ঈশ্বরপ্রেম
এই ধরাধামে পাঠিয়ে আমাকে অনেক দিয়েছ প্রভু। আমি ধন্য। তোমার কৃপায় পেয়েছি এসব। তুমিই দিয়েছ। আমি তোমাকে সবকিছু সঁপে দিলাম। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন—সবাইকে তুলে দিলাম। শুধু তা-ই নয়, আমার দেহ-মন-প্রাণ তোমার চরণে নিবেদন করলাম। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন—দ্রুতলয়ে চলছে কথাগুলো।
মৃদঙ্গ বাজছে আরও তীব্রতা নিয়ে। ‘হরিবোল, হরিবোল’ বলে ভক্তরা উচ্চকিত হচ্ছেন। পরিবেশ মুখর হচ্ছে। কথকশিল্পী পুষ্প রানী উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, আজকের নবদ্বীপ বৃন্দাবন হলো। নারীদের উলুধ্বনি অন্য রকম আমেজ এনে দিল অনুষ্ঠান আয়োজনে।
ফরিদপুরের চাঁদহাট পশ্চিমপাড়ার হরিনাম সংকীর্তনের কথা বলছি। সাত দিনব্যাপী এ আয়োজনের পর্দা নামে ২৪ মার্চে। শ্রীকৃষ্ণের দোলপূজার মধ্য দিয়ে ১৮ মার্চ শুরু হয় অনুষ্ঠানের। পরপর দুই দিন ছিল শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ। তারপর মহানাম যজ্ঞানুষ্ঠান। ষোলো নাম বত্রিশ অক্ষরের সংকীর্তন চলে এক নাগাড়ে ৭২ ঘণ্টা । শেষ হলো মহাপ্রভুর ভোগ রাগ ও মহাপ্রসাদ বিতরণের মধ্য দিয়ে। প্রচলিত কথায় এ ছিল মহোৎসব। এবার ছিল আয়োজনের চতুর্থ বছর। উৎসব আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন দুলাল সরকার। শুরুতে তিনি সবার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
গ্রামের সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ মন্দির। উৎসব প্রাঙ্গণে উদ্বোধনী বক্তব্য দেন মন্দিরের প্রধান নির্বাহী কানাই সরকার। যাঁদের শ্রম ও মেধার গুণে অনুষ্ঠান করা সম্ভব হচ্ছে, তাঁদের প্রতি তিনি তাঁর ভক্তি ও ভালোবাসা প্রকাশ করেন। মহানুষ্ঠানের শিল্পী–কুশলীদের স্বাগত জানান সব থেকে সুন্দর পর্বটি মঞ্চায়নের জন্য। গ্রামের পক্ষ থেকে সবার কাছে আশীর্বাদ চান। কামনা করেন, অনুষ্ঠানের এ প্রয়াস যেন অব্যাহত থাকে। অনুষ্ঠান আয়োজনের কর্মসূচি সামনের দিকে গড়ায়। ভক্তিমাখা শ্রদ্ধাভেজা আবহ বিরাজ করে। শেষের আগের দিন ছিল অষ্টকালীন লীলাকীর্তন।
আসর চলছে। ভক্ত বলছে, ‘হে সনাতন। জগতের দুঃখ মোচন হবে কীভাবে?’ পুষ্প রানী কেবল প্রশ্ন নয়, গুরু যে উত্তর দিচ্ছেন, তা–ও তুলে ধরছেন, ‘ভগবানের চিত্রপটে বসে অশ্রুতে বিসর্জন দাও নিজের অর্জনকে। বলো, “আজ হতে তুমি আমার প্রভু, আমি সেবকমাত্র।” কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। কিন্তু দুঃখের সমাচার, ভূমিপুত্র কৃষ্ণদাস তা ভুলে গেল। পৃথিবীর মায়ায় জড়িয়ে গেল।’
ভক্তরা শুনছেন পুষ্প রানীর কথাগীতি। তাঁর দলে আছে শ্রীখোল, হারমোনিয়াম, করতাল; আছেন দোহার। একটিমাত্র দল নয়। আরও দুই দল পরিবেশন করছে এ অংশে। এরই এক দলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বৈষ্ণব–সম্পর্কিত গীতিকবিতার লেখক নরোত্তম দাস বাবলু। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জন্ম তাঁর। আরেক দলে বগুড়ার নন্দীগ্রামের নন্দিনী, কথকশিল্পী শম্পা রানী। তাঁদের কথায় পরে আসি।
গুরু বলছেন কিংবা বুঝিয়ে যাচ্ছেন, ‘“প্রভু তুমি আমাকে কৃপা করে গ্রহণ করো” বলে আকুলতা প্রকাশ করো। জানাও, “এ জগতে তোমার মতো এমন আর পাব নাকো।” স্রষ্টার প্রতি সমর্পণ করো নিজেকে। বলো, “তোমাকে পাওয়ার জন্য কেবল, তোমাকে লাভ করার জন্য আমার এ প্রয়াস।”’
