে চেয়েছিলাম এই এতটুকু বয়সে আমি পৃথিবীর অনেক বড় বড় নগর দেখে ফেলেছি এবং সেই সব বিচিত্র নগর আমাকে দুই দণ্ড শান্তিও দিয়েছিল।

সিডনি শহরটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিল আমার কাছে। ইউরোপের যে কোনো নগরের সঙ্গে তুলনা করলে বড় একটা ধাক্কা খেতে হয়। রাত নয়টার সময় সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের বাইরে দাঁড়ালে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়। অথচ এটা সিডনির একদম হৃৎপিণ্ড।
এই শহরে আসার দ্বিতীয় দিন মাসকট নামে একটা জায়গায় যেতে হয়েছিল। সেটা ছিল শনিবারের রাত। মাত্র আটটা বাজে। বিশাল একটা বাসে আমি একমাত্র যাত্রী। বিশ্বাস হয়? মনের সুখে বাস চালাচ্ছিল ড্রাইভার। লোকটা বেশ বুড়ো। বাংলাদেশ হলে বাতের ব্যথায় বিছানায় শুয়ে কোঁকাত। ছেলে, ছেলের বউ আর নাতিপুতিদের জ্বালিয়ে মারত হয়তো। মাসকট শপিং সেন্টারে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বিশাল বাসটা ভুস করে হারিয়ে গেল পথের বাঁকে।
সেখানে অনেকগুলো অচেনা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে হাত ধরাধরি করে। আপনজনের মতো। কী গাছ কে জানে। পাতাগুলো তেজপাতার মতো। এবার আতঙ্কের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম একটা ভুতুড়ে শহরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। একা। রাত নয়টার মধ্যে যে কোনো শহর এমন বিজনপুরী হয়ে যায় ধারণাই ছিল না। কোথাও কেউ নেই। চারিদিকে টানা দোকান। বন্ধ। রাস্তায় আমাদের দেশের মতো একটা কুকুরও নেই। দূরে একটা Pub তখনো খোলা। ভেতরে গানবাজনা হচ্ছে। কয়েকজন অলস মাতাল বিয়ার গিলছে জগ ভর্তি আর টিভি দেখছে।
টানা দেড় বছর মাসকটে ছিলাম। চমৎকার জায়গা। দিনের বেলা সবাই পিঁপড়ের মতো ব্যস্ত। রাতের বেলা মৃত্যুপুরী। প্রথম দিকে খুবই বিরক্ত লাগত। এক সময় দেখলাম নিঝুম পরিবেশে থাকতে থাকতে এমন হয়ে গেছি, লোকজনের ভিড় আর ভালো লাগছে না। এদের প্রত্যেকটা ছোট শহর পরিকল্পিতভাবে সাজানো। মাসকট, রেডফার্ন, ইস্টলেক, রকডেল, ক্রো নেস্ত, হাস্তভিল—যেখানেই যান না কেন আপনি যা যা পাবেন তা হলো; একটা পাব, নাপিতের দোকান, ডাকঘর, মাংসের দোকান, পুরোনো জিনিসপত্রের দোকান, কফি শপ, রুটির দোকান, একটা এশিয়ান দোকান, সেটা ভারতীয়, চাইনিজ বা থাইল্যান্ডের হতে পারে। একটা ব্যাংক, পিৎজার দোকান, ফুলের দোকান আর বটল শপ।
বটল শপ (Bottle shop) নামটা বেশ অদ্ভুত মনে হয়েছিল আমার কাছে। এরা কী শুধু বোতল বিক্রি করে নাকি? বোতলের ভেতরে কী থাকে? বিদেশি একটা গল্প পড়েছিলাম। বোতলভর্তি ভূত বিক্রি করে অমন দোকানে। পরে দেখি আসলেও তাই। এরা বোতল ভর্তি ভূতই বিক্রি করে। মানে এরা আসলে সব ধরনের মদ-বিয়ার-ওয়াইন এই সব বিক্রি করে আর কী। তবে নিয়ম আছে ১৮ বছরের নিচে হলে আপনি ওই বটল শপে ঢুকতে পারবেন না।
বাঙালিরা বটল শপের ভেতর ঢুকে মুখটা কাঁচুমাচু করে চোরের মতো বের হয়। চারিদিকে সতর্ক দৃষ্টি। বাদামি কাগজে মোড়া ঢাউস বোতলটা নানা কায়দা করে লুকানোর চেষ্টা করে। দেখলে মজা লাগে। আবার অনেককে দেখি মদের বোতল হাতে করে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বের হয়। ভাবখানা কোন শালায় কী বলবে, অ্যা? নিজের পয়সায় মদ খাই।
সিডনি শহরের বেশির ভাগ বাঙালিই একটু বাতিকগ্রস্থ। প্রথম পরিচয়েই কমন কিছু প্রশ্ন করবে আপনাকে। কত দিন হলো এই দেশে? কোথায় কাজ করেন? বেতন কত? কাগজপত্র হয়েছে? বাড়ি কিনেছেন? ব্যাপারটা যে স্থূল সেটা জানার মতো ভদ্রলোক বোধ হয় তেমন নেই এই শহরে। লজ্জা দিয়েও লাভ হতো না। আরও মজার হলো যারা পরিষ্কার করার কাজ করে তারা সবাই দাবি করে সরকারি চাকরি করে।
একবার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। বেচারা জানালেন উনি এখানের কোনো একটা বাংলা পত্রিকার কলামিস্ট। বেশ অবাক হলাম। একটা বাংলা পত্রিকা মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ কপি ছাপা হয়। তাতে কলাম লিখে ওনার চলে কী করে? পত্রিকার কর্তৃপক্ষ তাকে কত সম্মানী দেয়? মাস ছয়েক পর সেই কলামিস্ট সাহেবকে দেখি, নামকরা এক শপিং সেন্টারের মেঝে পরিষ্কার করছেন। আমাকে দেখে চিনতেই পারলেন না। অথচ সে সময় আমি কোনো মুখোশ পরে ছিলাম না। এরপর অনেকবার অনেক জায়গায় দেখা হয়েছিল সেই কলামিস্টের সঙ্গে। আমার সঙ্গে আর কথা বলেননি তিনি। বেচারা!
