উচ্চাভিলাষিণীর ভালোবাসা-২

কায়সারের মন বিষণ্নতায় আছন্ন। আগের মতো এত উদ্যম যেন কোনো কাজে নেই। মনে হয়, বেঁচে থাকার জন্য থাকা। চারদিকে শুধুই একরাশ শূন্যতায় ভরা। এর যেন কোনো শেষ নেই, যেমনটি নেই আটলান্টিকের এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের।

কায়সারের বাসা থেকে আটলান্টিক খুব বেশি দূরে নয়, আধা ঘণ্টার ড্রাইভ। প্রায়ই সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে প্রকৃতিকে আলিঙ্গন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেন। কায়সারের কষ্ট এতই ভারী যে বহন করা কঠিন হয়ে গেছে। তাই এই সমুদ্রের কাছে যাওয়া তার। যদি সমুদ্রের এই বিশালতা কিছুটা হালকা করতে পারে।

অনেক চেষ্টার পর রিশার মা কায়সারের কল ধরেন। বেশি কথা বলার ইচ্ছা নেই রিশার মায়ের।
অ্যান্টি কেমন আছেন?
বেশি ভালো নেই, বাবা।

কায়সারের উদ্বেগ বেড়ে যায়, খারাপ কিছু হয়নি তো রিশার!
কেন, কী হয়েছে?
একমাত্র সন্তান, অনেক দূরে থাকে, আগে কখনো তাকে ছাড়া থাকিনি, বাবা।
না, কোনো সমস্যা হবে না, ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না, ও ভালোই থাকবে কানাডায়।
কায়সার অভয় দেন। রিশার মাকে সাহস জোগান। কায়সারকে জানতে হবে, আসলে কী ঘটেছে, কী হয়েছে, কীবা তার দোষ ছিল।
রিশা এভাবে চলে এল, কিছু বলল না তো। তার আসার পাঁচ-ছয় দিন আগেও তো আপনার সঙ্গে কথা হলো, আপনিও তো কিছু বললেন না।
না বাবা, আমি কিছুই জানি না। ও কাউকে কিছুই বলেনি। যাওয়ার দুই দিন আগে জানতে পেরেছি।
রিশা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে না কেন? আমাকে সব যোগাযোগমাধ্যম থেকে ব্লক করল কেন?
বাবা, ও ব্যস্ত আছে, গোছগাছ করে কথা বলবে।
কথায় ফাঁক থেকে যায়। শপিং, কোভিড টেস্ট, আত্মীয়–স্বজন, বন্ধুবান্ধব—এসব তো দুই দিনে শেষ করা যায় না! রিশার শেষ কথোপকথন আরও অবিশ্বাস তৈরি করে। কায়সার বিশ্বাস করতে পারেন না। এটা অনেক দিনের পরিকল্পনা, যা সময় বুঝে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবু কায়সার পজিটিভ থাকতে চান।
কেউ পানিতে ডুবে যেতে থাকলে যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে, কায়সারও তেমনি চেষ্টা করলেন, সামান্যটুকুও যদি আশা থাকে। কোনোভাবে যদি আবার রিশার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। রিশার মাকে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করেন, রিশা যাতে দ্রুত যোগাযোগ করে। এত দিনের রিলেশনশিপ এভাবে শেষ হতে পারে না। কোথাও হয়তো ভুল–বোঝাবুঝি আছে। সব দোষ হয়তো কায়সারের, তিনি মেনে নেবেন। নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবেন। তারপরও তিনি আগের স্বাভাবিক সম্পর্ক ফিরে পেতে চান।

কায়সারের বাসা থেকে অফিসের দূরত্ব ১৫ মিনিটের ড্রাইভ। করোনাকালে অনেকেই বাসা থেকে অফিস করলেও তাকে যেতে হয় নিয়মিত। একদিন অফিস থেকে আসার পথে হঠাৎ করে মোবাইল স্ক্রিনে রিশার টেক্সট ভেসে ওঠে, ‘কায়সার কেমন আছ?’ কায়সারের মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়। দ্রুতই কাছের কফিশপ টিম হরটনে গাড়ি পার্ক করে একটা কল দেন। কল রিসিভ হয় না। উত্তর আসে, ‘আমি কাজে, টেক্সট দাও।’ কায়সারের উত্তেজনায় একটু যেন ভাটা পড়ে। কায়সার একটা ব্ল্যাক কফি নিয়ে টিমসের ভেতরে যান।

