ইয়াসমিন ও ইস্তাম্বুলের ব্যর্থ প্রেম
ইরাসমাস একচেঞ্জ স্টাডি প্রোগ্রামের আওতায় ২০১৯ সালে একবার তুরস্কে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তুরস্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত ইস্তাম্বুল থেকে প্রায় ২০৪ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে ছোট এক শহরের নাম কুতাহইয়া। এ শহরে অবস্থিত ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটি থেকে একচেঞ্জ স্টুডেন্ট হিসেবে আমি পুরো একটি সেমিস্টার সম্পন্ন করি।
ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ইয়াসমিনের সঙ্গে পরিচয়। আমার জীবনে ইয়াসমিন ‘দ্য লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প’ হিসেবে পরিচিত ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের মতো বিশেষ এক নাম। জেসমিন ফুলের মতো সে আমার জীবনে সুবাস ছড়িয়েছিল, তবে সে সুবাসকে আমি দীর্ঘস্থায়ীভাবে ধরে রাখতে পারিনি। তুর্কি ভাষায় জেসমিনকে ইয়াসমিন বলা হয়।
ইয়াসমিনের পৈতৃক নিবাস ইস্তাম্বুলে, তবে উচ্চশিক্ষার সুবাদে সে কুতাহইয়াতে থাকত। ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটি থেকে সে স্নাতক সম্পন্ন করেছে। ইউনিভার্সিটির ইরাসমাস স্টুডেন্ট কর্তৃপক্ষ ইয়াসমিনকে আমার জন্য মেন্টর হিসেবে নিয়োগ করে।
তুরস্কের সিংহভাগ জনগণ সে অর্থে ইংরেজিতে পারদর্শী নয়, এ কারণে তুর্কি ভাষা জানা না থাকলে বাইরে চলাফেরা করার সময় বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। পুরো এক সেমিস্টার ইয়াসমিন একজন ভলান্টিয়ার হিসেবে আমার দেখাশোনা করেছে। কোনো কোর্সে যদি কোনো সমস্যা হতো কিংবা ইমিগ্রেশন–সংক্রান্ত কোনো ঝামেলা হলে ইয়াসমিন সেগুলো নিষ্পত্তির জন্য আমার পক্ষ থেকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করত। এভাবে একসঙ্গে পথচলা শুরু, যদিও সে পথচলা খুব বেশি দিনের জন্য স্থায়ী হয়নি। পূর্ব গগণে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে শিশির কণা শূন্যে মিলিয়ে যায়, ঠিক একইভাবে ইয়াসমিনও আমার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসার অনুভূতিকে শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিশ্ব ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা বিশ্ব ফুটবলের নেদারল্যান্ডসের মতো চোকার শব্দটিও আমার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য।
প্রথম দর্শনে ইয়াসমিনকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিন আমাদের একসঙ্গে লোকাল ইমিগ্রেশন অফিসে যাওয়ার কথা ছিল, তুরস্কের টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিটের জন্য আবেদন করতে লোকাল ইমিগ্রেশন অফিসের যাওয়াটা আমার জন্য অত্যাবশ্যকীয় হয়ে উঠেছিল। ইয়াসমিন আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট দিয়ে রেখেছিল। দুপুরে জুমার নামাজের পর সে আমার জন্য মসজিদের বাইরে অপেক্ষা করছিল। দেখামাত্র সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। সে এক অনাবিল প্রশান্তি।
