ইমুর হল-জীবন

জহুরুল হক হল। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি
জহুরুল হক হল। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি

জহুরুল হক হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ডাইনিং রুমে ভাত সামনে নিয়ে বসে আছে ইমু। ইচ্ছে হচ্ছে তরকারীর বাটিটা কারও মাথায় ঢালতে। কিন্তু ঠিক করতে পারছে না, কার মাথায় ঢালবে। অবশ্য কারও মাথায় ঢালার মতো সাহসও তার ওই মুহূর্তে নেই। কারণ সেদিনই ইমুর হল-জীবনের প্রথম দিন। আর প্রথম দিনে এত বড় রিস্ক নেওয়াটা ঠিক হবে না। এতে মার খাবার সম্ভাবনা শতকরা এক শ ভাগ।

ছোটবেলা থেকে ইমুর স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। অবশেষে তার সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গর্বিত ছাত্র। সেদিন সকালেই সে জহুরুল হক হলের ১৫১ নম্বর রুমে উঠেছে। যদিও সে এই হলের ছাত্র নয়। সে স্যার এ এফ রহমান হলের ছাত্র। এখনো নিজ হলে সিট পায়নি। তাই আপাতত এলাকার বড়ভাই ইসমাইল সাহেবের রুমে উঠেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে হলে থাকবে—এই সুখেই ইমু আচ্ছন্ন ছিল। কিন্তু হলে উঠেই বিছানার সাইজ দেখে খেল প্রথম ধাক্কা। ইমুর মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে চিকন চৌকি মনে হয় হলগুলোতেই থাকে। এই বিছানায় দুজন মানুষ বড় জোর কাত হয়ে শুতে পারবে। কিন্তু চিৎ হয়ে? প্রশ্নই আসে না। ইমু মনে মনে ঠিক করল, সে ফ্লোরিং করবে।

—ইসমাইল ভাই, আমি কি রাতে নিচে বিছানা করে শুতে পারি? ইমু সংকোচে প্রশ্ন করল।
—নিচে ঘুমাবি কেন? তুই আমার সঙ্গে বিছানায় ঘুমাবি।
—এই ছোট্ট বিছানায়? না ভাই। আমার ঘুম আসবে না। আর আসলেও আমি নির্ঘাত পড়ে যাব।
—শুন প্রথম প্রথম এমনই মনে হয়। পরে দেখবি এই বিছানাকেই তোর মনে হবে রাজপালঙ্ক।
—ভাই মাফ চাই। আমি নিচে ঘুমাব। আপনার রাজপালঙ্কে আপনিই ঘুমান। চৌকিতে শুয়ে, চৌকির রাজা হওয়ার কোনো ইচ্ছাই আমার নাই।
—ঠিক আছে, তোর যেখানে ভালো লাগে তুই থাকিস। চল দুপুরের খাবার সময় হয়েছে। আগে খেয়ে আসি।
—চলেন।

ইমু ভেতরে ভেতরে খুবই উত্তেজিত। কারণ হলের বিখ্যাত ডাল খাওয়ার স্বপ্ন তার বহুদিনের। আজ সে স্বপ্ন তার পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ভাত, এক বাটি ডাল, এক বাটি গরুর মাংস এই হচ্ছে খাবারের মেন্যু। কিন্তু খাবার সামনে আসতেই খেল দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় ধাক্কা। হলের পানির মতো ডালের কথা সে আগেই শুনেছে, কিন্তু সেই ডাল যে এতটা স্বচ্ছ হতে পারে তা ধারণা করেনি। মাংসের বাটির দিকে তাকিয়ে ইমুর প্রচণ্ড কান্না পেল। অসহায়ের মতো বোকা বোকা চোখে সে মাংসের বাটির দিকে তাকিয়ে রইল।

—নে খাওয়া শুরু কর। ইসমাইল সাহেব নিজের প্লেটে তরকারি ঢালতে ঢালতে বললেন।
—ভাই কি দিয়া কি খাব, বুঝতাছি না।
—কেন, তুই গরু খাস না?
—খাই মানে! গরুর মাংসই আমার প্রিয় খাবার। কিন্তু এখানে মাংস কই। সবই তো পানি।
—চিন্তা করিস না। বিসমিল্লাহ বলে পানির মধ্যে হাত ঢোকা। মাংস পেয়ে যাবি।
ইমু কম্পিত হাতে লাল রঙের পানির মধ্যে থেকে চার বাই চার বর্গ সেন্টিমিটারের এক টুকরা মাংস এবং সমসাইজের এক টুকরা আলু বের করে আনল।
—ভাই, মাত্র এই এক টুকরা? কেমনে খাব? এই এক টুকরা তো প্রথম লোকমাতেই শেষ। বাকি ভাত খাব কীভাবে।
—শুন হল কর্তৃপক্ষ জানে গরুর মাংস শরীরের জন্য ভালো না। তাই কম পরিমাণে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আর তা ছাড়া ধর্মেও আছে কম খাওয়া উত্তম।
—ভাই, আপনি আমার সঙ্গে মজা লইতাছেন, না?
—হ্যাঁ, নিচ্ছি। এখন খা। হলে থাকতে হলে কষ্ট করতে হবে। কিছুই করার নেই।

