সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ঘটনায় স্তম্ভিত দেশ, স্তম্ভিত সিলেট। লজ্জা আর ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের বাইরেও। রাগে-অপমানে নিজেদের ক্ষোভ-হতাশা প্রকাশ করছেন যে যার মতো করে।
এমন ঘটনা একদিনে হয়নি। দুর্বৃত্তায়ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে আমাদের আস্তিনের তলায়। আমাদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে। যেকোনো ঘটনা ঘটলেই, আমরা পক্ষ সৃষ্টি করেছি। সব সময় অন্যের দোষ দেখে কখনো নীরব থেকেছি। কখনো একে অন্যের দিকে আঙুল তুলেছি। তারপর একসময় সব ভুলে গেছি। সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে বা হয়ে যাবে মনে করে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছি। কখনো রাজনৈতিক পরিচয়ে, কখনো নিজেকে নিরপেক্ষ দাবি করে দায় অন্যদের ওপর চাপিয়েছি। আমরা নিজেদের পরিচ্ছন্ন দেখানোর চেষ্টাই করেছি।
সিলেটের ঘটনায় নাম এসেছে ছাত্রলীগের। ছাত্রলীগের লোকজন বলেছে, তাদের কোন কমিটিই নেই এম সি কলেজে। আরেকজন বলেছেন, ছাত্রলীগের এখন কমিটি করতে হবে কেন? সবাই এখন ছাত্রলীগ করে। করতে হয়। ছাত্রলীগ তো এমন কোন সংগঠন নয়, যেখানে বাছাই করে ভালো ছেলের পরীক্ষা দিয়ে তাদের সংগঠনের মিছিলে আসতে হয়! নব্বই দশকের এক প্রবাসী ছাত্রলীগ নেতা জানালেন, ছাত্রলীগের মিছিলে অনেকেই আসে। কমিটিতেও চলে আসে। কমিটি করার আগে, মিছিল করার আগে ডিএনএ টেস্ট করার তো কোন উপায় নেই!
ছাত্রলীগের সমর্থক হয়ে এসব তরুণেরা কেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তার কারণ কারও অজানা নয়। কারণ জানা থাকলেও এর সামাজিক রাজনৈতিক প্রতিকারের বিষয়ে নেতারা বা প্রশাসন যে খুব আন্তরিক, তা মনে মনে হচ্ছে না।
ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে কিছু মানুষ প্রতিবাদী হয়। একসময় এমন ঘটনায় পক্ষ-বিপক্ষের সৃষ্টি হয়। কেউ কেউ বলে, প্রতিবাদ করে কি হবে? গ্রেপ্তার হবে না। গ্রেপ্তার হলে বলবে, জামিন পেয়ে যাবে। বিচারে দণ্ড পেলে, বলা হবে সাধারণ ক্ষমায় বেরিয়ে আসবে।
সর্বত্রই এমন অনাস্থা একদিনে সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি ঘটনা আমাদের অনেক কিছুই স্মরণ করিয়ে দেয়। স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা ক্রমশ নাজুক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। এ পরিস্থিতির জন্য নিজের দায়িত্ব আমরা এড়িয়ে চলছি। কখনো পালিয়ে বেড়িয়েছি। আমরা বিবেকের দায় নিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারিনি। আমরা আত্মসমর্পণ করেছি। কখনো রাজনীতির কাছে, কখনো প্রভাব প্রতিপত্তির কাছে। হামলাটা আমার ঘরে না আসা পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ মনে করেছি।
২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবির সংঘর্ষের জের ধরে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়েছিল এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ। পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তখনকার শিক্ষামন্ত্রীকে কাঁদতে দেখেছি। কান্নাটি কোন গ্লানির কান্না ছিল? কান্নাটি কি কোন অসহায়ত্বের কান্না ছিল? আমরা টের পাইনি।
২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর পুনর্নির্মিত ছাত্রাবাস উদ্বোধন করা হয়। এরপর থেকে ছাত্রলীগই এককভাবে ছাত্রাবাসে আবাসিক ছাত্রদের বসবাস নিয়ন্ত্রণ করছে বলে সংবাদ এসেছে। যদিও এমসি কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। সিলেটে জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটিও কেন্দ্র থেকে স্থগিত রয়েছে।
সিলেট এমসি কলেজের যে এলাকাটিয় এমন নারকীয় কাণ্ড ঘটেছে, এলাকাটি আমাদের চির চেনা। নগরকেন্দ্রের কিছুটা বাইরের এলাকা। কিছুদিন আগেও একদম নির্জন এলাকা ছিল। সেখানে বন্ধুকে নিয়ে, বান্ধবীকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা নাগরিক জীবনের নিয়মিত ঘটনা হিসেবেই দেখা হয়েছে।
স্বামীর সঙ্গে ছিল মেয়েটি! কিছুদিন আগেও সেখানে একা মেয়েরা ঘুরে বেড়িয়েছে। আজও এমন ঘোরাঘুরি হয়। চমৎকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যময় এলাকাটিতে প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরে বেড়ায়।
আমাদের সমাজটা কি এতই অনিরাপদ হয়ে উঠেছে? এতই বর্বর হয়ে উঠেছে? এমসি কলেজে ঘটেছে বলে নয়। সিলেট নগরীতে ঘটেছে বলে নয়। স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে ঘটেছে বলে নয়। যে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তা নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ঘটলেও প্রতিক্রিয়া একই।
ছাত্রলীগের কর্মীরাও দ্রুত প্রতিবাদে নেমেছে। এর মধ্যেই বলতে শোনা গেছে, এরা মাঠ দখল করে অন্যদের প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাহলে প্রতিকার কি?
ঘটনার পরদিন মামলা হয়েছে। মামলা হওয়ার আগেই ঘটনায় জড়িত সন্দেহভাজন ছয়জনের নাম ও ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। অপরাধের সঠিক তদন্ত ও বিচারের জন্য এসব বিষয় প্রভাব ফেলতে বাধ্য।
এমসি কলেজের ঘটনা নিয়ে পুলিশ তৎপর হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আস্থা শূন্যে নেমে যায়নি বলেই মানুষ প্রতিবাদ করছে। সাধারণ মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে। মানুষের এই ক্ষোভ ও গ্লানির প্রতিক্রিয়া আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা এখনো নিঃশেষ হয়ে যাইনি।
ছাত্রলীগের কর্মীরাও দ্রুত প্রতিবাদে নেমেছে। এর মধ্যেই বলতে শোনা গেছে, এরা মাঠ দখল করে অন্যদের প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ বন্ধ করে দিচ্ছে। তাহলে প্রতিকার কী? ছাত্রলীগের কর্মীরাই তো আগে প্রতিবাদে নামবে। তারাই সবার আগে বলুক, এসব দুর্বৃত্তের সঙ্গে আমরা নেই!
সিলেট অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি এখনো যারা নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের বেশ ভালো করেই জানি। এদের মধ্যে কেউ কেউ কলঙ্কের কালিমায় নিজেদের হয়তো কলুষিতও করেছেন। তারপরও বুকে হাত দিয়ে বলব, পুরো সিলেট এখনো দুর্বৃত্তদের কবলে চলে যায়নি। আওয়ামী লীগের কোন রাজনৈতিক নেতাই এমন বর্বরতার দূরতম প্রশ্রয় দেওয়ার সাহস দেখানোর কোন সুযোগ নেই। আমরা যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহন করি, সেখানে এমন চিন্তা অকল্পনীয়! পরিস্থিতি যত নাজুকই হোক, এখনো আমরা সে পর্যায়ে যাইনি।
রাজনৈতিকভাবে ঘায়েলের সুযোগ নিয়ে যার যত ক্ষোভ আছে, তার প্রকাশ্য উদ্গিরণ চলছে। এমন হওয়াও স্বাভাবিক। ক্ষোভের পাহাড়তো এখন হিমালয় সমান।
জনগণ থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিরা এমন পরিস্থিতিতে নাগরিকদের পাশে দাঁড়ালে নাগরিকেরা ভরসা পায়। জনপ্রতিনিধিদের সে অবস্থা এখনতো আর তেমন নেই। এরপরও রাজনীতির মাঠে, সামাজিক নেতৃত্বে এখনো কিছু মানুষ আছেন। যারা দাঁড়ালে মানুষ আশার আলো দেখে। এদের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ আজও ভাবতে চায় সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আর মানবিক সমাজের স্বপ্ন অলীক হয়ে যায়নি।
দুর্বৃত্তরা এই সমাজ থেকে উঠে আসা লোক। পশ্চিমের সমাজও এমন দুর্বৃত্তপনা নির্মূল করতে পারেনি। তবে এদের প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কঠোরভাবে। এ নিয়ন্ত্রণের কাজটি আমাদের করতে হবে। করতে হবে আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে। করতে হবে সম্মিলিত সামাজিক প্রতিরোধের মাধ্যমে।
জানি, এর মধ্যেই বলা হবে, তনু হত্যার বিচার হয়নি। বলা হবে, সাগর রুনি হত্যার বিচার হয়নি। হয়নি বলে, এ নিয়ে মানুষের আর্তিও থেমে যায়নি!
ঘটনার নির্মমতায় আহত মানুষের পাশে দয়া করে দাঁড়ান। আইনকে নিজের মতো চলতে দিন।
একে অন্যের পিঠে হাত রাখুন। আহত মানুষের বিলাপ আর মর্মপীড়াকে ধারণ করুন। বলুন, এ লজ্জা আমাদের! এর দায় থেকে আমরা কেউই মুক্ত নয়!