রূপ–লাবণ্যের দিক থেকে বলতে গেলে বলিউডের কোনো প্রতিথযশা নায়িকার চেয়ে ইয়াসমিন কোনো অংশে কম নয়। লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি অর্থাৎ, আমার প্রায় সমান, গায়ের রং উজ্জ্বল ফর্সা। নাকটা একটু লম্বা আর চুলগুলো একেবারে উজ্জ্বল কালো। এক কথায় বলতে গেলে, তুর্কি রমণীদের সৌন্দর্যের পুরোটা বিধাতা ইয়াসমিনের ওপর ঢেলে দিয়েছেন।
পোশাকে-আশাকে ইয়াসমিন সব সময় সাধারণ, এদিক থেকে কোনো ধরনের বিলাসিতার ছাপ তার মাঝে আমি লক্ষ করিনি। সব সময় তার পরনে থাকত হাফহাতা গেঞ্জি ও অনাড়ম্বর জিন্সের প্যান্ট, তবে বৃষ্টির দিনে কিংবা ঠান্ডার দিনে গেঞ্জির ওপর হালকা ওজনের জ্যাকেট কিংবা কোট পরত। ইয়াসমিন সব সময় খোলা চুলে থাকতে পছন্দ করত। অতি সাধারণ পোশাকে একজন মানুষও যে অসাধারণ রূপে নিজেকে মেলে ধরতে পারে, সেটা কোনো দিনও বুঝতাম না যদি না, ইয়াসমিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ না আসত। একেবারে সিম্পলের মধ্যে সুপার গর্জিয়াস বলতে যা বোঝায়, সবই তার মধ্যে উপস্থিত ছিল। বয়সের দিক থেকে অবশ্য ইয়াসমিন ছিল আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র। তাতে কী? প্রেম কিংবা ভালোবাসা তো আর বয়স, জাত, কুল কোনো কিছুর ধার ধারে না।
ইয়াসমিনের পরিবার অত্যন্ত ধর্মভীরু, ইয়াসমিন নিজেও রোজা রাখা থেকে শুরু করে ধর্মীয় বিভিন্ন অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করে। তারপরও তার মধ্যে একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি, বিষয়টি যে কেবল ইয়াসমিনের মধ্যে রয়েছে, তা নয়। তুরস্ক কিংবা আলবেনিয়া মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হলেও, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তারা অত্যন্ত লিবারেল। আমাদের উপমহাদেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মতো তাদের মধ্যে সেভাবে গোঁড়ামি লক্ষ করা যায় না। তুরস্কসহ বলকান দেশগুলোর ইসলামিক সংস্কৃতিতে সুফিবাদের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
ইয়াসমিনের সঙ্গে লোকাল ইমিগ্রেশন অফিসে গেলাম, কুতাহইয়া শহর থেকে অনেকটা বাইরে এ অফিসের অবস্থান। আগের থেকে ইয়াসমিন আমার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে রেখেছিল, আমার হয়ে সে দেখলাম ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গে কথা বলছে। ইমিগ্রেশন অফিসারের নির্দেশমতো ইয়াসমিনের মাধ্যমে যাবতীয় প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট জমা করলাম। অফিসার আমার হাতে এরপর একটা স্লিপ দিলেন। এ স্লিপ ব্যবহার করে যেকোনো সময় তুরস্কের বাইরে অন্য যেকোনো দেশে যাতায়াত করা যায়, তবে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট পারমিট ইস্যু হওয়ার আগে কেউ যদি অন্য কোনো দেশ ভ্রমণ করতে চান তা হলে আগের থেকে লোকাল ইমিগ্রেশন অফিসকে এ বিষয়ে অবহিত করতে হয়, যাতে তুরস্কে ফিরে করার সময় পরবর্তী সময় কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়।
ইমিগ্রেশন অফিসার এরপর আমাকে আমাকে তিন মাস অপেক্ষা করার জন্য পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, ‘রাজধানী আঙ্কারা থেকে রেসিডেন্ট পারমিট প্রিন্ট হয়ে আমার বাসার ঠিকানায় ডাকযোগে পৌঁছাতে তিন মাস সময় লাগবে।’
ইমিগ্রেশন অফিসে যাবতীয় ফরম্যালিটি শেষ করে আমরা সেখান থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম। বৃষ্টিস্নাত দিন। কুতাহইয়ার মারকাজে পৌঁছানোর জন্য বাস কিংবা ট্যাক্সি কোনোটির দেখা পেলাম না। খানিকটা দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। ইয়াসমিন কিছুটা পথ হাঁটার জন্য পরামর্শ দিল। আমি কিছু না বলে স্রেফ তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। কিছু দূর পথ একসঙ্গে পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়ার পর এক আফগানের দেখা পেলাম। আমাদের দেখে তিনি তাঁর তিন চাকার পিকআপ ভ্যান থামালেন। ততক্ষণে পরনের জামা-কাপড় একদম ভিজে গেছে। এরপর তুর্কি ভাষায় কিছু একটা বলতে শুরু করলেন।
ইয়াসমিন তার কথা শোনামাত্র ইয়েই বলে উল্লাসে লাফ দিয়ে উঠল। বুঝলাম তিনি আমাদেরকে তার পিকআপ ভ্যানের পেছনে ওঠার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেন। কুতাহইয়ার মূল শহরে প্রবেশ করতে সেরা কুতাহইয়া নামক এক অত্যাধুনিক শপিং মলের অবস্থান চোখে ধরা দেয়। তিনি আমাদেরকে সে শপিং মলের সামনে নামিয়ে দেন। আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং তাঁর থেকে বিদায় নিয়ে মারকাজের পথে পা বাড়ানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি। তবে মারকাজ পৌঁছানোর জন্য তৎক্ষণাৎ বাসের দেখা পাওয়ায় বাকি পথ পায়ে হাঁটতে হয়নি। ইয়াসমিন আমাকে ডরমিটরি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। বিদায়লগ্নে এবার আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
এরপর ধীরে ধীরে ইয়াসমিনের সান্নিধ্যে আসা। বিদেশের মাটিতে পা রাখার পর সব সময় আমি ফ্ল্যাট বাসার পরিবর্তে স্টুডেন্ট হোস্টেলে থাকার চেষ্টা করেছি। তুরস্কেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। খরচ সাশ্রয়ের কথা চিন্তা করে এমনটি করেছি তা বলা যাবে না, স্টুডেন্ট লাইফে হোস্টেলে থাকার মজা আলাদা। কুতাহইয়ার সিটি সেন্টার থেকে সামান্য কয়েক গজ হাঁটার দূরত্বে ছিল আমার হোস্টেলের অবস্থান। ইয়াসমিন থাকত ইউনিভার্সিটির ডরমিটরিতে। কুতাহইয়ার সিটি সেন্টার থেকে ডুমলুপিনার ইউনিভার্সিটির দূরত্ব প্রায় সাড়ে ১১ মাইলের কাছাকাছি। জরুরি প্রয়োজনে ইয়াসমিন প্রায় সিটি সেন্টারে আসত। সিটি সেন্টারে আসার আগে সব সময় সে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট দিয়ে রাখত, আমিও চেষ্টা করতাম তার সঙ্গে দেখা করার। আমাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাকে জড়িয়ে ধরত।
কুতাহইয়াতে ওল্ড স্কুল নামক একটি বিখ্যাত কফি শপ ছিল। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় আমরা সেখানে একসঙ্গে কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত করার চেষ্টা করতাম। আমাকে সে নিজ উদ্যোগে তুর্কি ভাষা শেখাত। মাঝেমধ্যে পরীক্ষাও নিত, ইয়াসমিনের আন্তরিকতা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টার কারণে কিছুটা তুর্কি ভাষা শিখেও ফেলেছিলাম। দিন যত গড়াতে থাকে ধীরে ধীরে তার প্রতি আমার আকর্ষণও বাড়তে থাকে। মেন্টর হিসেবে সে ছিল এক শতে এক শ পাওয়ার মতো।
IMG_8532:-ছবিটি গ্র্যাজুয়েশন শেষে ইয়াসমিনের সম্মানে আয়োজিত সারপ্রাইজ পার্টির দিন তোলা। ছবি: সংগৃহীত
জরুরি প্রয়োজনে একবার হাসপাতালে যেতে হয়, আমি অনেকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। প্রবাস জীবন মানে এক নির্মম বাস্তবতা, একাকী এ জীবনে বিপদের দিনগুলোতে পাশে থাকার মানুষ খুঁজে বের করা অনেক সৌভাগ্যের একটি বিষয়। ইয়াসমিনকে বিষয়টি জানানোর পর সঙ্গে সঙ্গে সে মারকাজে এসে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে সে আমাকে বারবার অভয় দিচ্ছিল। তুরস্কের হেলথ কেয়ার সিস্টেম ইউরোপের অনেক দেশ থেকে উন্নত। হাসপাতালের ভেতরে প্রবেশ করার পর রিসিপশন থেকে আমার কাছে হেলথ ইনস্যুরেন্সের কপি চাওয়া হলো। ফাইল থেকে হেলথ ইনস্যুরেন্সের কপি বের করলাম। ইয়াসমিন সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে হেলথ ইনস্যুরেন্সের কপি নিয়ে রিসিপশনে জমা দিল এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে আমার জন্য চিকিৎসকের অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করল। তাঁর চেম্বারে প্রবেশ করার পর ইয়াসমিন চিকিৎসককে বিস্তারিত তুলে ধরল। চিকিৎসক আমার ব্লাড প্রেসার মাপলেন। ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য শারীরিক জটিলতা আছে কি না, সে বিষয়েও জানতে চাইলেন। এরপর আমাকে কয়েকটি ওষুধ কেনার পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, আমার সমস্যা সে অর্থে গুরুতর নয়। চিকিৎসককে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
নিজের থেকে কোনো কিছু করার আগে দেখলাম হাসপাতালের পাশে থাকা এক ফার্মাসির দোকান থেকে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে ওষুধ কিনে আনল ইয়াসমিন। সব মিলিয়ে ওষুধের বিল এসেছিল ছয় লিরা, ইয়াসমিন নিজের থেকে সে বিল পরিশোধ করল।
টানা তিন রাত ভালোমতো ঘুমাতে পারিনি, তাই ঘুমের ওষুধ কিনতে চেয়েছিলাম। ইয়াসমিনকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রেসক্রিপশন ছাড়া কি ফার্মেসি থেকে ঘুমের ওষুধ নেওয়া যাবে? আমার কথা শোনামাত্র ইয়াসমিন আমার হাত ধরে টানতে টানতে মারকাজের দিকে নিয়ে গেল। আমাকে সে বলল, মানুষের জীবনে হতাশা থাকতে পারে, কিন্তু এভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কোনো মানে হতে পারে না। তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে ঘুমের ওষুধ আমার সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন, কিন্তু সে আমার কোনো কথা শুনল না। সেদিনের এ ঘটনার পর ইয়াসমিনের প্রতি আমার ভালোবাসা আরও একধাপ বেড়ে গেল।
মায়ের মুখে একটা কথা বারবার শুনেছি। তিনি সব সময় বলতেন, ‘জীবনসঙ্গিনী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সব সময় দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, খুব সহজে যেন তার ওপর নির্ভর করা যায় এবং দ্বিতীয়ত, আমরা যাতে একে অন্যের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারি।’ ইয়াসমিনের মধ্যে দুটি জিনিসই ছিল। পুরো এক সেমিস্টার সে আমাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছে এবং সব সময় সে আমার প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে।
ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার ভ্রমণের স্মৃতিও রয়েছে। ইরাসমাস স্টুডেন্ট নেটওয়ার্ক কর্তৃক আয়োজিত এক ট্যুরের সুবাদে তুরস্কের অন্যতম জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট কাপাডোকিয়া ভ্রমণের সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। ইয়াসমিন সে ট্যুরেও আমাকে সঙ্গ দিয়েছে, আমার কাছ থেকে ক্যামেরা নিয়ে সে বিভিন্ন ছবি তুলত। ছবি তোলার ক্ষেত্রে ইয়াসমিন অত্যন্ত পারদর্শী। তার ফটোগ্রাফি স্কিল সত্যি নিখুঁত।
২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ছিল তার ২৩তম জন্মদিন। ফেসবুকের কল্যাণে আগেই এ বিষয়ে জানতে পারি। সারপ্রাইজ দিতে গিফট কিনে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, গিফটের বাক্স হাতে উঠতে ইয়াসমিনের মুখমণ্ডল হাসিতে ভরে উঠল। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমাকে সে জড়িয়ে ধরল এবং গতানুগতিক আবারও আমার দুই গালে আগের দিনগুলোর মতো চুমু আঁকল। এমনকি সে বছর যখন সে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তাকে চমক দিতে এক পেস্ট্রি শপে সারপ্রাইজ পার্টির ব্যবস্থা করি। তবে এ পার্টি কতটুকু সফল হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ ছিল, কেননা তার পরের দিন ছিল রমজান মাসের প্রথম দিন। ইয়াসমিন নিয়মিত রোজা পালন করে। তারপরও সবকিছু সফলভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। এক বন্ধুর মাধ্যমে আগে থেকে পেস্ট্রি শপের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে রাখি, কেক ও অন্যান্য ডেকোরেশনের খরচ বাবদ তাকে কিছু লিরা অ্যাডভান্স করে যাই। বাজার থেকে ফুলের তোড়া ও গিফট কিনে তার হাতে দিই। আমার ওই বন্ধুর মাধ্যমে তাকে অনুরোধ করি কিছু একটা করার জন্য, যাতে কিছুক্ষণ পর যখন আমি ইয়াসমিনকে নিয়ে তাঁর পেস্ট্রি শপে আসব তখন যাতে তাকে চমকে দেওয়া যায়। পরিকল্পনামতো সব ঠিকঠাক এগোচ্ছিল। ইয়াসমিনকে নিয়ে পেস্ট্রি শপের ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে সে ভেতরের ডেকোরেশন দেখে চমকে যায়। পেস্ট্রি শপের ভেতরে একসঙ্গে বসে কিছুক্ষণ গল্প করি, সামনে আরও কি হতে চলেছে সে বিষয়ে ইয়াসমিনের ন্যূনতম ধারণা ছিল না। কয়েক মিনিট পর আমাদের দুজনকে হতবাক করে পেস্ট্রি শপের ম্যানেজার অর্ডার করা কেক, ফুলের তোড়া ও গিফট নিয়ে হাজির হলো। দোকানে কাজ করা কয়েকজন স্টাফসহ তিনি ইয়াসমিনকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। ইয়াসমিনকে দেখামাত্র তিনি বললেন, তার গ্র্যাজুয়েশন সাফল্যে আমার পক্ষ থেকে এ আয়োজন। গিফটের সঙ্গে একটা টেডি বিয়ারও তাকে উপহার দিয়েছিলাম, টেডি বিয়ারটা দেখে সে ভীষণ খুশি হলো। বারবার সে টেডি বিয়ারের সঙ্গে সে ছবি তুলতে চাইল, আমিও তাকে কয়েকটি ছবি তুলে দিলাম।
আগের থেকে একটা ডায়েরি কিনে বুরসা প্রবাসী এক বড় ভাইয়ের সহায়তায় তুর্কি ভাষায় আমার মনের ভাব সেখানে লিখে রাখি। সরাসরি ইয়াসমিনকে আই লাভ ইউ বলার সাহস পাচ্ছিলাম না, তাই আমাকে লেখনীর সহায়তা নিতে হলো। সে দিন সবকিছু ভালোভাবে সম্পন্ন হলো। আমার মায়ের সঙ্গেও সে কথা বলতে চাইল, আমি মেসেঞ্জারের মাধ্যমে ভিডিও কলে আমার মায়ের সঙ্গে ইয়াসমিনকে সংযুক্ত করে দিলাম। তাকে দেখে আমার মাও ভীষণ খুশি।