ইমু ছোটবেলা থেকেই খাবারের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে। শাক-সবজি একেবারেই খেতে চায় না। আর মাছ খায় না কাটার ভয়ে। তার সব ভালোবাসা মাংসের প্রতি। মুরগি নাকি গরু সেটা মুখ্য নয়। মাংস হলেই হলো। এই বেশি বেশি মাংস না খাওয়ার ব্যাপারে অনেকেই ইমুকে বুঝিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। ইমুর মামাও একবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। সেটা এক মজার কাহিনি।
ইমুর মামা নুরুল হক সাহেব খুবই গম্ভীর প্রকৃতির একজন মানুষ। গ্রামের সবাই তাঁকে খুবই মান্য করে এবং ভয় পায়। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস কারও নেই। একবার নুরুল হক সাহেব বাসায় বেড়াতে এসে রাতে সবার সঙ্গে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছেন। ইমুকে শুধুমাত্র মাংস দিয়ে খেতে দেখে নুরুল হক সাহেব বলে উঠলেন—একটু শাক-সবজি খাওয়ার চেষ্টা করো। সব সময় শুধু মাংস খাবে কেন? এটা শরীরের জন্য ভালো না। দেখো আমরা সবাই শাক-সবজি খাচ্ছি।
—মামা আমিতো ভালোই আছি। আমার কোনো সমস্যা নেই। আর তা ছাড়া...এতটুকু বলেই থেমে যায় ইমু, ভয়ে বলতে পারে না।
—থামলে কেন, বল।
—থাক মামা, আমার ব্যাখ্যা শুনলে আপনি রাগ করবেন।
—না বলো। রাগ করব না।

সবাই আতঙ্ক নিয়ে ইমুর দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ সবাই জানে ইমু উল্টো-পাল্টা কথা বলায় ওস্তাদ। ইমু দেখল মা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে ইশারা করছেন কিছু না বলতে। ইমু তার বাবার দিকে তাকাল। দেখল তাঁর মুখে প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি। ইমু জানে বাবা এই লোকটাকে খুব একটা পছন্দ করেন না।

—চুপ করে আছ কেন? কি বলবে বলো। তোমার ব্যাখ্যা শুনি। নুরুল হক সাহেব গম্ভীর ভরাট গলায় কথাগুলি বললেন।
—মামা আসলে আমি হচ্ছি বাঘ-সিংহ গোত্রের মানুষ। এই গোত্রের মানুষেরা সাধারণত মাংসাশী হয়। এরা মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করে। এটুকু বলেই থেমে যায় ইমু।
—আর যারা শাক-সবজি খায়, তারা কি? হক সাহেব আরও গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলেন।
—থাক মামা।
—থাকবে কেন? বলো, তারা কোন গোত্রের?
—মামা আমার ধারণা এরা ছাগল গোত্রের মানুষ। অবশ্য গরু গোত্রেরও হতে পারে। এরা গরু-ছাগলের মতো ঘাস লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।

কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি
কলা ভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইন্টারনেট থেকে নেওয়া ছবি

ইমু কথাগুলি বলে, সবার দিকে তাকাল। সবাই মাথা নিচু করে আছে। হক সাহেব বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে দশ সেকেন্ড ইমুর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনে হচ্ছে ওনার চোখ দুটো যেকোনো সময় বের হয়ে আসবে।

—আস্ত একটা বেয়াদব। বলে খাবার শেষ না করেই উঠে পড়লেন হক সাহেব। ইমু বাবার দিকে তাকাল। বাবা মুচকি হেসে ইমুকে একটা চোখ টিপ মারলেন। হক সাহেব সে রাতেই গ্রামে চলে গেলেন। অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে আটকানো যায়নি। সারা রাত ইমুর মা তাঁর ভাইয়ের জন্য কেঁদেছেন। হক সাহেব এরপর এ বাসায় আর কখনোই আসেননি।

