ঈদে ওদের জীবনে খুশি নেই কেন?

লেখকের নাতি
লেখকের নাতি

ঈদ এসেছে। কিন্তু খুশির চেয়ে বেদনার ভারে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত। আমি ভাবছি নিজের ছোটবেলার কথা। যখন আমার মা আমাদের ঈদে নূতন জামা কিনে দিতে পারেননি। তার নিজর অন্তরের অনুভূতি ও আমাদেরসহ ঈদের প্রাক্কালে সেই সব বাচ্চাদের যারা আমার ছোটকালের মতো নন প্রিভিলেজড। আমার সহানুভূতি ও অন্তর বেদনা ওদের জন্য! আমার ঈদের আনন্দ ওদের জন্য উৎসর্গিত! ঈদ-মোবারক!

কয়েক দিন আগে ফেসবুকে প্রকাশিত ছোট বাচ্চার ইট বহন করার ছবি, যেটা অত্যন্ত করুন ও আয়নার মতো পরিষ্কার, অর্থবহ ও হৃদয় মাজারে ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো ঢং ঢং করে নক করছে। জিজ্ঞেস করছে তোমরা আমাদের জন্য কি করেছ? জীবন পথের চলার এ অপরিসীম ব্যবধান কষ্টের ও আত্মা বিদ্রোহ করে। ফরিয়াদ জানায় স্রষ্টায়।
আমার কেন যেন মনে হয় সকাল মানে শিশুকাল। এই খেয়াল আমার কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়াই মনে আসে। সকাল দেখলে আমরা যেমন বুঝতে পারি দিনটা কেমন যাবে, তেমনি ছোট বাচ্চা দেখলে আদর করলে বোঝা যাবে সে কেমন হবে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে-Morning shows the day. আমার মেয়ের দুটো ফুটফুটে ছেলে আছে। ছোটটাকে নিজের চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না, মনে হয় আল্লাহ তার নিজের হাতে তাকে বানিয়েছেন—ঠিক পুতুলের মতো। অপর দিকে দুষ্টুমিতে সেরা। বড়টা আবার opposite নম্র-ভদ্র। ওরা বড় হলে কে কেমন হবে ভবিতব্যই জানেন, কিন্তু আন্দাজ করা যায়।

লেখকের নাতি
লেখকের নাতি

আমার নিজের শৈশব কিন্তু ওদের মতো মধুর ছিল না। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর সৌভাগ্য আমার হয়নি। মার ভালোবাসা ছাড়া অন্য তিনটা দিকই অন্ধকার ছিল। সেই অন্ধকার থেকে আলোতে আসতে পেরেছি কিনা জানি না। কিন্তু যখনই দেখি আমার ছেলেমেয়ে আমার চেয়ে সহস্র গুণ ভালো আছে, তখন মনে মনে বলি আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের তিন জেনারেশনের improvement আশাব্যঞ্জক। জীবনের আশা নিরাশার দোদুল্যমানতায় আমি যখন ভুগি, আশা আমায় হাতছানি দেয়। ওর হাতটা ধরে অনেক দূর এগিয়ে যাই, বুকে ভরসা পাই।
আমি আমার কথা এবং নাতিনদের কথা চিন্তা করে হারিয়ে যাই। দেখতে পাই চোখের সামনে বীভৎস ছবি। হতাশা আর না পাওয়ার বেদনা যাদের নিত্য দিনের সাথি তাদের জন্য আমার বুকটা ভারী হয়ে আসে। তাদের হাহাকার আমার আত্মার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমার নিশ্বাস ভারী করে ফেলে। মিয়ানমারের সেই নদীর তীরে বালুচরে নিস্তেজ হয়ে হয়ে পড়ে থাকা মৃত শিশুটির ছবি দেখে আমি যেমন স্তম্ভিত হয়ে গেছি অথচ কিছু করার নেই ক্ষমতাবানদের দাপটে। তেমনি অসংখ্য নাম না জানা এই আমার মতো non privileged শিশুদের জন্য আমার কিবা করার থাকতে পারে। আমি ওদের কষ্টটা নিজের কষ্ট থেকে বুঝতে পারি। আমার আত্মার আলো ওদের অন্ধকার বন্ধ দরজা ভেঙে আলোর দুনিয়াতে পৌঁছে দিতে চায়...।
রমজানের রোজা শেষে খুশির ঈদ আসছে। বিত্তবানদের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাবে। পাল্লা দিয়ে তারা কিনবে দামি দামি শাড়ি গয়না, রাঁধবে ফিরনি, পোলাও, কোর্মা, রোস্ট। যার যা মনে ধরে। দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবেন বিত্তবানদের। কিন্তু কেউ কি ভাবেন আরেক শ্রেণির কথা যারা আমাদের মতোই মানুষ। শুধু পার্থক্য তারা গরিব, আমাদের মতো ধন সম্পদ দেননি বিধাতা। এটা কি তাদের অপরাধ। তবে আমরা কেন এ খুশির দিনে ওদের ভুলে যাই ও দূরে রাখি। ইসলামে জাকাত প্রথার বিধান আছে যাতে ধন সম্পদ সুসম বণ্টন ও বিলি ব্যবস্থা হয়? সবাই কি আড়াই পারসেন্ট হারে জাকাত দিই? না দিলে গরিবদের ব্যথা আমরা লাঘব করব কীভাবে? আমি আমার এক ধনী ভাবিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা ন্যায্য বিধান মোতাবেক জাকাত দেন কিনা। উত্তরে তিনি বললেন লামসাম দেন! ইসলামে লামসাম বলতে কোনো বিধান নেই।

লেখক
লেখক

আজ আমেরিকায় ঈদ উদযাপিত হয়েছে। আমি সারা জীবন ঈদে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করি না। মা-বাবার মনের ব্যথা নিয়ে পরপারে চলে যাওয়া, নিজের পুরোনো স্মৃতি আমার হৃদয়ে অভিমানের সুর বাজে। এ ভেবে যে আমার ভালো সময়ের আনন্দ তাদের সঙ্গে বণ্টন করার সুযোগ এল না। এই হয়তো জীবন, আমরা মানুষ বাস্তব সহজে মেনে নিতে আমাদের কষ্ট হয়! আমার সমবয়সী গ্রামের বন্ধু যার সঙ্গে জীবনের অনেকগুলো বছর কেটেছে, কয়েক দিন আগে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ওকে আর কোনো দিন দেখব না ভাবলে বুকটা ভারী হয়ে আসে। ওর মতো অন্য সবার প্রতি আমার অন্তর নৈবেদ্য, রব্বির হাম হুম্মা কামা রব্বা ইয়ানি ছগিরা...!

*লেখক সাহিত্যিক, রিয়েলটর