ভালোবাসা, ভক্তি কিংবা শ্রদ্ধা—এ প্রকাশ জীবের প্রতি। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর। স্বামী বিবেকানন্দও তা–ই বলেছেন। আসরে ভক্তদের মধ্যেও প্রবল এ লক্ষণ। দেখলাম, টিকিমাথায় ধুতি পরা নীলরতন কুণ্ডু বুকে নিলেন সতীর্থকে। সেখানে সমুজ্জ্বল চশমা চোখে শাল গায়ে সুকোমল সাহা, হালকা সবুজ জামা গায়ে সুনীল শিকদার। সামনে আরও ভক্ত। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। শিল্পীর কপালে জয়তিলক পরিয়ে দিলেন বয়সী এক নারী।
কথকশিল্পী সুরে সুরে জানালেন, আত্মনিবেদনের কোনো বিকল্প নেই। সে জন্যই প্রয়োজন কৃষ্ণচরণে আত্মসমর্পণ। জগতের সব দুঃখমোচনের এই এক পথ।
বৈষ্ণব কবি রাধারমণও এ মতবাদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন। তবে ভূমিপুত্র কৃষ্ণদাস মনে হয়, বুঝেও বুঝছে না। অন্যদিকে জীবে প্রেম নিয়ে ছুটেছেন একদল তরুণ। চণ্ডী প্রসাদ সরকার যেন আঙুল উঁচিয়ে শাসালেন সেদিন। বললেন, ‘আমাকে আসতেই হবে এবার। দিলীপ সরকার একেবারে লেগেই ছিলেন। ভাবলাম, না এলে কি চলে! তাই তো তাঁদের সঙ্গেই চলছি আমি। উপভোগ করছি তাঁদের বহুরাশ ভালোবাসা। তাঁরা গভীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়ানো। আসবে, আসবে তাঁদের প্রাণের মানুষ। এল সেই ভালোবাসা। সুকুমার সরকার, বলাই সরকার, সুশীল সরকার অভিনন্দন জানালেন। নিখিল সরকারও ছিলেন এ দলে।’
আসরের কথাগুলো মহিমা পাচ্ছে অজস্র গুণে। এক ভক্ত অন্যজনের পায়ের কাছে হাত দিয়ে চরণধূলি নেওয়ার চেষ্টা করছে। হঠাৎই যেন আলো খেলে গেল। কী এক পরিবর্তন এল! ‘হে দয়াময় তুমি আমার... ক্রন্দনধ্বনি...এ যে প্রাপ্তির কান্না।’ পরের সারিতে দেখি, এক তরুণী মা তাঁর সন্তানের ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে আদর ঢেলে দিচ্ছেন।
পুষ্প রানী গাইছেন, দরাজ তাঁর কণ্ঠ! ‘আজ হতে আমি তোমার হয়ে গেলাম।’ নবদ্বীপ বৃন্দাবনে রূপ নিল বুঝি! চাঁদহাট যে তীর্থভূমি। এ বঙ্গের নবদ্বীপ। তাই তো চাঁদহাট চাঁদমুখ দেখাল। প্রভু উদিত হলেন। তাঁরা গাইছেন, ‘তোমার হয়ে গেলাম...।’ ধন্য ধন্য পড়ে গেল। উদাত্ত চিত্তে উচ্চারিত হলো, ‘নিতাই গৌর, হরি হরি বোল...।’
যিনি আসরে যান, ওই জায়গা বুঝি তাঁর হয়ে যায়। পাঞ্জাবি পরে আছে এ দলের প্রত্যেক সদস্য। উঠে আসেন তারই মধ্য থেকে একজন প্রভাষক। বয়স ও ব্যাখ্যার ধরন দেখে এমন পদবি বেমানান নয় বলেই মনে হয়। শুনছি নরোত্তম দাস বাবলুর বচন। অন্যরা ভক্ত, বোঝার শক্তিতে তাঁরা উজ্জ্বল। তবে আমি শুনি শিক্ষার্থীর মতো। বাচনভঙ্গিটি আকর্ষণ করে আমাকে।
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সূত্র টানেন। বাবা তাঁর সন্তানকে চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, সাংবাদিক করে গড়ে তোলেন। পুণ্যের কাজ এটি। অন্যদিকে গুরুকর্ম হচ্ছে সুকৃতি। ‘একজন সদ্গুরুর চরণে আশ্রয় নাও। চৈতন্যদেবেরই শিক্ষা, সব সঁপে দাও। ভগবানের কাছে যাওয়ার জন্য দরকার গুরু, দীক্ষাগুরু।’ গান ধরেন, নিজেরই বাঁধা সে গান, ‘ওগো দয়াময়...।’ ‘হরিবোল, হরিবোল’ ধ্বনি দখল করে নেয় চারপাশ।
গুরুজনে আশ্রয় না করে চললে আসে হতাশা। মনস্তাত্ত্বিকেরা এমন করেই বলেন। আমি সেভাবেই বুঝি। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে ব্যাখ্যা করেন। শ্রীখোল বাজে। করতাল মনের ভেতরের তালের সঙ্গে মিলিয়ে নেয় নিজের তাল।
কেউ বিষ খেয়ে গাছে ঝোলে, ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। এটা কি ঠিক? তারা ভূত হয়ে যায়। প্রকৃতিতে মিশে যায়। বাতাসে এক হয়। পর্যায়ক্রমে মেঘের সঙ্গে লীন হয়। বৃষ্টিধারার সঙ্গে পৃথিবীতে ফসলের ওপর পড়ে। মা–বাবা খায়। হয়তো তারা ভেতরে কোনোও দেহের অস্তিত্ব পায়। ভ্রূণের কথাই বলেছেন নিশ্চয়।
‘কোনো সময় জীবাশ্ম থেকে ফসল হয়। আবার কখনো ফসল হলেও তা মানুষের খাবার হয় না। অর্থাৎ তোমার জন্ম মানবজনম হয় না,’ বলেন কথক। শিল্পী যোগ করেন, ‘৮৪ লাখ জনম পর হয় মানবজনম।’ গলায় লম্বা টান দেন তিনি। কী মধুর করে আনেন কথাগুলো! ‘আমার ভবের দেহ যোগের ঘরে কবে হবে যোগ। বলো হে যোগেশ্বর ....।’
ছয়টা রিপু ধরে আছে। এ জন্য গোবিন্দ-কথা কানে আসে না। ‘কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য—এসব অন্তরায়। আর অহংকার, তা–ও পাঁচটি—বংশ, বিদ্যা, রূপ, ক্ষমতা ও অর্থ। এ থেকে সরে আসা চাই। সেটা সম্ভবও। এ কর্ম, ইচ্ছাশক্তি—সবই তোমার জন্য। তোমারই উদ্দেশে নিবেদন করতে চাই। এ জীবনের ভার বয়ে নিতে চাই না।’ বলেন, ‘কেবল তোমার চরণে একটু জায়গা দিয়ো।’
নরোত্তম দাস মোহনীয় করে তোলেন সময়টিকে। এ নিয়ে অবশ্য আসরের বাইরে কথা হয় একান্তভাবে। তিনি ইউটিউব চ্যানেলে পাঁচটি ভক্তিগীতি আপলোড করেছেন। আরও পাঁচটি আসবে খুব তাড়াতাড়ি। এর বাইরে তাঁর এমন আরও ১০০টি গান প্রস্তুত রয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় করেছেন নিত্যানন্দ ধাম, বিশেষ নাম খেতুরি ধাম। এটাই তাঁর আশ্রম। বললেন, ‘জীবনকে আরও উজ্জ্বল করার মাধ্যম ভক্তিগীতি।’
একদল যুবকের প্রচেষ্টায় অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে তাৎপর্যময়। সজল সরকার দেখি তৎপর নানা কর্মে। সুবাস সরকার, প্রদীপ সরকার জিনিসপত্র ঠিকঠাক রাখেন গভীর মনোযোগে। খোকন সরকার ব্যস্ত—প্যান্ডেল নির্মাণ থেকে তাঁর ব্যস্ততা শুরু। বিপ্লব সরকার ছবি তুলে আপলোড করছেন। অলক সরকার দেখি বন্ধুদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। বাবলু হালদার একফাঁকে সেরেছেন সহস্র দায়িত্ব।
কথা হয় শম্পা রানীর সঙ্গে। ঈশ্বরকে ভালোবাসার কিংবা ভক্তের সঙ্গ পাওয়ার মধ্য দিয়ে যে শান্তি, তার তুলনা হয় না। পুষ্প রানী বলেন, ‘ভগবতে ভক্তি থাকলে মানুষকেও ভালোবাসা যায়। তাই তো গোপাল ভক্ত, রঘুনাথ দাস প্রেমসাধনা করেছেন। বিজয় সরকার জীবের কল্যাণে কৃষ্ণভক্ত মায়ের জন্য প্রার্থনা করেছেন।’
নরোত্তম দাসের বাচনিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন ভক্তরা। তাঁর গানের সঙ্গে মিলে যায় চরাচর।
এরই ধারাবাহিকতায় ভক্তের জায়গা মিলে যায় গুরুর চরণতলে।
শ্রোতারা সফলতার মুখ দেখেন। জোর গলায় তাঁরা সমস্বরে বলেন, ‘নিতাই গৌর হরিবোল...।’
তাঁরা ঈশ্বরের পাদপদ্মে শান্তি খোঁজেন...।
লেখক: নিমাই সরকার, প্রকৌশলী, আবুধাবি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কর্মরত