—বসে থাকিস না। বিসমিল্লাহ বলে শুরু কর। বলেই ইসমাইল সাহেব খাওয়া শুরু করলেন।
ইমুও খাওয়া শুরু করল। দু-তিন লোকমা খাওয়ার পর হঠাৎ ইমু খেয়াল করল, ইসমাইল সাহেব হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন।
—ভাই তাকায় আছেন কেন? কোনো সমস্যা?
—তুই এটা কি করতেছিস?
—কি করলাম ভাই।
—তুই মাংসের টুকরা চাটছিস কেন?
—ভাই কি করব, আমি মাংস ছাড়া ভাত খেতে পারি না। এই টুকরা তো একবারেই শেষ হয়ে যাবে। তাই এ পদ্ধতি বের করলাম। ভাই পদ্ধতিটা শোনেন। আপনার পছন্দ হবে। এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে মাংসের টুকরায় একটা চাটা দেব। এতে মাংসের স্বাদ মুখ লেগে থাকবে। মনে হবে মাংস দিয়েই খাচ্ছি। এভাবে প্রতি লোকমা ভাত মুখে দেব আর মাংসে একটা চাটা দেব। অনেকটা কুকুরের মতো। ঠিক শেষ লোকমায় মাংসের টুকরাটা ভাতের ভেতরে দিয়ে খেয়ে ফেলব। মনে হবে সব লোকমা মাংস দিয়ে খেয়েছি। কি ভাই বুদ্ধিটা কেমন? ভালো না? চাইলে আপনিও এই পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারেন। খুবই উপযুক্ত পদ্ধতি। এরই মধ্যে আমি এই পদ্ধতির একটা নামও বের করে ফেলেছি। কুত্তা পদ্ধতি।

ইসমাইল সাহেব এতক্ষণ হা করে ইমুর কথা শুনছিলেন। বিস্ময়ে ওনার দুচোখ বড় হয়ে গেছে। উনি কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি দীর্ঘদিন থেকে হলে থাকেন। মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র। অনেকেই তাঁকে চেনে ও সম্মান করেন। এমনিতেই এই কুত্তা পদ্ধতির খাওয়া দেখে, তিনি প্রচণ্ড বিব্রত বোধ করছেন। তার ওপর এই ছেলে এখন তাঁকেও কুত্তা পদ্ধতিতে খেতে বলছে। মনে মনে বলেন, এর তো দেখি মাথা পুরাই খারাপ। এর চিকিৎসা দরকার।

—ইমু তুই তোর কুত্তা পদ্ধতিতে খেতে থাক। আমি তোর সঙ্গে বসে খাব না। আমি ওই কোণার টেবিলে গেলাম। তোর খাওয়া শেষ হলে তুই আসিস।
বলেই ইসমাইল সাহেব ওনার প্লেট আর বাটি নিয়ে উঠে গেলেন। ইমু আবার তার নতুন উদ্ভাবিত কুত্তা পদ্ধতিতে খাওয়া শুরু করল। পদ্ধতিটা ওর মনে ধরেছে। নিজের প্রতিভায় সে খুবই মুগ্ধ। ভাবছে এই কৌশলেই হলের জীবনটা শেষ করবে। আর আস্তে আস্তে সবাইকে এই পদ্ধতিতে খাওয়ার সিস্টেমটা শিখিয়ে দেবে। ইমু চোখ বন্ধ করল। কল্পনা করল, ডাইনিং হল ভর্তি ছেলে-মেয়ে। সবাই কুত্তা পদ্ধতিতে ভাত খাচ্ছে। অসাধারণ সেই দৃশ্য।
কোণার টেবিলে বসে ইসমাইল সাহেব খাওয়া শুরু করলেন। আড় চোখে তাকিয়ে দেখলেন, ইমু একমনে খুব মজা করে কুত্তা পদ্ধতিতে খেয়ে চলছে। হঠাৎ করেই ইসমাইল সাহেব উপলব্ধি করলেন তিনি নিজেও জানি কখন কুত্তা পদ্ধতিতে খাওয়া শুরু করে দিয়েছেন। এত দেখি মহা-সমস্যা। ইসমাইল সাহেব মনে মনে ঠিক করলেন, ইমুকে তাড়াতাড়ি ওর নিজের হলে ওঠার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। কারণ এই ছেলের সঙ্গে বেশি দিন থাকলে তিনি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন।

বি. দ্রষ্টব্য: হল-জীবন। পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সময়। ইস, যদি সে জীবনে আবার যাওয়া যেত। আমার প্রাণ প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, খুব মিস করি।

লেখক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়কপ্রবাসী।