আচ্ছা এই ব্যাপারগুলো বরং বাদ দিই। আমি বলতে যাচ্ছিলাম প্রাচীন নিনেভের মতো অথবা ব্যাবিলনের মতো সুন্দর এই শহরটার কথা। সিডনি শহর জেগে ওঠে খুব ভোরে। সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ভোর চারটা বাজেই ওদের প্রথম ট্রেন ছাড়ে। অনেক নাম করা কফিশপ এই সময় খুলে খদ্দের ধরার জন্য। প্রচণ্ড শীতের রাতগুলোতে এক ফালি কেক আর ঘন দুধের ফ্যাট হোয়াইট কফি দিয়েই শুরু হয় অজিদের কর্মব্যস্ততা। তবে সত্যি বলতে কী, এই সময় যারা কাজে যায় তারা আসলেই বড় দুর্ভাগা। এরা সবাই বড় বড় অফিস পরিষ্কারের কাজ করেন।
সকাল ৮টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বাস আর ট্রেন মুড়ির মোয়ার মতো ভর্তি থাকে মানুষে। বেশ গাদাগাদি অবস্থা। আমাকে যেতে হয় টাউন হলে। সিডনির সবচেয়ে ব্যস্ততম রেলস্টেশন। পুরো স্টেশনটাই মাটির নিচে। নইলে গুলিস্তানের চেয়েও বিচ্ছিরি হতো জায়গাটা। টাউন হলের ওপরটা বেশ সুন্দর। বেশ কিছু কলেজ আছে এখানে। অনেক বাঙালি পেতাম এই জায়গায়। তাদের কেউ কেউ শীতে ঠকঠক করে কাঁপছেন আর অস্ট্রেলিয়ার চৌদ্দ গুষ্টির বদনাম করছেন। বলছেন, অস্ট্রেলিয়ার পারমানেন্ট রেসিডেন্ট শিপ পেলেই প্রস্রাব করে বাংলাদেশ চলে যাবেন। কী দারুণ কৌতুক। বিশ্বাস করার কোনো মানেই হয় না। টাউন হলে একটা ২ ডলার শপ আছে। এই দোকানের যে কোনো জিনিস ২ ডলার করে। সারা বছর চুটিয়ে ব্যবসা করত ওরা। এক চাইনিজ বুড়ো ক্যাশে বসে থাকত। একটাই ইংরেজি জানত সে, তু (টু) দালার (ডলার)। ব্যস শেষ।
সারিহিল নামে দারুণ একটা জায়গা আছে আমার বাসার সঙ্গে। রেড ফার্নের ক্লিভল্যান্ড সড়কটা ধরে সোজা হেঁটে গেলেই শেষ মাথায় সারিহিল। সন্ধ্যার পর হাঁটলে মনে হয় ভারতের কোনো শহরে হাঁটছি। অনেকগুলো ভারতীয় রেস্টুরেন্ট আছে এই সড়কে। আছে মসলা আর ভিডিওর দোকান। মুদির দোকানও আছে বেশ কয়েকটা। একটা মিষ্টির দোকানে পিঁপড়ের মতো মানুষ ভর্তি। একটা রসগোল্লার দাম ৩ ডলার। সঙ্গে দুই চামচ গরম সিরা দেয়। ভেতরে হিন্দি গীত মালা টাইপের ভিডিও চলে সারাক্ষণ। নিবুরা নিবুরা নিবুরা, হেই কাঁচা কাঁচা ছোঁটা ছোঁটা নিবুরা আনে দাঅ...। হেন তেন।

সেন্ট্রাল স্টেশনের ভেতরের দৃশ্য
সেন্ট্রাল স্টেশনের ভেতরের দৃশ্য

ঠিক দুপুর বারোটার সময় অফিস আদালতগুলোতে লাঞ্চ টাইম দেওয়া হয়। এই সময়টায় চারিদিকে বেশ দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার ঘটে যায়। খাবারের দোকানের সামনে প্রচণ্ড ভিড় আর লম্বা লাইন। সবাই ছোটে সস্তায় কিছু পেটে দেওয়ার জন্য। অস্ট্রেলিয়ানরা দামাদামিতে পটু। মদ বা বিয়ার কেনার সময় দাম নিয়ে এদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু দুপুরের খাবারের সময় এরা সস্তা তো খোঁজেই আবার দামাদামিও করে বেশ। সম্ভবত চাইনিজদের কাছ থেকে অভ্যাসটা পেয়েছে। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত রাস্তায় তেমন লোকজন থাকে না। যা থাকে তা হলো-নতুন আসা ছাত্র-ছাত্রী, টুরিস্ট, ভবঘুরে আর বেকার।
সিডনির আসল রূপ শুরু হয় বিকেলের পর থেকেই। অফিস ছুটির পর হুড়মুড় করে সবাই যখন বেরোতে শুরু করে। টাউন হলের স্টেশনটা আবার নরক গুলজার হয়ে যায়। স্টেশনের পুলিশগুলো তখন ব্যস্ত হয়ে পরে টিকিটবিহীন যাত্রীদের ধরার জন্য। বিপুলসংখ্যক অস্ট্রেলিয়ান কোনো এক কারণে টিকিট ফাঁকি দিতে চায়। এর মধ্যে তরুণেরাই বেশি।
বিকেল আর সন্ধ্যার পরই জমে উঠে সিডনি। ক্যাফেগুলোর সামনে বাড়তি চেয়ার রাখা হয়। কাবাবের দোকানের সামনে ঝুলতে থাকে মসলা মাখানো নতুন মাংস। সুন্দর করে সাজিয়ে রাখে ফালি করে কাটা লাল টমেটো, গোলাপি পেঁয়াজ, সবুজ পারসলে (parsley) আর হলুদ পনির। সিনেমা হলের সামনে পপ কর্ণ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অল্প বয়সী ছেলে মেয়েরা। সবাই খুশি। হাসছে।
টাউন হল থেকেই টানা চলে গেছে জর্জ স্ট্রিট। দুটো বিশাল গেম জোন আছে এখানে। সারাক্ষণ গোলাগুলির শব্দ আর রেসিং কারের কর্কশ শব্দে নরক গুলজার। ভেতরে বিশাল সব পর্দা সব ভিডিও গেম। খেলোয়াড়দের হাতে পিস্তল বা রাইফেল থাকে। ফলে খেলাটা বাস্তব মনে হয় বেশ। পর্দার শত্রুকে গুলি করার পর বেচারা চিৎকার করে যখন অক্কা পায় তখন কেমন একটা জোশ এসে যায়। মনে হয় সবাইকে মেরে ফেলি।
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে অনেকগুলো বিখ্যাত গে ক্লাব আর বার আছে। কতগুলো ছেলে হাত ধরাধরি রোমান্টিক মুডে বসে আছে দেখলেই বিরক্ত লাগে। তার চেয়েও বেশি বিরক্তকর প্রতি দশ কদম পর পর একটা করে অ্যাডাল্ট শপ। এই সব দোকানের ভেতরে কী কী পাওয়া যায় সেটা আর বললাম না। ভাববেন, অহ মিলন ভাই আপনিও...। আপনি নিজে গিয়ে দেখে আসবেন সেটাই ভালো।
অপেরা হাউজ আর হারবার ব্রিজের এলাকাটা এই সময় বেশ সুন্দর জায়গা। কত মানুষ যে আসে এখানে। সবার হাতেই ক্যামেরা। দুই-চারজনকে দেখি প্রায় জাইঙ্গা পড়া অবস্তায় দৌড়াচ্ছে। এরা বেশ স্বাস্থ্য সচেতন। অপেরা হাউস আর হারবার ব্রিজের এলাকায় শেষ বিকেলেই যাওয়া ভালো। শীতের অনেক কমলা রঙের সন্ধ্যায় এক কাপ কফি হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি। সামনে টালমাটাল তাসমান (Tasman) সমুদ্র। ডানদিকে অপেরা হাউস আর বামে হারবার ব্রিজ। কতগুলো মাছ খেকো পাখি একটা মরা মাছের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। প্রত্যেকে দাবি করছে মাছটা ওর। ফাটা গলায় চিল্লাচ্ছে—আমার, আমার, আমার।
