ঈদের চাঁদ দেখতে টাকা লাগে না, ফ্রি

ছবি: এএফপি

চাঁদ দেখে ঈদ। ঈদের কথা শুনলে মনের মধ্যে আনন্দের বন্যা উথালপাতাল খেলে। বাড়ির পাশে মাঠ। ঈদ সম্ভাব্য আগের দিনে চাঁদ দেখার অতিশয় আনন্দ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তাম সেখানে। মাগরিবের আজানের আগে সেখানে হাজির হতো পাড়ার মানুষ। চাঁদ কে আগে দেখবে তারও প্রতিযোগিতা থাকত মনে মনে। আঙুল তুলে ‘ওই যে চাঁদ’ বলে যে মানুষটি চিৎকার দিত, তার ভাবটা থাকত অন্য রকম।

আর যে বছর চাঁদ দেখতে না পেতাম, দৌড়ে বাড়ি গিয়ে রেডিও অন করতাম। এখন অবশ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অন করলেই তাবৎ দুনিয়ার খবরাখবর পাওয়া যায়।
সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন, প্রয়োজনের সঙ্গে জীবন, জীবনের জন্য নানাভাবে বিচ্ছিন্ন। আমাদের সে সময়ের ব্যাচ এখন বিচ্ছিন্ন। নতুন নতুন ব্যাচ আসে নতুন নতুন ঢঙে। আমিও বিচ্ছিন্ন হয়ে আজ কেপটাউনে।

কেপটাউনে এক যুগ শেষ হলেও কোনো দিন ঈদের চাঁদ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সত্যি এটা চিন্তার বিষয়। যে বাংলাদেশি ভাইয়েরা ঈদের চাঁদ দেখেছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা সৌভাগ্যবান। আর যাঁরা দেখতে পারেননি, তাঁরা আমার মতো ঈদের চাঁদ দেখতে না পাওয়া হতভাগা।

সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সময়ে মূলত বেশি ব্যস্ত থাকতে হয় এখানে। তখন চাঁদ দেখা তো দূরের কথা, আকাশ দেখা কষ্ট। তবে এত বছরে এক‌টিবার ঈদের চাঁদ দেখব না, তা কেমনে হয়? আবার চাঁদ দেখা বা না দেখা, সেটাই বা এমনকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়!

বিদেশে তো আর কেউ চাঁদ দেখতে আসিনি। যে লক্ষ্য নিয়ে আসা সেই লক্ষ্য বাস্তবায়ন করাই হলো বিদেশ। আমাকে একজন চাঁদ দেখানোর স্বপ্ন দেখিয়ে বছরের পর বছর তার কাছে বসিয়ে রেখেছিল। চাঁদ দেখার আশায় বুকও বেঁধেছিলাম।

বিদেশে এসে পেটে ভাতে কয়দিন বসে থাকা যায়। কিন্তু আমাকে আজ দেখাব, কাল দেখাব, এখানে দেখাব, ওখানে দেখাব এমনভাবে জাদুঘরে আটকানো হলো যে আমি বন্দী হতে বাধ্য হলাম। অবশেষে আমাকে একদিন চাঁদের পরিবর্তে মুলা দেখিয়ে বিদায় দিল। আর আমি অমাবস্যার অন্ধকারে নিমজ্জিত।

এত বছরে ঈদের চাঁদ দেখা হয়নি, এটা কি কোনো লজ্জার কথা হলো। চাঁদ দেখব সে চিন্তাটা মাথায় আসে না, এত ব্যস্ত আমরা। আর সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ঈদের আনন্দ সমাপ্ত হয় আমাদের। আনন্দ এতটাই সংকুচিত যে পুষ্প ফুটিবামাত্র পাপড়ি খসিয়া যায়।

অবশেষে এ বছর ঈদের চাঁদ দেখার শখ হলো। দোকান থেকে বের হয়ে রাস্তার ওপর দাঁড়ালাম। সঙ্গে ছিল জাকারিয়া ভাই। রাস্তায় গিয়ে গোলকধাঁধার গান গাইতে হলো। বিশাল আকাশ, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন। জানি না পশ্চিম কোন দিকে। জাকারিয়া, সে–ও জানে না।

নামাজ তো আদায় করি কিবলামুখী হয়ে। বুঝতে পারছি না চাঁদ কোন দিকে উঠবে। ডান আকাশে, নাকি বাঁ গগনে? সামনের অখিলে, নাকি পেছনের আসমানে?

যখন নভোস্থলে চাঁদ ওঠার দিক নির্ণয় করতে পারলাম না, তখন জাকারিয়া ফোন দিল আদিলের নিকট। ভাই, ঈদের চাঁদ কোন দিক দিয়ে উঠতে পারে? আদিল অপারগতার কথা জানিয়ে দিল এবং সে ১০ বছরের কেপটাউন জীবনে ঈদের চাঁদ দেখেনি, সেটা অকপটে স্বীকার করে নিল। ঠিক অনুরূপভাবে নয়ন, রহমান, তৌফিক, লিটন, রুবেল একই পথের পথিক বলে অনুধাবন বা অর্থোদ্ধার করা গেল!

শেষমেশ চাঁদ দেখা হলো না। জানি না কেপটাউনে আর কোনো দিন ঈদের চাঁদের দেখা পাব কি না। যদি আর দেখা না–ই হয়, তবে একটা আফসোস হয়ে থাকবে, এটা নিশ্চিত। যদিও ঈদের চাঁদ দেখতে টাকা লাগে না, ফ্রি। তবুও দেখা হয়নি চক্ষু মিলিয়া।

*লেখক: মাহফুজার রহমান, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা