ইরানি নববর্ষে বাংলাদেশি খাবারের পসরা
ইরানের নওরোজ বা নববর্ষ উৎসবকে কেন্দ্র করে তেহরানের তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ থেকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নওরোজ উৎসব। এই উৎসবে বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় হরেকরকম খাবারের পসরা মেলে ধরা হয়। প্রথম বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরও বাংলাদেশ এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে। তারবিয়্যাত মোদাররেস বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ইরানের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে আন্তর্জাতিক নওরোজ বা নববর্ষ উৎসব পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সর্বশেষ বছর অতিবাহিত হচ্ছে, ফলে এ উৎসবে সম্ভবত এটাই বাংলাদেশের সর্বশেষ অংশগ্রহণ।
ইরানের নওরোজ বা নববর্ষ উৎসবকে কেন্দ্র বসন্তের প্রথম দিন (২১ মার্চ) থেকেই আনন্দ উৎফুল্লে মেতে ওঠে ইরান, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তানসহ আশপাশের অনেকগুলো দেশ। ইরানি নববর্ষের উৎসবে হাফত সিন (ফারসি প্রথম অক্ষর س দিয়ে তৈরি ৭টি অপরিহার্য উপাদান) টেবিল অন্যতম প্রধান উপাদান। অফিস, আদালত, শপিংমল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, প্রতিটি গৃহে দেখা যাবে হাফত সিন টেবিল। বর্তমান হাফত সিনের মূল উপাদ্য হচ্ছে সিব (আপেল: সুস্থতা ও সৌন্দর্যের প্রতীক), সেরকে (সিরকা যাবতীয় অশুভ জাদু দূরীকরণ, পরিবেশ পরিচ্ছন্নতার প্রতীক), সামানু (অঙ্কুরিত গম, বালি বা অন্যান্য শস্যদানা আর আটা দিয়ে তৈরি মিষ্টান্ন বা হালুয়া বিশেষ: উপকারী লতাগুল্মের বৃদ্ধি ও ফুলফলে সুশোভিত হওয়ার প্রতীক), সোমাক (মধ্যম আকারের গাছ বিশেষ। যার ফল দেখতে মসুরের ডালের মতো, তবে সামান্য বড় ও টক: অন্তরে প্রেম-ভালোবাসা, দয়া-মায়া বৃদ্ধির প্রতীক), সির (রসুন: শরীরের যাবতীয় রোগবালাই থেকে মুক্তি, কুদৃষ্টি থেকে রক্ষা ও প্রকৃতির রক্ষণাবেক্ষণের প্রতীক), সেঞ্জেদ (দেখতে বরইয়ের মতো ফল: পৃথিবীর প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার প্রতীক), সাবযেহ (সবজি: বরকত ও প্রাচুর্যের প্রতীক)। এ ছাড়া আরও বেশ কিছু উপাদান দেখা যায়। যেমন সেক্কে (ধাতব কয়েন: ধনসম্পদের প্রতীক), আয়না (মহান আল্লাহর সীমাহীন পৃথিবীর প্রতীক), রংবেরঙের তোখমে মোরগ (মুরগির ডিম: পৃথিবীর হরেক রকম জাতি সভ্যতা ও সকলের অভিন্ন জায়গা থেকে এই দুনিয়ায় পদার্পণের প্রতীক), মহি (মাছ: হালাল রুজির প্রতীক), গান্দুম (গমের শিষ: বরকতপূর্ণ নেয়ামতের প্রতীক), নন (রুটি: বরকতময় রুটি রুজির প্রতীক) ও সঙ্গে একটি পবিত্র কোরআন (হাফত সিনের মূল থিম, ইমান, আল্লাহর ওপরে সব সময় ভরসা, নতুন বছর আরও ভালোভাবে অতিবাহিত করার কামনা-বাসনার প্রতীক)।
উল্লেখ্য, ইসলামপূর্ব সময়ে হাফত সিনের বদলে হাফত শিন (ش) প্রচলিত ছিল। যেমন শাম (মোমবাতি বা প্রদীপ), শারাব (মদ), শিরিনি (মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য), শাহ্দ (মধু), শামশাদ (বৃক্ষ বিশেষ, ইড়ি-উৎসব), শারবাত (শরবত) ও শাকায়েক (আফিম গাছের মতো দেখতে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির লাল রঙের টিউলিপ জাতীয় ফুল গাছ বিশেষ (Corn-poopy) অথবা শাখে নাবাত (ইক্ষু) ইত্যাদি।
গতবারের মতো এবারের নওরোজ উৎসবেও বাংলাদেশি খাবারের প্রচুর বিদেশি ভোজন রসিক পাওয়া গেল। বিশেষত ইরানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মহোদয়ের পাঠানো শিঙারা ও পেঁয়াজির স্বাদ ছিল অসাধারণ! এই দুটি খাবারের দারুণ কিছু ভোজন রসিকও জুটে গিয়েছে। এ ছাড়া সৈয়দা তোফাতুর রেজা ভাবি (হ্যালো তেহরান পরিবারের কাছে অবশ্য মুসা ভাবি হিসেবেই পরিচিত) ও বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর মো. সবুর হোসেনের সহধর্মিণী লাভলি ভাবির তৈরি খাবারের প্রশংসা করেছেন সবাই। আর ইরানে উচ্চশিক্ষারত গাজীপুরের ছেলে ইমরান যথারীতি তার দুধ চা নিয়ে হাজির হয়েছিল এবার। রাত জেগে দুধ ঘন করার প্রক্রিয়াটাও ছিল দারুণ। ঘন মালাইকে আলাদা করে তার মধ্যে দারুচিনি ও এলাচির গুঁড়ো মিশিয়ে অদ্ভুত এক স্বাদের দুধ চা তৈরি করেছে ইমরান।
বাংলাদেশের ভুনা খিচুড়ির স্বাদের লেবানন ও সিরিয়ান খাবার ‘কাবছে’ও দারুণ মজাদার ছিল। আফগানিস্তানের হাফত মিভে বা সাত রকমের ফল দিয়ে বানানো খাবারটিও ছিল দারুণ স্বাদের। হাফত মিভের তৈরির প্রক্রিয়াটাও দারুণ। দুই-তিন দিন আগে থেকে বাংলাদেশের কাজির ভাতের মতো ফলগুলো একটি পাত্রে পানির মধ্যে ভিজিয়ে রেখে পরে সেগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হয়।
লেবাননের খাবার ফাত্তে হোম্মোস দাজাস, মোয়াজ্জানাত, শর্মা দাজাজ, কাফতে ও মেগলি খেতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল উৎসুক বিদেশি মেহমানেরা।
এ ছাড়া সিরিয়ান খাবার হোম্মোস, হালাভাতুল জেবেন, ফাত্তে ও তাপ্পুলে এবং সেনেগালি খাবার পোলো গোশত, নেম, ফাতায়া, বোরোশেতও দারুণ মজাদার ছিল।
লেখক সহকারী অধ্যাপক, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে পিএইচডি গবেষক, শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়, তেহরান, ইরান।