এরপর কয়েক দিন ইয়াসমিনের সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি, রোজা ও অ্যাসাইনমেন্টের চাপে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে নিজেকে কয়েক দিনের জন্য দূরে রেখেছিলাম। মাঝখানে একটা কোর্স নিয়ে ঝামেলায় পড়ছিলাম, তখন ইয়াসমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং ইয়াসমিন সংশ্লিষ্ট প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলে আমার ঝামেলা সমাধান করার জন্য চেষ্টা করে।
মোটাদাগে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইয়াসমিনের মতো একজনকে পাশে পেয়েছিলাম বলে তুরস্কের অভিজ্ঞতাকে সাত রঙে সাজানো সম্ভব হয়েছে। ইয়াসমিনকে জীবনসঙ্গীনি হিসেবে পাওয়ার জন্য তাই চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখিনি। কিন্তু বাংলা ভাষায় একটা প্রবচন আছে না, কপালের নাম গোপাল। আমার ভাগ্য সব সময় আমার সঙ্গে প্রবঞ্চনা করে। তাই প্রতিবার যা আশা করি, শেষ মুহূর্তে তীরে এসে তরি ডুবে যাওয়ার মতো নিদারুণ বেদনা সইতে হয়। পূর্ব গগনে উষার আলো ফুটতে না ফুটতে যেভাবে শিশিরবিন্দু ভোরের আলোয় মিলিয়ে যায়, ঠিক তেমনি ইয়াসমিনও মিলিয়ে গেছে জীবন থেকে।
ইয়াসমিন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, তুলনামূলকভাবে তার পরিবারকে আমার কাছে রক্ষণশীল মনে হয়েছে, যদিও আমার এ ধারণা যে পুরোপুরি সত্যি হবে, তেমনটিও নয়। তিন ভাই ও এক বোনের পরিবারে সে একমাত্র ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে। তার বড় দুই ভাই টেকনিক্যাল ফিল্ডে কাজ করে আর ছোট ভাই কেবল হাই স্কুলে পা রেখেছে।
ইয়াসমিনের সঙ্গে এখনো হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ হয়, বর্তমানে সে ইস্তাম্বুল থেকে ৩৪ মাইল দূরের শহর গেবজেতে কাজ করছে। তুরস্কের অর্থনীতি এ মুহূর্তে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউএস ডলার কিংবা ইউরোর বিপরীতে তুর্কি লিরার দরপতন তার মতো অনেক সাধারণ মানুষকে হতাশার মুখে ঠেলে দিয়েছে। লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয়ও তুরস্কে আগের থেকে বেড়ে গেছে, সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব সমস্যা। এ ছাড়া সাধারণ তুর্কি নাগরিকদের অনেকে মনে করেন সিরিয়া, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে তুরস্কে পাড়ি জমানো শরণার্থীদের কারণে দেশটির অর্থনীতি একেবারে ভেঙে পড়েছে। সমবয়সী অন্যান্য তরুণ-তরুণীর মতো ইয়াসমিনও এখন উন্নত জীবনের আশায় তুরস্ক ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড কিংবা পশ্চিম ইউরোপের কোনো দেশে চলে যেতে চাচ্ছে।
পারস্যের সম্রাট নাদির শাহ ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন এবং তৎকালীন সময়ের মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহকে পরাজিত করেন। ভুবন বিখ্যাত কোহিনূর হীরকখণ্ড ও শাহজাহানের তৈরি ময়ূরসিংহাসনসহ সে সময় প্রায় ৭০ কোটি টাকার মণিমানিক্য ও মূল্যবান সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে তিনি ইরানে ফিরে যান। কথিত আছে, নাদির শাহ ভারতবর্ষ জয় করতে পারলেও ভারতবর্ষের এক নারীর হৃদয়ের কাছে তাঁকে পরাজিত হতে হয়েছিল। তাই দিল্লি থেকে পারস্যের পথে পা বাড়ানোর সময় তিনি আফসোস করে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ থেকে সবকিছু নিয়ে যেতে পারলেও এ নারীর হৃদয়কে আমি হরণ করতে পারিনি, যা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।’