এই তো আছি, চলে যাচ্ছে। তুমি কেমন আছ?
আমি ভালো, তবে একটু ব্যস্ত। এখানকার লাইফ অনেক কঠিন। পড়াশোনা, কাজ একসঙ্গে। তুমি তো জানোই।
কোথায় থাকো, কোথায় অ্যাডমিশন নিয়েছ?
পরে বলব।
আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই, তোমার কাছে এলে দেখা করবে, রিশা?
আগে একটু থিতু হয়ে নিই, পরে এসো।

কায়সার আবার ব্লকড হয়ে যান। কোনো মেসেজ আর দিতে পারেন না। অদ্ভুত অনুভূতি। আশা-নিরাশার মাঝখানে কায়সার। রিশা কি ফিরে আসবে? এমন অদ্ভুত আচরণ কেন করে রিশা? কায়সারের খুব কাছের বন্ধুবান্ধব রিশার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলছেন। এমন মেয়ের সঙ্গে সারা জীবন একসঙ্গে না থাকাই শ্রেয়। তাদের সঙ্গে কি আজকের কথোপকথন শেয়ার করবেন কায়সার। কায়সার ভাবেন, না, এটা ঠিক হবে না। দেখা যাক, আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করি, রিশার মতিগতি কিছুটা ঠাহর করে নিই আগে।
বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় থাকার কারণে কায়সারের খানিকটা পরিচিতি আছে এই শহরে। কারও সাহায্যের দরকার হলে তিনি চেষ্টা করেন সাধ্যমতো। সেটা কি বাংলাদেশ কমিউনিটি, কি বাইরের কমিউনিটি। কি ছেলে, কি মেয়ে। কোনো ভেদাভেদ করেন না কায়সার।

কায়সারের চেয়ে বয়সে কয়েক বছরের বড় ভিনদেশি এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক অনেক দিন আগে থেকেই। খুবই সামাজিক তিনি, নাম জুলিয়ানা (ছদ্মনাম। খুবই ভালো মানের চাকরি করেন। বেতন হবে প্রায় কায়সারের তিন গুণ। টাকা–পয়সা, বাড়ি-গাড়ি থাকলেও কোনো এক অজানা কারণে তিনি এখনো অবিবাহিত।
তিনি বাসা থেকেই অফিস করেন। একঘেয়েমি লেগে যায়। মাঝেমধ্যে চ্যাট হয় কায়সারের সঙ্গে। তার বাসাও কাছে। ১৫ মিনিটের ড্রাইভ। করোনার কারণে অনেক দিন দেখা হয় না। জুলিয়ানার টেক্সট আসে।
কায়সার, তুমি আজ বাসায় আসতে পারবে?
কেন, কী হয়েছে?
আমার বড় ভাই দেশে রোড অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, অবস্থা ভালো নয়, ডাক্তার ভালো কিছু বলতে পারছে না। এখন আইসিইউতে আছেন। কোভিডের কারণে বর্ডার বন্ধ। তাই দেশে যেতে পারব না।

জুলিয়ানা বয়সে বড় হলেও সহজেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন, তা কায়সারের অনেক দিন আগে থেকে জানা। কায়সারের যাওয়া উচিত। অভিবাসীর দেশ। এখানে তো সবাই পর, তবু সবাইকে আপন করে নিতে হয়। একেক দেশ থেকে একেকজনের আসা। কারও স্বামী এখানে তো স্ত্রী আরেক দেশে বা প্রদেশে। সন্তান এখানে তো মা-বাবা ভিন্ন দেশে। বিপদে কাছের আত্মীয়-স্বজন পাওয়া খুবই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
কায়সার তখন অফিসে, বলেন, ‘জুলিয়ানা, আমি রাত ১০টার পর অ্যাভেইলেবল হব, তোমার সমস্যা না হলে আমি তখন আসি?’
আমি বাসায় আছি, চলে এসো।
কায়সার বাসায় এসে একটু ফ্রেশ হয়ে গাড়ি স্টার্ট করতেই জুলিয়ানার টেক্সট।
তুমি কখন আসছ?
এখন, ১৫ মিনিট লাগবে।

আমার ফ্রিজে খাবার আছে কিন্তু রুচি পাচ্ছি না, তোমার কি খাবার আছে?
খুবই দুঃখিত জুলিয়ানা, আমারও খাবার নেই। আমার আজ রান্না করার ইচ্ছা ছিল। তবে অল্প সময়ে আমি বাংলাদেশি শুঁটকি আর লাউ রান্না করতে পারি। আমাকে দেড় ঘণ্টা সময় দিতে পারবে?
সমস্যা নেই। আমি জেগে থাকব, আর ঘুমিয়ে গেলে কল দিয়ো।

আরও পড়ুন

কায়সারের রান্না তিনি অনেকবার খেয়েছেন। ভালো রান্না করতে পারেন কায়সার। আজও ভালো রান্না করার চেষ্টা করেন। জুলিয়ানা যেহেতু মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, তাই রান্নায় মজা হলে একটু খেতে পারবেন। কায়সারের রান্না করে জুলিয়ানার বাসায় যেতে রাত ১২টা বেজে যায়। জুলিয়ানা জেগে আছেন তখনো।

বড় ডুপ্লেক্স বাসা, একাকী থাকেন জুলিয়ানা। সারা দিন কেঁদেকেটে, অনেক ভেঙে পড়েছেন। হয়তো না খেয়ে আছেন সারা দিন। এমন পরিস্থিতিতে কি সান্ত্বনা দেবেন, সে ভাষা জানা নেই কায়সারের। তবু চেষ্টা করেন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার জন্য। সবার জীবনে এমন খারাপ সময় আসে। জুলিয়ানারটা এসেছে হয়তো একটু বেশিই খারাপ হয়ে। আরও খারাপ কোনো কিছু ঘটে গেলে তাকে হয়তো শেষ দেখা ভিডিও কলের মাধ্যমেই সারতে হবে। খুবই বেদনাদায়ক।

কায়সারের পরদিন অফিস আছে। জুলিয়ানা ছুটি নিয়েছেন। পারিবারিক ক্রাইসিসে ছুটির সমস্যা হয় না। যতই কাজ থাকুক, ছুটি পাওয়া যায়। বসেরা খোঁজখবর নেন। অনেক মানবিক। কায়সারের তাড়াতাড়ি চলে আসা দরকার। দুজনই একসঙ্গে খেয়ে নেন। জুলিয়ানা এমন অবস্থাতেও অনেক প্রশংসা করেন কায়সারের রান্নার। সারা দিন খাননি, তাই একটু বেশি পরিমাণে খেয়ে নেন, আর কিছু রেখে দেন পরদিন খাবেন বলে।

জুলিয়ানা তার এমন অ্যাক্সিডেন্ট মানতে চান না। দুই দিন আগেই তো তাদের পারিবারিক ভিডিও কনফারেন্স কল হলো। সেখানে তো অনেক হাসিখুশি, মজা করলেন। অনেক স্মৃতি রোমন্থন করলেন। তাদের বাবা নেই, তিনিই এখন অভিভাবক হিসেবে সবাইকে গাইড করেন। কোনোভাবেই বাস্তবতা মানতে চান না জুলিয়ানা। আসলে সবার ক্ষেত্রেই বুঝি এমন হয়। সান্ত্বনা দেওয়ার সময় দিতে হয় বলে দেন, কিন্তু নিজেরটা হলে মানা কঠিন হয়ে যায়।
বিদায় নেওয়ার একবারে আগমুহূর্তে জুলিয়ানা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজেকে অনেক ভারী মনে হয়। কায়সারের কাঁধে মাথা রেখে নিজেকে হালকা করতে চান। কায়সার মাথায় হাত বুলিয়ে বৃথা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন।

জুলিয়ানা তাদের পারিবারিক স্মৃতি একের পর এক বলে যান, আর প্রলাপ বকতে থাকেন। কাঁধ থেকে কায়সারের বুকে আশ্রয় নেন। কায়সারও একটু যেন ইমোশনাল হয়ে যান। শোফায় গা এলিয়ে দেন দুজনই। প্রলাপ বন্ধ হয়ে যায় জুলিয়ানার। তবু কায়সারকে জড়িয়ে ধরে থাকেন অনেকক্ষণ।

কায়সারের অফিস আছে, তার যাওয়া চাই। ‘আর আধা ঘণ্টা থাকো, প্লিজ,’ জুলিয়ানা বলেন, ‘আমার অনেক ভয় হয়, রাতে ঘুম হবে না।’ কায়সারকে জড়িয়ে ধরে থাকেন সারাক্ষণ। কায়সারের বুকে আশ্রয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন। মনে হয়, এই পৃথিবীর শেষ আশ্রয়স্থল এখন এটাই।

আধা ঘণ্টা আর শেষ হয় না। রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়, ভোর হয়, কিন্তু জুলিয়ানার আধা ঘণ্টা ফুরাতে চায় না। ভোর হলে অনেক বুঝিয়ে জুলিয়ানার কাছ থেকে বিদায় নেন কায়সার।

কায়সার গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ভাবেন, জুলিয়ানা কি শুধুই ভয়ের কারণে সারা রাত জরিয়ে ধরে ছিলেন, নাকি আরও অন্য কিছু খুঁজছিলেন কায়সারের কাছে। যদিও এটাতে অশ্লীলতার কিছু ছিল না। চলবে…

*লেখক: পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, ফ্রেডেরিক্টন, কানাডা