ঈদের দিনের অভিজ্ঞতা
১৪ মের দিনটি ছিল আমার জন্য বিশেষ। প্রথমত, এ দিনটি ছিল বাংলাদেশে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শাওয়াল মাসের প্রথম দিনটিকে ঈদুল ফিতর হিসেবে উদযাপন করেন তাঁদের প্রতিপালকের প্রতি শুকরিয়া আদায়ের উপলক্ষ হিসেবে। একই সঙ্গে দিনটি ছিল শুক্রবার, রাসুল (সা.) শুক্রবারকে সাপ্তাহিক ঈদ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। সপ্তাহের অন্যান্য দিনের তুলনায় শুক্রবারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে একেবারে আলাদা। তবে আরও একটি জিনিস উল্লেখ না করলে নয়, ১৪ মে এ দিনটি ছিল আমার ২৪তম জন্মদিন। ১৯৯৭ সালের এই দিনে আমি প্রথম পৃথিবীর আলো দেখতে পাই।
তবে সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, এ বছর ঈদ ও জন্মদিনের দিনটি আমার জন্য ছিল একেবারে সাদামাটা একটি দিবস। ঈদ ও জন্মদিনকে উপলক্ষ করে আমার মাঝে সেভাবে আগ্রহ ফুটে ওঠেনি। প্রথমবারের মতো বেশ কিছু প্রশ্ন ঘুরেফিরে আমার মাঝে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আগে কখনো এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইনি।
করোনার কারণে দীর্ঘ প্রায় এক বছর হলো ইউনিভার্সিটি বন্ধ, অনলাইনে অবশ্য আমাদের শিক্ষকেরা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, তবে ইউনিভার্সিটি খোলা থাকলে শিক্ষকদের সংস্পর্শে যেভাবে কোনো কিছু জানার সুযোগ হতো, অনলাইন ক্লাসে সেটি হচ্ছে না। এবারের ঈদ ঘিরে শুরুতে অতিরিক্ত উত্তেজনা কাজ করছিল, দীর্ঘদিন পর নিজ দেশে ঈদ উদযাপনের সুযোগ মনের মাঝে বাড়তি আনন্দ যোগ করেছিল। সেই সঙ্গে জন্মদিনকে ঘিরেও উদ্দীপনার জোয়ারে ভেসে উঠলাম।
ঈদের দিন বিকেল বেলায় কারওয়ান বাজারে গিয়েছিলাম। লেখালেখির জগতে যাঁদের আমি শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধা করি, তাঁদের মাঝে রফিক ভাই (এখানে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে) অন্যতম, রফিক ভাই বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় একটি মিডিয়া হাউসে কাজ করছেন। সাংবাদিকতার খুঁটিনাটি অনেক বিষয় তিনি নিজ হাতে আমাকে শিখিয়েছেন। বিকেলে যখন কারওয়ান বাজারে পা রাখি, আমার বুকটা ভীষণভাবে ভারী হয়ে ওঠে। আমি দেখলাম উচ্চবিত্ত শ্রেণির অনেকে গাড়ি হাঁকিয়ে কারওয়ান বাজারের মূল সড়ক বরাবর ছুটে চলছে। উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে আসা অনেকে বিভিন্ন স্টাইলিশ বেশভূষায় নিজেদের সুসজ্জিত করেছে। খানিক পরই দেখি কারওয়ান বাজারের ফুটপাতে একদল মানুষ ঈদের দিনেও যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কোনো এক মা তার কোলের শিশুকে নিয়ে এই দিনেও ছুটে বেড়াচ্ছেন জীবন ও জীবিকার সন্ধানে। নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে যেন ঈদ অনুভূতি বলে কিছুই নেই, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে মহামারি আকারে বিস্তার লাভ করা করোনাভাইরাস ও লকডাউন। অনেক মানুষের মুখে ঈদের আমেজকে কেন্দ্র করে কোনো হাসি নেই, রফিক ভাইও দেখলাম কোনো এক অজানা কারণে বিষণ্ন। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে শুধু বললেন, সাংবাদিকতা করে আর দিন চলে না।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫০ বছরে আমরা পা রেখেছি তবে এখনো আমরা কাঙ্ক্ষিতভাবে বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ করতে পারিনি।
জীবনটাকে এবার বুঝি সত্যি কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম, আমাদের চারপাশের অনেক মানুষ ভালো নেই। তাই এ পরিস্থিতিতে জন্মদিন কিংবা ঈদ অথবা শুক্রবার থেকে শুরু করে কোনো উৎসবের আনন্দ রঙিন হয়ে প্রস্ফুটিত হতে পারে না। সত্যি আমি ভীষণভাবে ব্যথিত।
এ কারণে তাই ১৪ মের সারাটা দিন কেটেছে একেবারে জৌলুশহীনভাবে, এ বিশেষ দিনে তাই নতুন করে কোনো ছবি তোলারও আগ্রহ পোষণ করিনি। গত বছরের অক্টোবরে আমার গ্রিসের রাজধানী এথেন্স ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল, হঠাৎ করে সে সময়ের একটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে গেল।
এথেন্সের প্যানাথেনাইকো স্টেডিয়ামের কথা আমরা সবাই জানি, আনুমানিক ৩৩০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মানবসভ্যতার ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয় এ স্টেডিয়ামে। সমগ্র স্টেডিয়ামটি মার্বেল পাথর দ্বারা নির্মিত। আজকের দিনেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ এ স্টেডিয়ামে জড়ো হন। অলিম্পিকের স্মৃতিকে সামনে রেখে তাঁরা বিভিন্ন ধরনের শরীর চর্চা করেন। এ স্টেডিয়ামটি ঘুরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
বাস্তব সত্যি ভীষণ নির্মম, আমরা প্রত্যেকে অলিম্পিক প্রতিযোগিতার মতো জীবনের লক্ষ্য অর্জনে একটু একটু করে সামনের পথে পা বাড়াচ্ছি। সবাই যে জীবনের লক্ষ্য অর্জনে সফলকাম হয় তেমনটিও নয়, যাঁরা এ দৌড় থেকে ছিটকে পড়েন জীবন তাঁদের কাছে নরকের সমান হয়ে ওঠে। হয়তো বা তাঁকে ভবিষ্যতে কেউই সেভাবে মনে রাখতে চায় না। সবাইকে তাই উদাত্ত আহ্বান জানাই ঈদের আনন্দ আমরা যেন কেবল নিজেদের মাঝে সীমাবদ্ধ না রাখি। আশপাশের ছিন্নমূল মানুষগুলোর দিকেও একবার তাকানোর চেষ্টা করি, যারা আজ সত্যিকার অর্থে চরমভাবে বিপর্যস্ত। এ সমাজটা যেমন আমাদের ঠিক তেমনি তাদেরও আমাদের এ সমাজের ওপর সমান অধিকার রয়েছে। যখন আমরা জ্বরে আক্রান্ত হই, তখন স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে আমাদের শরীরের কোথাও কোনো ধরনের সংক্রমণ হয়েছে। অর্থাৎ শরীরের কোনো অংশের সংক্রমণ যেমনভাবে স্বাস্থ্যের ওপর বিপর্যয় সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনিভাবে সমাজের এক অংশের প্রতি গুরুত্বের সঙ্গে উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ না করলে সমগ্র সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। তাই বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণের জন্য এখন থেকেই আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসা উচিত।
*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।