ঈদ আসে ঈদ যায় স্মৃতি শুধু রয়ে যায়

আনন্দ উচ্ছ্বাস আর খুশির বার্তা নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও ফিরে এল ঈদ। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম তথা রোজাব্রত পালনের পর খুশির বার্তা নিয়ে ফিরে এল পবিত্র ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে খুশি; আনন্দধারা। সেই শিশুকাল থেকে ঈদের আনন্দ দেখে আসছি; উপভোগ করছি। ঈদের উচ্ছ্বাস ঘুচিয়ে দেয় অন্ধকার। আলোকিত হয়ে ওঠে মানুষের হৃদয় ও মন। দুঃখ-কষ্ট বেদনার নিগড় থেকে মুক্ত শুদ্ধ অন্তরে নেমে আসে শান্তি। মানুষের মধ্যকার দুঃখ-কষ্ট আর গ্লানিবোধ ঝেড়ে ফেলে সমাজবদ্ধ মানুষ মেতে ওঠে আনন্দ উৎসবে। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠাই ঈদুল ফিতরের শিক্ষা। একাকী আনন্দ উপভোগ করার মধ্যে তৃপ্তি নেই। পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-সজন, পরিবার ও আপনজন মিলে আনন্দ করার মজাই আলাদা। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চিরায়ত গানের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়—
“ও মন রমজানেরই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ
তুই আপনারে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।” কী চিরন্তন আহ্বান! মনের আকাশ খুলে দিয়ে মানুষকে মানুষের মধ্যে মিশে যাওয়ার শাশ্বত আহ্বান এ। খুশি মানে তো সবই সুন্দর, মধুর আলোকমালার আনন্দে ভরপুর।
আগেকার দিনে ঈদ আসার এক সপ্তাহ আগে থেকেই গ্রাম-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় আনন্দ উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হতো। সবাই হাটে-বাজার থেকে, কেউ কেউ শহর থেকে ঈদের বাজার করে নিয়ে আসত। সেই শিশুকালে নতুন জুতো, জামা-পায়জামা পরে বাবার হাত ধরে প্রথম ঈদের মাঠে যাওয়া শুরু। ঈদগাহের জনারণ্যে দাঁড়িয়ে রং-বেরঙের সজ্জা ও মানুষ দেখতাম চোখ ঘুরিয়ে। ইনিয়ে-বিনিয়ে বাবার কাছে কত প্রশ্ন করতাম! নামাজ শেষে ঈদের কোলাকুলি দেখতাম অবাক হয়ে। পাড়ায়-মহল্লায় ঘরে ঘরে মানুষের আসা -যাওয়ার ধুম পড়ে যেত। মেয়েরা নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে এ বাড়ি ও বাড়ি যেত। কোলাহলমুখর হয়ে উঠত আমাদের বাড়ির পরিবেশ। আপনজনের ভিড় আর বাবার সঙ্গে আসা গণ্যমান্য মানুষের আপ্যায়নে যোগ হতো ফিরনি, পায়েস, সেমাইসহ নানা রকম খাবার। খাবার পরিবেশনের তত্ত্বাবধানে থাকতেন মা। কারবারি কালুর বাপ মহা আনন্দে অতিথি আপ্যায়নে মত্ত থাকতেন। আর মাঝে মধ্যে ব্রেক নিয়ে তার অতিপ্রিয় তামাক সাজানো নৈচাবিশিষ্ট হুক্কায় টান দিতেন গড়গড় করে। এমনই উৎসবমুখর ছিল শৈশব-কৈশোরের ঈদ।
