এই দেশ, সেই দেশ

ভিনদেশে থেকেও আমরা ভুলতে পারি না স্বদেশের সংস্কৃতিকে।

স্বদেশ প্রেম আমাদের জেগে উঠে মূলত দেশত্যাগী হয়ে মোহভঙ্গের পরে। তবে এর তুল্য মূল্য বিচারে সুলভ সুখ যাকে বোঝায়, তা প্রবাসে কখনোই পাওয়া যায় না। প্রবাসে আসলেই একটা প্রীতিকর বিস্ময় বেশি কাজ করে। এখানে মানুষ তাঁর চুলের ঘনত্ব খুব তাড়াতাড়ি হারায়, সুখ, আহ্লাদ নিমেষেই তামাদি হয়। আমরা যারা গৃহস্থ, আগাগোড়া সংসারী, আমাদের পারফেক্ট কম্বিনেশনটা ঠিক ওভাবে এখানে হয় না। এখানে বসন্তে শিমুল গাছে লাল আগুনের বন্যা চোখে পড়ে না, ঘন পাতার আড়ালে এখানে কোকিল তার সঙ্গিনীকে ডাকাডাকি করে না।

ডিপ থিংকিং এবং শিল্প সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ সেই ছোট বেলা থেকেই, তবে মেইকসেন্স ছাড়া মনগড়া আমি কখনোই কিছু ভাবি না। এই প্রবাসে পাঁচমিশালি সম্পর্কগুলোকে নিয়েই আমাদের চলতে হয়। একটা ছিন্ন–ভিন্ন শৈশব এখন আমার কাছে কেবলই স্মৃতি। একটা অদ্ভুত নির্মোহ ভঙ্গিতে এখানে আমরা সবাই দিন কাটাই। স্বপ্ন মানেই বাস্তবের বিপরীতে কিছু একটা এই কনসেপ্ট, এখানে না আসলে ‘স্বপ্নের দেশ’ হয়তোবা এটা স্বপ্নেই থেকে যেত।

ভিনদেশে থেকেও আমরা ভুলতে পারি না স্বদেশের সংস্কৃতিকে।

আমার স্মৃতিতে আজও বাংলাদেশের স্মৃতি ধার্য অভিজ্ঞতা প্রতিচ্ছবির মতোই কাজ করে, হতে পারে আমার ভাবনার অসংলগ্ন বিন্যাসের দ্বিবিধ অতিরঞ্জন এটি, তবে প্রত্যক্ষলব্ধ আমার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা বিস্তারের ন্যূনতম ধারণা নয়। আমার দেশের ভালো লাগার অনুষঙ্গগুলো আমার মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হয়। ভাষা একটি অত্যন্ত জরুরি কাজের জিনিস, যে যতটা পরস্পর অনুযায়ী সাজাতে পারেন, ব্যবহার করতে পারেন তিনি তত বেশি দক্ষ তত বেশি যোগ্য। আমার দেশকে নিয়ে স্মৃতিবাহিত অনেক দুর্বলতা আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। এই দেশে না আসলে আমার মিশ্র অভিমত কখনোই তৈরি হতো না, তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে এখানে আমি অনন্ত একটু বেশিই প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। তবে পরিতৃপ্তির বিষয়ে ব্যঞ্জনা তো আছেই। আমার দেশে উন্নত পরিকাঠামো হয়তো নেই, কিন্তু যে কেউ চাইলে প্রতিষ্ঠিত হওয়াটা এখনো দেশেই সুলভ। এই দেশে এসে আমার দৃষ্টি কখনোই ঝাপসা হয়নি, এটা আমার সহজ সরল সরেজমিন পর্যবেক্ষণ।

ভিনদেশে থেকেও আমরা ভুলতে পারি না স্বদেশের সংস্কৃতিকে। ছবিতে মডেল হয়েছেন নওরীন বর্ণা, শাকিলা রিতা, সাবরিনা, রেশমা, নাজু, মাহমুদা, ফারহানা, তানজিনা।

প্রিয় পাঠক, আমি কোনো দেশের সংকোচনশীলতার কথা বলছি না। তবে এই দেশে এসে জীবনসংগ্রামে আমি কাঙ্ক্ষিত কিংবা অবাঞ্ছিত দুই ধরনের সুখই পেয়েছি। সম্ভবত এটাই তারতম্য। জীবনের দ্বন্দ্ব আর পরিত্যক্ত স্মৃতিঘর নিয়ে এখন এখানে আছি। আমার সহজ, সরল জীবনপদ্ধতি এখানকার বহুমাত্রিকতার জটিলতায় প্রতিনিয়তই বিবর্তিত হচ্ছি, সম্ভবত এটাই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের পার্থক্য। এখানকার জনজীবনের রোজনামচায় প্রতিনিয়তই উত্তরাধুনিকতা কাজ করে। একদিকে ভোগবাদ সর্বস্ব, অন্যদিকে চেনাজানা সিদ্ধান্ত এই উপলব্ধি থেকে বেরিয়ে আসা খুবই শ্রমসাধ্য। কঠোর মনোবল না থাকলে তা মোটেও সম্ভব নয়। তবে আদর্শবাদের বিড়ম্বনা এখানে সবচেয়ে বেশি। আদর্শবাদ বলতে আমি এককেন্দ্রিকতায় এখানে কেউ স্থির নয়, এটাই বোঝাতে চেয়েছি। অদ্ভুত সংমিশ্রণেই এখানে সবাইকে চলতে হয়। খাওয়া–পরা থেকে শুরু করে আচার–আচরণ, কথা–বার্তা সবকিছুতেই একটা অসম সংকট সব সময় লেগেই থাকে। এত কিছুর পরেও নিজেকে দুধারায় সম্পৃক্ত রাখা কতখানি যৌক্তিক, তা সময়ই বলে দেবে।