এক দঙ্গল বুড়োবুড়ি বুনো কবুতরদের পাউরুটি খাওয়াচ্ছে। প্রচুর খাবার পেয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বাকবাকুম করছে কবুতরগুলো। সন্ধ্যার পর দূরের দালানবাড়ির সবগুলো আলো জ্বলে ওঠে। লাল-নীল-কমলা-হলুদ। দামি রেস্টুরেন্টে জোড়ায় জোড়ায় বসে থাকে অপূর্ব সব নর-নারী। নানান বয়সের। ওদের হাতে থাকে নীল রঙের মদ। কাচের পানপাত্র ভর্তি ঘাস ফড়িঙের মতো কোমল সবুজ রঙের পানীয়। সামনের সাদা তস্তরিতে থাকে কুইন্সল্যান্ড থেকে ধরা লাল রঙের গলদা চিংড়ি।
মাসকটে থাকতে একটা সমস্যা হতো। রাতেরবেলা বাস পাওয়া যেত না। ট্যাক্সিতে করে ফিরতে হতো রাতের পর রাত। ১৮ থেকে ২০ ডলার চলে যেত। তাই সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে ক্লিভল্যান্ডে চলে এলাম ২০০৫ সালের মার্চে। কেমন নিঝুম আর পুরোনো একটা বাড়ি পেলাম। ৯/২০৯। আমার অনেক লেখায় এই বাড়িটার কথা এসেছে। যদি অনন্তকাল বাঁচি তবে মনে থাকবে। বাড়িটার সামনে হাত পা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল একটা বিশাল আমগাছ। পোড়া তামার ফলকের মতো আম গাছের কচি পাতাগুলো। আর ছিল একগাদা কাঠ গোলাপের ঝাড়। ঋতু পরিবর্তন হলেই মাথার ওপর চাঁটি মারত পিচ্চি পিচ্চি আম। আর বসন্তকালে কাঠ গোলাপের মিষ্টি ঘ্রাণ পাগল বানিয়ে ফেলত আমাকে। প্রায়ই মনে হতো আধ পাগল হয়ে নেংটা হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ট্রাফিক কন্ট্রোল করব না তো? ভাগ্য ভালো সে রকম কিছু হয়নি।
আমাদের বাড়ির সামনেই ছিল বিশাল একটা পার্ক। সিডনির প্রতিটা মহল্লাতেই এমন বড় সাইজের পার্ক আছে একটা করে। সেখানে বড় বড় অনেক গাছ দাঁড়িয়ে থাকে। শীতের দিনগুলোতে এত শুকনো পাতা ঝরে যে, হাঁটা মুশকিল হয়ে যায়। মনে হয় বাকরখানির ওপর দিয়ে হাঁটছি। সরকারি লোকজন এসে ঝরা শুকনো পাতা নিয়ে যায় ওদের গাড়ি ভর্তি করে। পার্কে বেশ কয়েকটা কাঠের বেঞ্চি আছে। পাশেই পুরোনো একটা গির্জা। প্রত্যেক রোববার সকালে গির্জার ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভাঙে। দূরে একটা বাস্কেট বল খেলার কোট। বিকেল থেকে মধ্য রাত পর্যন্ত অনেক ছেলেমেয়ে বাস্কেট বল খেলে ওখানে।
মাঝে মধ্যে অনেক রাতে এসে বসি পার্কের বেঞ্চিতে। দূরের দালান বাড়িগুলো খুব সুন্দর দেখায়। স্টেশনের বড় ঘড়িটা দেখা যায় এত দূর থেকে। হাতে গুড়ের রঙের মতো ঠান্ডা বিয়ারের বোতল নিয়ে ভাবি, বিচিত্র এই শহরটাতে একদম একা আমি। খুব যে খারাপ আছি তা বলব না। ভালোই তো। তারপর চুমুক দিই বিয়ারের বোতলে। যেটার স্বাদ একদম বাচ্চাদের প্রস্রাবের মতো।

সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরের দৃশ্য
সেন্ট্রাল স্টেশনের বাইরের দৃশ্য


দিনগুলো কাটে ব্যস্ততার মধ্যে। শালগম আর গাজরের মৌসুমে খরগোশ যেমন ব্যস্ত থাকে। মরারও সময় নেই। কোনো দিন যদি যমরাজ এসে হাজির হয় বিনয়ের সঙ্গে বলতে হবে, দয়া করে অন্য একদিন আসুন প্লিজ।
মাসকটে থাকতে পুরোনো দোতলা একটা কাঠের বাড়িতে থাকতাম। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম থেকে উঠতে হতো। কারণ ঠিক নয়টায় কাজ। বাইরে ভয়াল শীত। চমৎকার একটা হট শাওয়ার নিয়ে পর পর দুই মগ মোকা কফি গেলার পর শীতটা তত খারাপ লাগত না। বেশ চনমনে একটা ভাব চলে আসত। নীল জিনসের জ্যাকেটটা গায়ে দিতে দিতে বাইরে বের হয়ে পড়তাম। বাড়ির বাইরে মাত্র দশ কদম পরই বাস স্টেশন। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হতো কিছুক্ষণ। অনেকেই অপেক্ষা করত আমার মতো। স্কুলের কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়েও দাঁড়িয়ে থাকত।
ড্রাইভারের পাশেই একটা বাক্স টাইপের যন্ত্র। এর ভেতরেই টিকিট গুঁজে দিতে হতো। কিটকিট শব্দ করে নিজের পাওনা বুঝে নিত যন্ত্রটা। এই টিকিটগুলোকে বলে ট্রাভেল টেইন। মোট দশবার পাঞ্চ করে ব্যবহার করা যায় টিকিটটা। বাসে করে বন্দাই জংশন যেতে হতো। পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট লাগত। অদ্ভুত কোনো এক কারণে বাসে উঠেই ঘুমিয়ে যেতাম। মুখ দিয়ে মিষ্টির সিরার মতো লালা ঝরতে থাকত। মাঝে মাঝে তন্দ্রা ভেঙে গেলে দেখতাম বাসটা কোথায় এল? বাসটা যখন বন্দাই জংশনে (Bondi Junction) গিয়ে থামত তখন ঘড়িতে নয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। পাগলের মতো দৌড় দিতাম বাস থেকে নেমে। কাঁটায় কাঁটায় নয়টায় আমার কাজ শুরু। দেরি হলে কপালে খারাপি আছে।
বাস স্টেশনের পাশেই বিশাল একটা শপিং সেন্টার। নাম ওয়েস্টফিল্ড শপিং সেন্টার। এর ছয় তলায় আমাদের রেস্টুরেন্ট। নাম-ডি কষ্টি (De Costi)। সারা সিডনিতে এর ভয়াবহ নামডাক। আমাদের রেস্টুরেন্টের একটু সামনে চকলেট ক্যাফে নামে দারুণ একটা দোকান আছে। চমৎকার কফি আর হরেকরকম চকলেট বানায় এরা। এখান থেকে মাঝারি মাপের একটা মোকা কফি যখন হাতে নিই তখন ঘড়িতে নয়টা বাজার আরও এক মিনিট বাকি। কাঁটায় কাঁটায় নয়টায় ঢুকি রেস্টুরেন্টের ভেতর। শুরু হয় আমার দিন।
সি-ফুড রেস্টুরেন্টে কাজ অনেক। আপনার কী ধারনা, আমার চেহারা দেখে খদ্দেররা পয়সা ফেলে? প্রচুর মাছ কাটতে হয়। মাছের সুন্দর সব ফালি করতে হয়। স্যামন, বারামানডি, সোর্ড ফিস, লেমন সোল, টুনা, জনডরি আরও অনেক কিসিমের মাছ। খেয়াল রাখতে হবে কোনো ফালিতে যেন ভুলেও কাঁটা না থাকে। সালাদ বানানোর জন্য আর গ্রিল করার জন্য কমপক্ষে ৫০ থেকে ৬০ কিলো বাচ্চা অক্টোপাস সেদ্দ করতে হবে। ৪০ থেকে ৫০ কেজি স্কুইড কেটে রিং করতে হবে কালামারি বানানোর জন্য। পাইন অ্যাপল কাট দিয়ে আরও ৩০ কেজি স্কুইড কাটতে হবে। শসা কাটতে হবে ২০ কেজি, টমেটো ২০ কেজি, গাজর ৫ কেজি, বাঁধাকপি তিন্তে...। তালিকাটা সম্পূর্ণ করলাম না। আপনি পাগল হয়ে যেতে পারেন।
সকাল ১১টা থেকে খদ্দের আসা শুরু করত। শুরু হতো আমাদের দৌড়-ঝাঁপ-নিক্ষেপ। আমাদের ছিল ওপেন কিচেন। মানে খদ্দের দেখতে পেত তার অর্ডার দেওয়া খাবার কীভাবে রান্না করছি। এক গাদা মানুষ সব সময় চেয়ে থাকত আমাদের কিচেনে। কাজেই একটু ভালো কর্মদক্ষতা দেখাতে হতো। সুন্দরী খদ্দের এলে একটু ভাব ধরতাম। গ্রিলের রান্না আমি করতাম। আর কালিয়ান নামে এক ভারতীয় ছোকরা ডিপ ফ্রাইয়ারের কাজ করত। মানে আলু ভাঁজা হতো ডুবো তেলে। ভাঁজা মাছ, চিংড়ি আর স্কুইডও করে দিত।
আয়ারল্যান্ডের দুই মেয়ে ছিল। একদম বুকে চাক্কু মারা সুন্দরী। ওরা খদ্দেরকে ডেকে হাতে খাবারের প্লেট আর পানীয় তুলে দিত। খাবারের দাম নিত।
মাইকেল তাতাভস্কি নামে রাশিয়ান একটা বাবুর্চি ছিল। ওর কাজ ছিল সারাক্ষণ আমাদের ধাতানি দেওয়া। এই মাইকেল তাতাভস্কি ছিল ভীষণ রকম ত্যাদড়। সারাক্ষণ নানান কায়দা করে আমাদের শাস্তি দিত। আর রেস্টুরেন্টের মালিক জর্জ কস্তির কাছে আমাদের নামে নালিশ করত, আমরা নাকি অলস। নড়তে চড়তে দিন শেষ করে ফেলি। হেনতেন। আরও বিচ্ছিরি রকমের একটা ফাজলামি করত। সেটা হলো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমরা একটা করে কোকের ক্যান খুলে নিয়ে পান করতাম। এক ঢোক কোক গিলে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়তাম রান্না করতে। কারণ নতুন নতুন অর্ডার আসছেই। আমরা মানে আমি আর কালিয়ান যখন রান্নায় ব্যস্ত তখন মাইকেল তাতাভস্কি কোকের ক্যানের ভেতরে কায়দা করে এক চামচ লবণ ঢুকিয়ে দিত। ব্যস্ততার মধ্যে অন্যমনস্ক ভাবে যখন কোকের ক্যানে চুমুক দিতাম নোনা বিস্বাদ কোক হঠাৎ গিলে বিষম খেতাম। আর এই দৃশ্য দেখে ঠা ঠা করে হাসতে হাসতে কুটিপাটি হওয়ার দশা হতো মাইকেলের। দারুণ আনন্দ পেত রাশিয়ানটা। বাধ্য হয়ে অবশিষ্ট ক্যানটা ফেলে দিতে হতো। নতুন করে কিনতে হতো আরেকটা। কিছুই বলতে পারতাম না ওকে। মালিকের প্রিয়পাত্র। ডান হাত।
প্রায় মাস খানেক এই ভাবে চলল। তারপর সুযোগ এল। মাইকেলের কোনো বান্ধবী ছিল না। ওর কুৎসিত চেহারা আর হাড় কেপ্পন স্বভাব এই জন্য দায়ী। তারপরও একটা সুন্দরী খদ্দেরের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ ধরে বেশ একটা আশনাই চলছে ওর। কত দূর কী এগিয়েছে জানি না। তবে মেয়েটা বেশ হেসে হেসে কথা বলে ওর সঙ্গে। অন্য দিনের মতো সেদিনও এল মেয়েটা। গ্রিল করা অক্টোপাস ভাজা আর কচি পালং শাকের সঙ্গে ফেতা (feta) চিজ দিয়ে খায়। মাইকেল তখন নিজের কোকের ক্যানটা খুলে এক চুমুক খেয়েছে। মেয়েটাকে দেখামাত্র ক্যানটা এক পাশে রেখে তড়াৎ করে গিয়ে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। খাবারের অর্ডার নিতে। অন্য কোনো খদ্দেরের অর্ডার সে নেয় না। শুধুমাত্র এই মেয়েটার।
কাজে লেগে গেলাম আমি। মাইকেলের কোকের ক্যান অর্ধেক খালি করলাম ফেলে দিয়ে। কায়দা করে ভরলাম জলপাই তেল, কালো ঘন বালসামিক ভিনেগার, লবণ, সরষে বাটা, আর প্রচুর গোল মরিচের গুঁড়ো। রেখে দিলাম আগের জায়গাতে। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লাম একগাদা ঝিনুক রান্না করতে। চোখ রাখলাম মাইকেলের ওপর। হাসছে মাইকেল। খুশি মেয়েটার দেখা পেয়ে। হাসি গিয়ে ঠেকেছে দুই কানের লতিতে। আরও কুৎসিত লাগছে ওকে। মেয়েটা কী একটা কোমল পানিয়ের অর্ডারও দিল। আর তাতেই নিজের পানীয়টার কথা মনে পড়ে গেল ওর। হাত বাড়িয়ে নিজের কোকের ক্যানটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে গিলে ফেলল প্রায় সবটুকু তরল।
পরে জেনেছি, মাইকেল ভেবেছিল একদমে কোক বা বিয়ারের ক্যান পুরোপুরি খালি করা বেশ বাহাদুরির একটা কাজ। বিশেষ করে মেয়েদের সামনে। দেখার মতো একটা দৃশ্য হলো। ও জানে না রেস্টুরেন্টের সব কর্মচারী আড় চোখে দেখছি ঘটনাটা। এক মুহূর্ত মাইকেলের চেহারা স্বাভাবিক রইল। তারপর বিকৃত হয়ে গেল চেহারা। ইংরেজি হরর ছবিতে এমন চেহারা দেখা যায় হরহামেশা। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে অনেকবার মাইকেলের চেহারাটা ঘনঘন বদলাল। দ্রুত ছুটে গেল সিঙ্কের দিকে। বমি করবে। কিন্তু সিন্‌ক ভর্তি বড় বড় বাগদা চিংড়ি। সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একজন বাগদার খোসা ছাড়াচ্ছে। দ্রুত ছুটে গেল অন্য সিন্‌কের দিকে। সেটা ভর্তিও সবুজ খোসার বড় বড় ঝিনুক, পরিষ্কার করার জন্য রেখেছে কেউ। বাধ্য হয়ে ছুটে গেল ময়লা ফেলার বিনের দিকে। হড় হড় করে বমি করল মাইকেল। উবু হয়ে বসে রইল বিনটা জড়িয়ে ধরে। যেন বহু বছর পর হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকাকে ফিরে পেয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান বাজছে, নেভার সে গুড বাই। কী অদ্ভুত মিল। এদিকে হাসিতে আমাদের পেট ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু মুখটা করুণ করে সবাই চেচাচ্ছি, হায় হায় মাইকেল আর ইউ ওকে মাইট?
ভাগ্যিস সে সময় খদ্দেরে ঠাসা ছিল না। শুধু মাত্র সেই মেয়েটা আর একটা বুড়ো ছিল। বুড়োটা আবার চোখের সামনে সেদিনের খবরের কাগজ ধরে রেখেছিল। বমি শেষ করে নিজের মাথায় নিজেই পানি ঢালল অনেক সময় ধরে। ওর করুন অবস্থা দেখে ওর প্রেমিকা ভেগে গেছে। খাবারও নেয়নি। রুচি চলে গেছে নাকি। মাইকেলের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মাত্র কয়েক মিনিটে ওর চেহারা ৪০ বছর বেশি হয়ে গেছে। একদম ভিজে বেড়ালের মতো লাগছে ওকে। কিচেনের মেঝেতেই অনেকক্ষণ অসহায়ের মতো বসে রইল মাইকেল। তারপর মেরু ভালুকের মতো উঠে এল। মারামারি করার ইচ্ছা। কিন্তু কী হলো কে বলবে তলপেট চেপে ধরে টয়লেটে দৌড় দিল। ঘণ্টাখানেক পর ওখান থেকে বের হয়ে চুপি চুপি চলে গেল বাড়িতে। পরদিন কাজে এল না।
আমরা মুক্তির স্বাদ পেলাম। মাইকেল ছাড়াই রেস্টুরেন্ট চালালাম। ইচ্ছা মতো গাণ্ডেপিণ্ডে খেলাম। পরদিন কাজে এল মাইকেল। অনেক শুকিয়ে গেছে। চেহারা দেখে মনে হয় জটিল আর কুটিল কোনো রোগে ভুগছে। রাগে দুঃখে আমাদের কারও সঙ্গে কথা বলছে না। শুধু সন্ধ্যাবেলায় আমাদের বস জন কস্তি আমাকে ফোন করে জানতে চাইল আসলে কী হয়েছিল। বসকে সব বলাতে ভদ্রলোকের সে কী হাসি। পাঁচ দিন আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি মাইকেল। আমাদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল তখন থেকেই। মজার ব্যাপার হলো, এরপর আমরা খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে কাজ করে ডি কস্তির ৮টা দোকানের মধ্যে এটাই সবচেয়ে বেশি লাভজনক রেস্টুরেন্ট বানিয়েছিলাম আমরা। দারুণ সব দিন গেছে।
২০০৫ সালের মাঝামাঝি টাউন হলে ডি কস্তির একটা শাখা নিলাম আমি। শ আমার। সে এক নতুন জীবন। আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম তখন। ছয় দিন কাজ করতাম। রোববার ছুটি। তত দিনে মাসকটের বাসা বদল করে সেন্ট্রাল স্টেশনের পাশে সেই ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটে উঠে গেছি। ২০৯ নম্বর বাড়ি। অনেকে তখন এই বাড়িটাকে সি ফুড মিলনের বাসা বলত। কী দারুণ এক খেতাব। সি ফুড মিলন। বাহ্‌। শনিবার রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে পুরো টাউন হল হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। পরে এটা একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। কখনই একঘেয়ে মনে হতো না।
শীতের এক সন্ধ্যায় প্যাভিলিয়ন হোটেলের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। বেশ ঠান্ডা বাইরে। দেখি রোগা আর ফ্যাকাশে চেহারার একটা চাইনিজ বা ভিয়েতনামিজ মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার সামনে দিয়ে যারাই হেঁটে যাচ্ছিল তাদের সবার হাতে সে গুঁজে দিচ্ছিল পোস্ট কার্ডের মতো কী যেন। আমার হাতেও একটা দিল। জিনিসটা নেড়েচেড়ে দেখি ওটা একটা কুপন। সুন্দর চাররঙা ঝকমকে ছাপা। তাতে যা লেখা তার অর্থ হচ্ছে এই কুপন নিয়ে প্যাভিলিয়ন হোটেলে গেলেই একটা ফ্রি পানীয় পাওয়া যাবে। হতে পারে ঢাউস এক গ্লাস ড্রাফট বিয়ার। এক গ্লাস সাদা বা লাল ওয়াইন বা কোমল কোনো পানীয়। ব্যাপারটা আসলে এক ধরনের বিজ্ঞাপন বা প্রচার।
শীতের সন্ধ্যাগুলোতে পাব (pub) আর বারগুলো খুব একটা খদ্দের ধরতে পারে না। বিশাল বিশাল বারগুলোর বড় একটা অংশই খালি থাকে। বার টেন্ডার সাহেব ন্যাকড়া দিয়ে বোতল আর গ্লাস ঝাড়া মোছা করে সময় কাটান। অথচ বার পরিচালনার খরচ, বিদ্যুৎ বিল একই থাকে। তাই কিছু কিছু হোটেল আর বার এই রকম ফ্রি কুপন ছাড়ে। ফ্রি কুপন পেয়ে লোকজন ভেতরে যায়। বারগুলো জমজমাট দেখায়। জমজমাট দেখে আরও কিছু অলস লোক ঢুকে পড়েন। এই ভাবেই সরগরম হয়ে যায় পরিবেশটা। সহজ আর চমৎকার একটা কায়দা।
ব্যাপারটা আসলে তখনো জানতাম না। সিডনির মতো কঠিন শহরে যে কিছু বিনে পয়সায় পাওয়া যায় ধারণাই ছিল না। ফেলো কড়ি মাখ তেল কথাটা এই শহরের জন্য মোক্ষম। তেল মাখার ব্যাপারটা অবশ্য একটু ঝাপসা আমার কাছে। তো খুশিই হলাম এই রকম একটা ফ্রি কুপন পেয়ে। মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আরেকটা কুপন পাওয়া যাবে কিনা?
মেয়েটা বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, একজনের জন্য মাত্র একটাই কুপন। তুমি তো একা। সঙ্গী থাকলে আরও একটা দিতাম।
কয়েক হাত দূরে একটা সুন্দরী অজি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কানে মোবাইল। কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। মেয়েটাকে দেখিয়ে বললাম, ওই তো আমার বান্ধবী দাঁড়িয়ে আছে।
ওটা তোমার বান্ধবী? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল কুপনওয়ালা চাইনিজ।
কেন কোনো সমস্যা? আকাশ থেকে পড়ার ভান করলাম।
না মানে...ইয়ে...। কুপনওয়ালি বেশ আমতা-আমতা করছে।
বুঝতে পেরেছি। মরমি বন্ধুর মতো মাথা ঝাঁকালাম। মানে এত সুন্দরী একটা মেয়ে আমার মতো বাজে চেহারার একজনের বান্ধবী হয় কী করে। তাই তো?
নাহ...মানে...। চাইনিজ মেয়েটা বেশ বিব্রত।
হয়, হয়। বিউটি অ্যান্ড বিস্ট গল্পের মতোই। হাত পা নেড়ে ব্যাখ্যা করলাম। আমি দেখতে হয়তো কুৎসিত কিন্তু আমার মনটা পার্থ শহরের খনির হিরের মতোই। এবার দূরের সেই সুন্দরী অজি মেয়েটা ফোনে কথা বন্ধ করে আমার দিকে তাকাল। অজি মেয়েটার সঙ্গে চোখে চোখ পড়ামাত্র হাত তুলে হেসে বললাম, হাই ডার্লিং। যেন কত দিনের পরিচিত। মেয়েটাও হাসল বিনিময়ে।
এবার আর কোনো সন্দেহ রইল না কুপনওয়ালির মনে। দ্রুত নতুন একটা কুপন আমার হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলল, সরি স্যার। আসলে...।
না, না ঠিক আছে। উদার একটা ভাব নিয়ে বললাম। এমন হয়। আমি কিছু মনে করিনি। কুপনটা নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছি, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল অজি মেয়েটা। বরফের মতো ঠান্ডা গলায় বলল, তুমি বললে কেন আমি তোমার বান্ধবী? আমি ঢোক গিললাম।
ইডিয়ট কোথাকার। বলল মেয়েটা। তারপর মদির একটা হাসি আর চাহনি দিয়ে চলে গেল হেঁটে। কোথায়, কে জানে।
পাশে এসে দাঁড়াল কুপনওয়ালা চাইনিজ মেয়েটা। অবাক হয়ে জানতে চাইল, তুমি না বললে মেয়েটা তোমার বান্ধবী?
ছিল। বেহায়ার মতো হেসে জবাব দিলাম। আমাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে গত সপ্তাহে।
তারপর সুরুত করে ঢুকে পড়লাম প্যাভিলিয়ন হোটেলের ভেতরে। বাইরে যা শীত। প্যাভিলিয়ন হোটেলে আমার প্রথম প্রবেশটা একটু নাটকীয় হলেও এরপর থেকে আমি নিয়মিত হয়ে গেলাম। প্রতি শনিবার কাজ শেষ হলে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম। টাউন হলেই জায়গাটা। তিনতলায় অনেকগুলো গোল গোল কাচের জানালা আছে। সামনে ছোট ছোট লাল রঙের কাউচ। এখানে বসলে পুরো টাউন হলটা দেখা যেত। সবাইকে এবং সবকিছু দেখতে পেতাম। অনেকক্ষণ বসে থাকলে মাফিয়ার বড় কোনো ডন বা গড ফাদার বলে মনে হতো। ভেতরের পরিবেশটাও দারুণ। জুক বক্সে হিপহপ গান বাজছে। দোতলায় স্লট মেশিনে জুয়া খেলার ব্যবস্থা আছে। সারাক্ষণ বিলিয়ার্ড খেলছে এক দঙ্গল ছেলেপিলে। তিন তলায় হালকা খাবার পাওয়া যায় বেশ কম দামে। তবে সবই থাই ফুড। এই হোটেলের ভালো একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, মাত্র এক বোতল বিয়ার নিয়ে সারা দিন বসে থাকতে পারবেন। কেউ বিরক্ত হবে না। কর্মচারীরা নতুন কোনো পানীয় কেনার জন্য আপনাকে ফোসলাবে না।
পরদিন ছুটি। তাই ঘণ্টাখানেক বসে থেকে ধীরে ধীরে পরপর তিনটা বিয়ার শেষ করতাম। সময়টা বেশ ভালো কাটত। মন আর শরীর রিলাক্স করার জন্য এটাও ভালো কায়দা। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমার সমস্যা অন্য। বাঙালিদের সঙ্গে চলা দারুণ কঠিন একটা কাজ এই দেশে। কারণ এখানে সবাই নিজেকে বড় বড় মহারথী ভাবেন। পুরোনো অনেক বাঙালি আছে যাদের অতীত অনেক নোংরা আর রহস্যময়। দেশের যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে সবগুলোর শাখা হয়েছে এখানে। কিন্তু এদের কাজাটা যে কী তা আজও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে এদের নিজেদের মধ্যে মারামারি আর ঝগড়াঝাঁটির খবর সবই কানে আসে। সম্ভবত এইগুলোই এদের কাজ। বাংলা রেডিও চ্যানেল আছে পাঁচ-ছয়টা। আরও বেশিও হতে পারে। সপ্তাহে এক দিন এক ঘণ্টার জন্য এই চ্যানেলগুলো। যার যা ইচ্ছা বলছে বা যার যা ইচ্ছা শোনাচ্ছে এই রেডিও অনুষ্ঠানে। সাধু আর চলতি ভাষার মিশ্রণ করে উপস্থাপক সাহেব বলে যাচ্ছেন তার না বলা যত কথা। যেমন, এই অনুস্তান জারা জারা হুন্তাছেন তাগরে আমার বুকের ভিত্রের তাজা গুলাপের সুভেচ্চা। হায়! শ্রোতাদের অনুরোধের গানও বাজানো হয়। বেশির ভাগই হিন্দি গান। বাংলা যে গানগুলোর জন্য অনুরোধ আসে সেগুলো বেশ অদ্ভুত। যেমন বাইদানি নাচে মাজা ঝাঁকাইয়া বা রসের বন্ধু তুমি কই গেলারে। বা বন্ধু আমারে পিরিতের কম্বল দিয়া জাইত্তা ধইরা...। হেন তেন। রুচি বটে মানুষের। এক ঘণ্টার এই রেডিও অনুষ্ঠান আপনাকে পাগল বানিয়ে দিতে পারে।
বিশ্বাস করুন। মাঝে মাঝে দু-চারজনকে ধরে নিয়ে আসা হয় তাদের সফল জীবন ঘটনা শ্রোতাদের শোনানোর জন্য। এরা হয় মুদি দোকানের মালিক বা রেস্টুরেন্টের ব্যবসায়ী। এরা সুযোগ পেয়ে বলতে থাকেন তাদের যশ লাভের কথা। কত কষ্টে তিনি সফল মুদি দোকানদার বা রেস্টুরেন্টের মালিক হয়েছেন সেটাই বলেন আবেগমাখা গলায়। বলা শেষে তারা এও যোগ করেন দেশের জন্য মন সারাক্ষণ কাঁদে এবং সুযোগ পেলেই দেশের জন্য কিছু একটা করবেন। কিন্তু এই কিছু করাটা যে কেন হয় না একমাত্র ওপরওয়ালাই জানেন।
এক ব্যবসায়ীকে চিনতাম। সাউদারল্যান্ড নামে চমৎকার একটা জায়গায় ব্যবসা সফল একটা রেস্টুরেন্ট আছে ভদ্রলোকের। যখনই তার সঙ্গে দেখা হতো হতাশ গলায় বলতেন, দেশে তিনি একটা এতিমখানা খুলতে চান। যাতে শেষ বিচারের দিন বুক চিতিয়ে হাশরের ময়দানে দাঁড়াতে পারেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওনার রেস্টুরেন্টের কর্মচারীদের প্রচুর খাঁটিয়েও টাকা পয়সা দিতেন না উনি। বাঙালি প্রায় সব রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী ভাইয়েরা এই নোংরা কাজটা করে থাকেন। এদের কায়দাটা সবার একই রকম। নতুন আসা বেকার ছাত্রদের কাজ দেন ওনারা। একটা শর্ত দেন। শর্ত হচ্ছে তেমন কিছু না। প্রথমেই বেকার ছাত্রটাকে বলা হয় এক মাস ফ্রি কাজ করতে হবে। কাজ যদি পছন্দ হয় তবে পরের মাস থেকে বেতন ধরা হবে। সহজ একটা ফাঁদ। এক মাস দিনে ১২ ঘণ্টা করে খাটানো হয় বেচারাকে। তারপর মুখটা কালো করে শুকনো গলায় জানিয়ে দেওয়া হয়, তার কাজ পছন্দ হয়নি। সে যেন অন্য জায়গায় কাজ দেখে। একদম খালি হাতে বিদায় করা হয় বেকার হতভাগ্য ছেলেটাকে। এই দেশে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেন এমন কোনো বাঙালি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না ওনারা কর্মচারীর পয়সা মেরে খাননি।
বনি আমিন নামে এক বাঙালি উকিল তার মক্কেলদের মধ্যে যারা অবৈধ হয়ে যেত তাদের দিনের পর দিন ব্ল্যাকমেল করতেন। তাদের ভয় দেখাতেন। কথা না শুনলে বলতেন, নইলে ইমিগ্রেশনে ফোন করে ধরিয়ে দেবেন। পিশাচদের গল্প। ঠিক না? এই ভাবেই চলছে বাঙালিদের কমিউনিটি।
কয়েক দিন আগে দেশের এক গায়ক এসেছিলেন এখানে গান গাইতে। অনুষ্ঠানে সামনের চেয়ারে কে কে বসবে এই নিয়ে দারুণ একটা মারামারি হলো বুড়ো হাবড়া মুরুব্বিদের মধ্যে। যাদের বয়স ৪৫ থেকে ৫৫ এমন। নতুন যারা এই শহরে আসছে তারা কী শিখবে পুরোনোদের কাছে? কিচ্ছু না। অন্তত আমি কিছু শিখিনি। সিডনির বাঙালিদের নিয়ে সংগত কারণেই কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না। আসলে তিন পুরুষের অর্থ আর বিদ্যা না থাকলে মানুষের মনটা পরিষ্কার হয় না সহজে। যে কোনো বাঙালির সঙ্গে পরিচয় হলেই বেচারা গায়ে পড়ে হড়হড় করে বলে যাবেন বাংলাদেশে ওনাদের কী কী আছে। এক মিনিট ফুরসত দেবেন না উনি। তারপর ওনার টাকা পয়সার কথা বলবেনই বলবেন। অদ্ভুত চরিত্র।
কাজেই ব্যাবিলনের মতো সুন্দর এই শহরে আমি যে একা থাকব তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমি বেঁচে থাকি আমার নিয়মে। ছয় দিন ব্যস্ত থাকতাম রেস্টুরেন্ট নিয়ে। নতুন সব খাবার বানিয়ে খদ্দের ধরার চেষ্টা করতাম। সারা দিন রান্না করতাম। শনিবার সন্ধ্যায় এসে বসতাম প্যাভিলিয়ন হোটেলের তিন তলার জানালার পাশের কাউচে। তাকিয়ে দেখতাম টাউন হলের ব্যস্ততা। হোটেলের সব কর্মচারীরা চিনত আমাকে। বার টেন্ডার থেকে বাউন্সার-সবাই। আমি বসামাত্র এক বোতল বিয়ার আর পিচ্চি একটা প্লাস্টিকের বাটিভর্তি চানাচুর নিয়ে আসত। চানাচুরকে ওরা বলত, ইন্ডিয়ান ফ্রায়েড মিক্সড।
এমন এক নীল রঙের শীতের সন্ধ্যায় বসে ছিলাম বিয়ার হাতে। জমে উঠেছে লোকজনের ভিড়। একদল ভারতীয় ছেলেপিলে হই হল্লা করে বিলিয়ার্ড খেলছে। ওদের সঙ্গে প্রায়ই অজিদের মারামারি হয়। এক তরফাভাবে মার খায় ভারতীয়গুলো। এটা এখন বেশ বড় ইস্যু। পার্লামেন্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে ব্যাপারটা। একটা হিন্দি সিনেমা বানানো হয়েছে এমন একটা ইস্যু নিয়ে।
ভাবছি নানা কিছু। এমন সময় মেয়েটার ওপর চোখ পড়ল। আমাকে দেখছে সে। বসে আছে আরও চার-পাঁচটা নেপালি আর ভারতীয় মেয়ের সঙ্গে। তারপরও এত দূর থেকে চোরা চোখে নজর রাখছে আমার ওপর। মেয়েটা দেখতে বেশ। লম্বা চুল। মায়াবী চেহারা। চোখ দুটো সুন্দর। কিন্তু আমাকে দেখছে কেন? আমার চেহারা কোনো কালেই রমনীমোহন ছিল না। এখনো নেই। তাহলে? ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করলাম। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো ডি কস্তি রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল কখনো। ব্যস্ততার জন্য খেয়াল করতে পারিনি। আমাকে মনে রেখেছে সে। মনে রাখার মতোই চেহারা আমার। একবার ঢাকাই সিনেমার এক পরিচালক আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার সিনেমায় একজন মাতাল, লম্পট আর ধর্ষকের চরিত্রে অভিনয় করব কিনা। আমাকে নাকি খুবই মানাত সেই চরিত্রে। কী ভেবে রাজি হইনি। হলে ভালো হতো।
তো মেয়েটা সম্ভবত আমার কাছে চাকরির আবেদন করবে। বেশ কিছুদিন ধরে এই ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। বাংলাদেশ-ভারত আর নেপাল থেকে প্রচুর ছাত্র ছাত্রী আসছে আজকাল। চাকরির বাজার খুবই খারাপ। একজন কিচেনহ্যান্ড লাগবে। তাই গত মাসে একটা বিজ্ঞপ্তি টাঙ্গিয়েছিলাম। এক সপ্তাহে ৪৫ জন এসেছে চাকরিটার জন্য। মাথা খারাপ হওয়ার দশা আমার। এত জনকে কাজ দেব কোত্থেকে? অনেকেই নানান লোকের কাছ থেকে আমার নাম জোগাড় করে হাজির হয়। এক মেয়ে বলেছিল, বিধু বাবুর নাতি আমাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। আপনারা নাকি ছোটবেলায় বিধু বাবুর মেয়ের জামাইয়ের বন্ধুর শালার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। একটা কাজ জোগাড় করে দিন।

লেখক
লেখক

যা হোক, বেশ কয়েকবার চোখে চোখ পড়ল মেয়েটার সঙ্গে। ভারতীয় বা নেপালি হবে। ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারছি আমাকে চেনে সে। তার মানে এবার কেটে পড়তে হবে। ঠিক করলাম বোতলটা শেষ করেই উঠে পড়ব। বাড়ি ফিরে জামা কাপড় মেশিনে ফেলে লন্ড্রি করতে হবে। বড় একটা ম্যালেট (mullet) মাছ ঘুমিয়ে আছে ডিপ ফ্রিজে। ওটার ব্যবস্থা করতে হবে। জানা কথা মাছ ভাজার ঘ্রাণ পেলেই বাড়িওয়ালা বুড়ো মাইকেল হাজির হবে রান্নাঘরে। কাজেই ভাতও রান্না করতে হবে একটু বেশি। এ সব ভাবছি। এমন সময় বার টেন্ডার ছেলেটা এসে জানাল সামনে বসে থাকা মেয়েটা কথা বলতে চায় আমার সঙ্গে। মেয়েটা নাকি আমাকে চেনে।
অবাক হলাম। সম্মতি দিলাম সঙ্গে সঙ্গে। দেখি মেয়েটা তখনো চেয়ে আছে আমার দিকে। হাসি হাসি একটা ভঙ্গি করতেই চলে এল আমার সামনে। সহজ সাবলীল হাঁটা।
আপনি কি বাঙালি? প্রথম কথাটা মেয়েটাই বলল। ইংরেজিতে।
হ্যাঁ।
আপনি কি মিলন গাঙ্গুলী? এবার বাংলায় প্রশ্ন করল সে। কিছুটা উত্তেজিত।
হ্যাঁ। অবাক হয়ে জবাব দিলাম।
আপনি আমাকে চিনতে পারেননি?
চেনার কথা নাকি?
আমি শিখা দিদির বোন। ঊর্মিলা। বলল সে।
কোন শিখা দিদি? কোন ঊর্মিলা? স্মৃতির জল জোছনায় কত মুখ গেছে ভেসে। মনের অতলে হারিয়ে গেছে কত চেনা মুখ। আচমকা মনে পড়ল। খুব ছোটবেলায় বই বগলে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। পথের মাঝে কতগুলো চালতা আর পাকুড় গাছের সঙ্গে ছিল শিখা দিদির বাড়ি। ওনারা ছিলেন তিন বোন। বিকেলবেলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত তিন বোন। গরমের দিনে ছাদে আচার আর ডালের বড়া রোদে দিত। বাড়ির ভেতর থেকে গান ভেসে আসত, মনে পড়ে রুবি রায়...। আচ্ছা সেই তিনজনের সবচেয়ে পিচ্চিটাই ঊর্মিলা। এবার মনে পড়েছে।
চিনতে পেরেছেন? হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন করল ঊর্মিলা।
হ্যাঁ। মাথা নাড়লাম।
এই মুহূর্তে আমি যথেষ্ট বিব্রত। চেষ্টা করছি শূন্য বিয়ারের বোতলটা লুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু কীভাবে সেটা সম্ভব? জাদু জানতাম যদি!
মাত্র তিন মাস হলো সিডনিতে এসেছি আমি। এবার কথার খেই ধরল। দুই চোখে হাসির ঝিলিক। স্টুডেন্ট ভিসা। জানি, এই শহরেই আছেন আপনি। আপনাকে অনেক খুঁজেছি। ধন্যবাদ। কী বলব বুঝে উঠতে পারছি না। ওই যে মেয়েগুলো দেখছেন ওরা ইন্ডিয়ান। এক সঙ্গেই পড়ি। ওরাই আমাকে নিয়ে এসেছে। আবার বলতে লাগল সে। (মনে মনে ভাবছি উফ এত কথা বলতে পারে)। আপনি অনেক বদলে গেছেন। আগে কত লাজুক ছিলেন। তারপর শূন্য বোতলের দিকে চেয়ে বলল, আমি ভাবতেই পারিনি যে আপনি ড্রিংক করেন। মদ টদ খান।
আরে নাহ। আমি আপত্তি করলাম। এটা মদ না বিয়ার। গম, ভুট্টা, রাই এই সব হাবিজাবি দিয়ে বানায়। একদম জড়িবুটি টাইপের জিনিস। কবিরাজি পথ্যের
মতো।
বিয়ার কবিরাজি পথ্য? দুই চোখ গোল্লা গোল্লা হয়ে পিচ্চি সারসের ডিমের মতো হয়ে গেল ঊর্মিলার।
তবে আর বলছি কী? খেকিয়ে উঠলাম। আমি আসলে পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। সে এখনো আসেনি। তাই ক্যারেটের ছেলেটা একটা বিয়ার ধরিয়ে দিল। এখানে খালি হাতে বসে থাকা দৃষ্টিকটু দেখায়। জীবনেও বিয়ার খাইনি আমি। এটাই প্রথম আর শেষ। আমার ধাতানি খেয়ে ঊর্মিলা বেশ থতমত খেয়ে গেল।
এই সময় বার টেন্ডার ছেলেটা এসে হাজির হলো। হাতে নতুন একটা বিয়ারের বোতল। ঘামছে বোতলটা। ঠান্ডা। মেলন, এই নাও তোমার সেকেন্ড রাউন্ড। বোতলটা আমার সামনের টেবিলে রেখে বলল বার টেন্ডার ছেলেটা।
না, মানে ইয়ে...কী দরকার ছিল। বিব্রত হলাম।
কী দরকার ছিল মানে। আরও বেশি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল হাসিখুশি মস্তিবাজ বার টেন্ডার ছোকরা। তিন বোতল শেষ না করে তো উঠতে দেখিনি জীবনে। আজ আবার কি হলো? যোগ ব্যায়াম শিখছ নাকি আজকাল?
ফ্যাকাশে হেসে ঊর্মিলার দিকে তাকালাম। সাফাই গাইলাম, আসলে আমার মতো দেখতে অন্য কেউ আসে বোধ হয়। জানেন তো চেহারার মিল কত মানুষের মধ্যে হয়। সারা দুনিয়ায় সাতজন মানুষ থাকে হুবহু একই চেহারার।
ঊর্মিলা হাসছে আমার অবস্থা দেখে। কী বিচ্ছু মেয়েরে বাবা। বুঝলাম সকলই গরল ভেল। লাভ নেই। ধরা পড়ে গেছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসলাম। ঊর্মিলার চোখে চোখ রেখে বললাম, বলুন কি অর্ডার দেব আপনার জন্য? এরা ভ্যানিলা সেকটা খুব ভালো বানায়। নাকি সারলি টেম্পল আনতে বলব?