কী যে খুশির বন্যা বয়ে যেত সবার মাঝে! ঈদের সকালে নামাজ শেষে সবাই যখন বাড়ির দিকে যেত। সকালের কচি রোদের মোহময়তায় বাড়ির সামনের স্কুলঘর ও মাঠে বড়দের খেলাধুলার রঙ্গালয় জমে উঠত। ঈদের জ্যোৎস্না রাতে কাছারির সামনে কিংবা স্কুলমাঠে জারিগান ও পালাগানের আসর বসত। কত যে আনন্দমুখর ছিল সেই সব দিন! তারুণ্যের উৎসব আমেজ উন্মাদনা ছড়াতো দেহ-মনে। মনে হতো কারও কোনো দুঃখ নেই। সবাই আনন্দের অবগাহনে ডুবে আছে। কবিগুরুর ভাষায় যেমন—
‘এই মোর সাধ যেন এ জীবনমাঝে
তব আনন্দ মহা সংগীতে বাজে।
তোমার আকাশ, উদার আলোকধারা
দ্বার ছোট দেখে ফেরে না যেন গো তারা।’
যখন বড় হতে থাকলাম জীবনের তাগিদেই বাড়িছাড়া হতে হলো। মায়ের মমতাঝরা আঁচল আর কৈশোরের বন্ধুজন ছেড়ে প্রথমে গজারিয়া বাজারের স্কুল জীবন, অতঃপর ঢাকা শহরে তারুণ্যময় কলেজজীবন এবং যৌবনের বৈচিত্র্যময় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শুরু হলো অন্যরকম ঈদ। ঈদ মানে খুশি। ঈদ মানে আনন্দ।
শহীদুল্লাহ হল থেকে হাতে গোনা বন্ধুদের সঙ্গে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ আর বায়তুল মোকাররমের ঈদের বিশাল জনারণ্যের তরঙ্গ পার হয়ে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় যাওয়া হতো। বিশেষত মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, সদরঘাট ও বাংলাবাজারের দিকে যাওয়া হতো বেশি। প্রথমদিকে বন্ধুজনের সঙ্গে লালবাগ, মিরপুর চিড়িয়াখানা কিংবা বোটানিক্যাল গার্ডেন আবার কখনো রমনার বটমূলে ঘোরাঘুরি। আর টিএসসি চত্বরের কথা না বললেও চলে; এ চত্বর তো হাতের মুঠোয়। মাঝেমধ্যে কারও কারও দলছুটো প্রেম নীরব অন্তরে কড়া নাড়ত। মনের সুধায় অন্য কোথাও মিশে যাওয়ার তাগিদ থাকত কারও কারও মধ্যে।
কখনো মুন, স্টার, বলাকা, মধুমিতা ও অভিসারের ছবি দেখা, আবার কখনো পিলখানা ও গ্যারিসনে হিন্দি ও উর্দু সিনেমায় ডুবে যাওয়ার ঘটনা ঘটত হরহামেশাই। ভার্সিটি হলে ঈদের দিনে ডাল-ভাতের চেয়েও একটু বাড়তি স্বাদের খাবার পরিবেশিত হতো। কোনো কোনো হলে ফিরনি, সেমাইয়ের ব্যবস্থাও থাকত। উদ্দেশ্য সবার মাঝে আনন্দ ও পরম তৃপ্তির ছোঁয়া লাগানো। আর রাতে হলে ফিরে ঈদের নাটক কিংবা আনন্দমেলা দেখাও বাদ যেত না।
এভাবেই তারুণ্যময় ছাত্রজীবনের সময়গুলো যেন তীরবেগে ছুটছে। ছুটতে ছুটতে ওই তারুণ্য ঢাকা ছেড়ে মিশে যায় বহির্বিশ্বের বৈচিত্র্যময় ছাত্র জীবনে। কোথায় তার গন্তব্য? অথচ আমার মা চেয়ে থাকেন পথপানে। খোকন কখন বাড়ি আসবে। সব সন্তানই হাতের নাগালে। শুধু নেই মায়ের সেই খোকন সোনা। যে নাড়িঝরা সন্তানটি মায়ের আদর ও মমতার পরশে অন্যদের চেয়ে ছিল ব্যতিক্রম ও আলাদা। সে তো এখন আর মায়ের আগলের মধ্যে নেই। দূরে অনেক দূরে। প্রথমে ঢাকা থেকে ঈদের বন্ধে বাড়ি যাওয়া হতো। দিন যত গড়িয়ে যেতে থাকল। দেশ, সমাজ ও সময়ের ঘূর্ণনে আগের মতো ঘরে ফেরার সময়ও ফুরিয়ে গেল!
