ঈশ্বর মানুষের সঙ্গেই আছেন

ঈশ্বর যখন এই পৃথিবী সৃষ্টি করলেন, তিনি চাইলেন যেন সবাই এ পৃথিবীতে সুখে শান্তিতে বাস করে। আদিতে ঈশ্বর মানুষকে পুরুষ ও নারী করেই সৃষ্টি করলেন। বাইবেলের আদি পুস্তক, অধ্যায়-১-এর ২৭ ও ২৮ পদে উল্লেখ আছে এমন। সেখানে বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বর আপন প্রতিমূর্তিতে মানুষ সৃষ্টি করলেন। পুরুষ ও নারী করেই তাদের সৃষ্টি করলেন। ঈশ্বর তাদের আশীর্বাদ করে বললেন, তোমরা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতায় পূর্ণ হও এবং নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে পৃথিবী ভরে তোল।’
ঈশ্বর পুরুষকে নাম দিলেন ‘আদম’, আর নারীকে ‘হবা’। ইডেন উদ্যানে বেশ সুখেই ছিলেন তাঁরা। পরে সদাপ্রভু ঈশ্বর আদমকে আজ্ঞা করলেন, ‘তুমি এই উদ্যানের সব বৃক্ষের ফল খেতে পারবে; কিন্তু জ্ঞানদায়ক যে বৃক্ষ, তার ফল খেতে পারবে না (বাইবেল আদি পুস্তক, অধ্যায়-২, পদ-১৭)।’ কিন্তু একদিন শয়তান সাপের ছদ্মবেশে হবাকে ওই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে প্রলুব্ধ করে। সেই প্রলোভনে ভুলে হবা সেই ফল খেলেন, আদমকেও তা খেতে দিলেন। শয়তানের প্রলোভনে প্রলুব্ধ হয়ে আদম ও হবা ঈশ্বরের অবাধ্য হলেন। এই অপরাধে ইডেন থেকে বিতাড়িত হলেন তাঁরা।
স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর কেটে গেল বহু বছর। এক সময় মানুষ ভুলে গেল ঈশ্বরের আদেশ। ঈশ্বর রাজ্য বিস্তারের বদলে মানুষ নিজেদের মধ্যে কলহ-হিংসা-দ্বেষে মেতে উঠল। পাপে পঙ্কিল হলো পৃথিবী। সেই পরিস্থিতিতে মানুষকে সঠিক পথে ফেরাতে পৃথিবীতে এলেন অনেক সাধু। মানুষকে মন পরিবর্তনের আহ্বান জানালেন তাঁরা। কিন্তু খুব কমই তাঁদের আহ্বানে সাড়া দিল। এই অবস্থায় ঈশ্বর নিজ পূত্রকে পৃথিবীতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে তাঁর আগে তিনি পাঠালেন দীক্ষাগুরু যোহনকে। যিশুর অগ্রদূত হিসেবে আসা যোহন মানুষকে ঈশ্বরের পথে ফেরার আহ্বান জানালেন। তাঁর এই আগমনের কারণ অনেক আগেই ঘোষিত হয়েছে। তাঁর কথা যিশাইয়া বলে গেছেন অনেক আগেই। ‘দেখ তোমার আগে আমি আমার সংবাদদাতাকে পাঠাচ্ছি। সে তোমার পথ প্রস্তুত করবে। (পবিত্র বাইবেল মার্ক, অধ্যায়-১, পদ-২)।’
সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ীই দীক্ষাগুরু যোহন মরু এলাকায় গিয়ে লোকেদের ব্যাপ্টাইজ করেছিলেন। প্রচার করেছিলেন ঈশ্বরের বাণী। তিনি লোকেদের আহ্বান করেছিলেন যেন তারা পাপের পথ থেকে ফিরে আসে, মন দেয় ঈশ্বরের আরাধনায়। (বাইবেল মার্ক, অধ্যায়-১, পদ-৪)।’ দীক্ষাগুরু যোহনের কথা অনেকে বিশ্বাস করল, আবার অনেকে করল না। কেউ কেউ তাকে নির্যাতন করে, নানা অপবাদ দিয়ে বিতাড়িত করল। কিন্তু ঈশ্বর চাইলেন মানুষ যেন পাপের পথ থেকে ফিরে আসে। ‘আদি পাপের’ মধ্য দিয়ে মানবজাতি যেভাবে কলুষিত হয়েছিল, তা থেকে যেন তারা মুক্ত হতে পারে। এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাববাদী এই পৃথিবীতে এসেছেন। কিন্তু মানুষ তাদের কথা শোনেনি। তারপরও ঈশ্বর ভুলতে পারলেন না মানুষকে, নিজের সৃষ্টিকে।
ঈশ্বর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, একদিন তিনি মানুষকে স্বর্গের অধিকার ফিরিয়ে দেবেন। যে আদি পাপের ফলে মানবজাতি কলুষিত হয়েছিল, সেই পাপ থেকে মানুষের মুক্তির জন্য ঈশ্বর নিজ পুত্রকে মানুষ হিসেবে পাঠালেন নাজারেথ শহরের যোয়াকিম ও আন্নার মেয়ে কুমারী মারিয়ার গর্ভে। ঈশ্বরের এই ইচ্ছার কথা জানাতে স্বর্গদূত গ্যাব্রিয়েল আসেন মারিয়ার কাছে। গ্যাব্রিয়েল কুমারী মারিয়াকে দেখা দিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনার কথা জানান। গ্যাব্রিয়েল বললেন, ‘প্রণাম মারিয়া! পরম কৃপাধন্য তুমি। প্রভু তোমার সঙ্গেই আছেন। (বাইবেল লুক, অধ্যায়-১, পদ-২৮।)’ গ্যাব্রিয়েলকে দেখে মারিয়া গভীরভাবে বিচলিত হলেন। তিনি ভাবলেন এই অভিবাদনের অর্থ কি? স্বর্গদূত তখন তাঁকে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না মারিয়া। তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোন তুমি গর্ভধারণ করে একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেবে। তার নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন এবং পরাৎপরের সন্তান বলেই বিবেচিত হবেন।’ মারিয়া দূতকে বললেন, ‘তা কী করে হবে? আমি যে কুমারী?’ স্বর্গদূত তাঁকে বললেন, ‘পবিত্র আত্মা এসে তোমার ওপর অধিষ্ঠান করবেন; পরাৎপরের শক্তিতে আচ্ছাদিত হবে তুমি। তাই তোমার গর্ভে যার জন্ম হবে, তিনি পবিত্রজন ঈশ্বরের পুত্র বলেই বিবেচিত হবেন।’ প্রথমে ভয় পেলেও ঈশ্বরের পরিকল্পনা জেনে রাজি হলেন মারিয়া। তিনি বললেন, ‘আমি প্রভুর দাসী। আপনি যা বলেছেন, আমার তা-ই হোক। (বাইবেল লুক, অধ্যায়-১, পদ-৩০ থেকে ৩৮)’।

লেখক: ক্যাথলিক মণ্ডলীর একজন ভক্ত।