ঠিক তেমনি তুরস্ক থেকে আমি সব পেয়েছি, সেবারের সেমিস্টার শেষে আমার সব সাবজেক্টে পূর্ণাঙ্গ গ্রেড এসেছিল। ফ্যাকাল্টির সবাই আমার পারফরম্যান্সের ওপর সন্তুষ্ট ছিলেন। তুরস্কের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় যেকোনো মানুষের চিত্ত হরণ করতে বাধ্য। তুর্কিরাও জাতি হিসেবে অত্যন্ত বন্ধুবাৎসল ও অতিথিপরায়ণ। আরও একটা জিনিস, যেটি আমি তুরস্কে বারবার লক্ষ করেছি সেটি হচ্ছে, কালচারাল ডাইভার্সিটি। অটোমানদের হেঁশেলকে এ পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী হেঁশেলগুলোর তালিকায় একেবারে প্রথম দিকে রাখা হয়। সব মিলিয়ে তুরস্ক আমার মনে এক অপার্থিব অনুভূতির সৃষ্টি করেছে এবং এ দেশটিতে তাই আমি বারবার ফিরে যেতে চাই। তবে ইয়াসমিনকে না পাওয়ার আফসোস আমার সব প্রাপ্তির খাতাকে শূন্য করে দিয়েছে। নাদির শাহর মতো আমিও এ এক জায়গায় এসে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত কিছু কারণে ইয়াসমিন আমার সঙ্গে রিলেশনশিপে জড়াতে চায়নি, আমারও দায় আছে এখানে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি পরিপক্বতা ও স্মার্টনেসের পরিচয় দিতে পারিনি, ফলে ইয়াসমিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে গড়ায়নি।
ইয়াসমিনকে কাছে না পাওয়ার বেদনা আজও আমার মনে প্রবলভাবে দাগ কাটে। গত দুই বছরেও আমার সঙ্গে অনেক নারীর পরিচয় হয়েছে, তবে ইয়াসমিনের মতো কেউ–ই আমাকে সেভাবে আলোড়িত করতে পারেনি। তাই আজও তাকে কাছে পাওয়ার স্বপ্ন দেখি। চিত্রকরদের কাছে নীল রং যেভাবে আরাধ্য কোনো এক স্বপ্নের প্রতীক, ঠিক তেমনি ইয়াসমিনও আমার কাছে এক স্বপ্নের মতো, যাকে সত্যিকার অর্থে আমি ভালোবাসতে চাই।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি বিশ্বকে এক অনিশ্চয়তার দোলাচলে ঠেলে দিয়েছে। কোন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় কিংবা নয় কোনো ধরনের সামরিক যুদ্ধ। সামান্য কয়েক ন্যানোমিটারের অতি ক্ষুদ্র এক আলোক অণুবীক্ষণিক বস্তু আমাদের সবার জীবনকে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আটকে দিয়েছে। এমনকি আমাদের স্বাভাবিকভাবে চলাচলের সুযোগও আজ অনেকটা বিপন্ন। তবে যেদিন পৃথিবী এ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাবে, প্রথমে আমি ছুটে যাব তুরস্কের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে খ্যাত ইস্তাম্বুলে। ইয়াসমিনকে বুকে জড়িয়ে তার কপালে আর দুই গালে চুমু এঁকে এবং তার চোখে চোখ রেখে আবারও তাকে বলার চেষ্টা করব, সত্যি সত্যি আমি তাকে ভালোবাসি। ভাগ্যের শিঁকেকে বিদীর্ণ করে সাফল্যের পথে পদাঙ্কণ করতে পারব কি না, সেটি হয়তো–বা অনাগত সেদিনে জানা যাবে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া!