এক সময় বাইরের উচ্চশিক্ষা নামের মধু-পর্ব শেষ করে ঢাকায় থিতু হওয়ার পর গ্রামের বাড়ি থেকে মা আসলেও বেশি দিন থাকতে পারতেন না। হয়তো ইস্পাত কঠিন শহরের বদ্ধ জীবন ভালো লাগত না। বাড়ির ওই সব খোলামেলা কোলাহল মাকে টানত। বাবাও ছিলেন অনেকটা এ-রকমই। সেই চিরচেনা সমাজ ছেড়ে তিনিও ঢাকায় খুব একটা থাকতেন না। মাঝে মাঝে অবাক বিস্ময়ে আমার মায়ের স্বর্ণাভ মুখাবয়ব যেন দেখা যায়। স্বপ্নের অবুঝ রাজ্যে কখনো ওঁদের আলোকছটা ভেসে আসে যেন। আবার মুহূর্তেই লীন হয়ে যায় সেই ছটা অনন্তে। ধরা যায় না। এক ভীষণ অতৃপ্তির স্বাদ পাওয়া ছাড়া আর কিছুই দেয় না এ বিভ্রম। আমি অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াই তাঁদের প্রিয়মুখ। প্রশ্ন করি কবিগুরুর ভাষায়—
‘মা গো কী হল তোমার, অবাক নয়নে
চাহিস কিসের তরে।’
মায়ের মতো চিরন্তন মমতার কথা কী কোনো কিছুর সঙ্গে তুলনা চলে? কোথায় লুকিয়ে গেলেন আমার মা, আমার বাবা। চোখের আলোয় ছলছল হয়ে ভেসে ওঠে শিশুকাল ও কৈশোরের মধুময় স্মৃতি। অতীতের সেই সব দিনের কথা জীবন নদীর বাঁকে বাঁকে জড়িয়ে থাকে স্মৃতির দোলায়। এখনো সেই আবাল্য স্মৃতি বিষণ্ন বেদনায়, বিধুর ব্যঞ্জনায় বিগলিত হয়ে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মনকে কাঁদায়।
ঈদ আসে ঈদ যায়। সময়ের ঘূর্ণিপাকে প্রকৃতি ও পৃথিবীর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তামাম দুনিয়ার রাষ্ট্রপুঞ্জের উৎকট উগ্রতায় মানব নিধনের উন্মাদনা। আরব বিশ্বের শোষক শ্রেণি, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের ধ্বংসলীলা, নিজের দেশে বধ্যভূমিতে শোকবিহ্বল ফিলিস্তিনিদের আর্তনাদ, রোহিঙ্গার অসহায় মানুষের করুণ আহাজারি। সবকিছুর মাঝেই ঈদ আসে, ঈদ যায়। উচ্ছল আনন্দে কাউকে হাসায়, কাউকে কাঁদায়।
আর যারা দূর প্রবাসে তাদের মাঝেও আনন্দ আসে, কখনো অঝোরধারায়। আর অদৃষ্টের ভাগ্যহারা বেদনার ঘানি টেনে যারা ব্যাকুল উদাসে ঘুরে বেড়ায়, দের মাঝেও ফিরে আসে স্বস্তি। এভাবে চরাচরজুড়ে ফিরে আসুক শান্তি সর্বত্র।
ঈদের আনন্দ সবার মাঝে তৃপ্তি, সুখ ও মধুরতর আলো ছড়াক। অনুপম সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠুক সবার জীবন। নেমে আসুক আনন্দধারা।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক