উদ্যোক্তা তৈরিতে ডেটাভিত্তিক কোর্স ও কর্মশালার প্রয়োজন
আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের গবেষণার প্রতি কেন জানি আগ্রহ কম? সদ্য পাস করা একজন শিক্ষার্থী যদি নতুন একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান করতে চান, তিনি কি পারবেন যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তা শুরু করতে? ডেটাসমৃদ্ধ বিশ্ববাজারের ডেটা কীভাবে সংগ্রহ করতে হয়, সংগৃহীত ডেটা কীভাবে ব্যবহার উপযোগী করতে হয় অথবা ডাটাকে গবেষণা ও ব্যবসায়িক কাজে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তা কি শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে?
এবার আমরা বিশ্বের গবেষণায় অগ্রগামী কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যকলাপের দিকে দেখার চেষ্টা করি। কীভাবে তারা গবেষণাকে এত সহজ করে তুলেছে এবং কীভাবে তারা গবেষণায় ও উদ্যোক্তা তৈরিতে শিক্ষার্থীদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলেছে। বিশ্ব ব্যাংকিংয়ে অগ্রগামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যবহারিক ডেটাভিত্তিক জ্ঞান প্রদানের কাজে প্রতি তিন থেকে চার মাসে একটি করে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তাদের যেকোনো বিভাগের শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারে বিনা মূল্যে। এসব কর্মশালা সম্পাদনে আলাদা শিক্ষকমণ্ডলী থাকেন, যাঁরা সারা বছর শুধু ব্যবহারিক কোর্সগুলো নিয়ে থাকেন। এসব কর্মশালায় যেসব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা অংশগ্রহণের এক থেকে দুই বছরের মধ্যেই তাঁদের গবেষণার কাজে হাত দেন এবং সফল হন।
এবার আসা যাক উদ্যোক্তা ও একজন ব্যবসায়িক কর্মকর্তার আত্মবিশ্বাস কীভাবে তৈরি করা হয় সে বিষয়ে। বর্তমান বিশ্ববাজারের ভোক্তার চাহিদা, ভোক্তার পছন্দ, ভোক্তার ক্রয়–সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড, একটি নির্দিষ্ট এলাকার ভোক্তার ক্রয়–সংক্রান্ত মনোভাব সবই জানা সম্ভব, যদি একজন উদ্যোক্তা ডেটা সংগ্রহের পদ্ধতিগুলো জানেন। এ ছাড়া ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের পদ্ধতি জানা থাকলে পণ্য বিপণন ও বাজারজাতকরণে স্বল্প ব্যয়ে বেশি সাফল্য আনা সম্ভব।
বর্তমানে ভোক্তারা তাদের পছন্দ, অপছন্দ, প্রয়োজনীয় সবকিছুই সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ করছে। সুতরাং এখন ডেটা শুধু কোনো নম্বর অথবা গাণিতিক সংখ্যা না। এখন ডেটা মানুষের কথা, তাদের ডিজিটাল লেখনী, (কমেন্টস), তাদের পছন্দ (রিভিউ), তাদের ডিজিটাল অভিব্যক্তি (সেন্টিমেন্ট), তাদের ছবি, ভিডিও, ওয়েবসাইট ভিজিটের রেকর্ড, পূর্বের ক্রয় রেকর্ড, তথ্য খোঁজার রেকর্ড। সুতরাং, ডেটা এখন সংখ্যা নয়, বরং কথা, লেখনী, ছবি, ভিডিও সবই এখন ডেটা, যাকে বলা হয় জটিল ডেটা।
এই জটিল ডেটা সংগ্রহ এবং ব্যবহার করে বিশ্লেষণ করার জন্য এখন ব্যবসায়ীকে অবশ্যই ‘বিগ’ ডেটা সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকেই এসব বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান নিয়ে বের হলে শিক্ষার্থীরা অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করার এবং নতুন গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করার। বিশ্ববিদ্যালয় হোক বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র।
এবার তুলে ধরছি বাংলাদেশের বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে বা সেবা ক্ষেত্রে ডাটাভিত্তিক জ্ঞানসংবলিত মানবসম্পদের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। প্রথমেই আসা যাক চিকিৎসাসেবার বর্তমান ব্যবস্থা নিয়ে। বর্তমানে কি একজন রোগী চাইলেই তাঁর প্রয়োজনে চিকিৎসক খুঁজে পেতে পারেন? অথবা একজন চিকিৎসকই–বা কি একজন রোগীর প্রয়োজনীয় অতীত তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন, যেমন রোগীর আগের টেস্ট ইতিহাস, ওষুধ এবং অন্যান্য চিকিৎসকের দ্বারা পরিচালিত সেবাদি? অনেকটা পরিপূর্ণ তথ্য না জেনে চিকিৎসাসেবা নেওয়া ও দেওয়ার কারণে ঘটছে নানা জটিলতা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। কিন্তু ডেটার এই সমন্বয়সাধন কে করবে? সেই মানবসম্পদ কি হাসপাতালগুলোয় আছে?
এরপর দেখা যাক ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ঋণখেলাপি, তথ্য চুরি, তথ্যের নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে। ঋণখেলাপি এড়াতে প্রয়োজন একজন ঋণগ্রহীতা অথবা আবেদনকারীর ডেমোগ্রাফিক, সাইকোগ্রাফিক ও পূর্ববর্তী আচরণগত তথ্য, যা সংগ্রহ করা সম্ভব ‘বিগ ডেটা’ অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে। তা ছাড়া, তথ্য চুরি ডবল স্পেন্ডিং, লেনদের অনিরাপত্তা, লেনদেনের অস্বচ্ছতা, বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় সার্ভিস চার্জ, ইত্যাদি রোধ করা সম্ভব একমাত্র ব্লক চেইন টেকনোলজির মাধ্যমে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং ক্ষেত্রের মানবসম্পদ কি ‘বিগ ডেটা’ ও ‘ব্লক চেইন’ এ দুটি অত্যাবশ্যকীয় ব্যবহারিক জ্ঞানে প্রশিক্ষিত? না।
আবার যদি আমরা তাকাই বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের দিকে, কি দেখতে পাই? তথ্যের কোনো স্বচ্ছতা আছে? একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী কি অন্ধকারে ঢিল ছুড়ছেন না? স্টক মার্কেট, শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ সঠিকভাবে অনুমান করার জন্য প্রয়োজন বিভিন্নমুখী ডেটা সংগ্রহের দক্ষতা, যেমন সংবাদমাধ্যমের ডেটা, সোশ্যাল মিডিয়ার ডেটা, ফান্ডামেন্টাল, কোম্পানির উৎপাদন ডেটা, সরকারি বন্ড ডেটা, পূর্ববর্তী দাম, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পৃক্ত ডাটার ফ্যাক্টর অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে প্রয়োজন উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের।
তা কি বিনিয়োগকারীরা করতে পারছেন? না। এ ছাড়া বাংলাদেশের ইনস্যুরেন্স ক্ষেত্রে, রিয়েল এস্টেট ক্ষেত্রে, শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারি সেবার ক্ষেত্রে, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে, টেলিকম সেবায় কি ভোক্তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য বা সেবা দেওয়া হচ্ছে? নাকি তথ্যের স্বচ্ছতা আছে? প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য দেওয়ার জন্য দরকার ভোক্তাদের প্রয়োজন আগে জানার। তা কি জানা হচ্ছে? না। কিন্তু কেন না? এসব ‘না’–এর পেছনে রয়েছে দক্ষ মানবসম্পদের অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দেওয়া হচ্ছে না ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ অথবা হাতেকলমে শিক্ষা।
নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিন। সেখানে শর্ট কোর্স, কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, সেমিনার বছরব্যাপী চলতে থাকে, যাতে শিক্ষার্থীরা আভিধানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তবভিত্তিক ব্যবহারিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। আমরা কি আশা রাখতে পারি না যে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও হয়ে উঠুক বাস্তবভিত্তিক জ্ঞানচর্চার প্রশিক্ষণশালা?
লেখক: ড. জোহা রহমান। গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়ায়। বিগ ডেটা কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন ‘ব্লুমবার্গ’ ইউএসএ-তে রিসার্চ এবং পলিসি এক্সপার্ট হিসেবে।