ইন্টারনেট সমাচার: সমাজজীবনে এর যত প্রভাব
ইন্টারনেটের ইতিহাস খুব বেশি একটা পুরোনো নয়। আজ থেকে ঠিক ২৯ বছর আগে, ১৯৯১ সাল থেকে জনসাধারণের জন্য এর ব্যবহার উন্মুক্ত হয়। একবিংশ শতাব্দীতে এসে ইন্টারনেট এখন অনেকেরই হাতের মুঠোয়। দ্রুতগতির ইন্টারনেটের সহায়তায় চলছে মনুষ্যজাতির ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন জনপ্রিয় ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের একটা থেকে আরেকটায় সমানতালে বিচরণ। মানুষের এখন সবকিছু ইনস্ট্যান্ট চাই। ইনস্ট্যান্ট খাবার, ইনস্ট্যান্ট সার্ভিস, ইনস্ট্যান্ট গ্লো, ইনস্ট্যান্ট বিনোদনসহ আরও কত কী!
১০ বছর আগেও ইন্টারনেট যতটা না দ্রুত ছিল, বর্তমানে আরও বেশি দ্রুতগতির। কখনো কি খেয়াল করে দেখেছি যে মাঝেমধ্যে যেকোনো ওয়েবসাইটে প্রবেশের ক্ষেত্রে খানিকটা অতিরিক্ত সময় নিলে অগ্নিশর্মা হয়ে যাই?
হ্যাঁ, ঠিক এ বিষয়টি অধিকাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে অধিক লক্ষণীয়। অথচ অনেকেরই হয়তো অজানা কোনো এক ঘোরের মধ্যে থেকে ঠাউরে ওঠা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
আসলে, ইনস্ট্যান্ট নামক পোকা আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর আস্তানা গেড়ে বসে আছে। বর্তমানে অনেকেরই বই পড়ার প্রতি ঝোঁক কম। কারণ, তারা বিশ্বাস করে যে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে অতিসহজেই ইনস্ট্যান্ট সবকিছুর উত্তর পাওয়া সম্ভব। মূলত, বিষয়টি ঠিক অতটাও সহজ নয়, যা আপনি কিংবা আমি ভাবছি। যেকোনো তথ্যের ইতিহাস সম্পর্কিত টুকটাক জ্ঞান না থাকলে, অতি সহজেই ভুল তথ্যের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন আপনি। তা ছাড়া মস্তিষ্কের ঠিকঠাক ব্যবহার না হলে একসময় সেটি অসাড় হয়ে পড়ার উপক্রম হবে। তখন হয়তো আপনার-আমার ভেতরকার সৃজনশীলতা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাবে না আর। আজকালকার দিনে এমনকি অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত নিউজগুলো ছোট করতে হচ্ছে। কারণ, ইনস্ট্যান্টের ঘোরে থাকা মানুষগুলোর ধৈর্য শক্তি নিতান্তই কম।
লোকে বলবে ইন্টারনেট পুরো পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টে কথাটি যথার্থ মনে হলেও, চলুন দেখে নিই প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি ঠিক কতটা যৌক্তিক।
আমার নিজেরই ছোটখাটো একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে পা ফেলার পরে একাকিত্ব ওভাবে ঘিরে ধরেনি, যতটা না হওয়ার কথা ছিল। পরিবার থেকে এতটা দূরে থেকেও মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে কাটছিল দিনকাল। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ছুটিতে দেশে গিয়ে কাটানোর আগ্রহ তেমনটা ছিল না। কারণ, হাতের নাগালেই রয়েছে ইন্টারনেট সংবলিত নতুন প্রযুক্তি। সপ্তাহে একদিন ভিডিও কিংবা অডিও কলিংর মাধ্যমে ইন্টারনেটে পরিবারের সঙ্গে কথা বলা কিংবা মাঝেমধ্যে নিজের ছবি তুলে পাঠিয়ে দিয়ে দায়িত্ব শেষ। ইন্টারনেট না থাকলে হয়তো বুঝতে পারতাম, প্রত্যক্ষভাবে আমাদের জীবন কতটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। মানুষ মনে করে আমি তো ভালো আছি, সুখে আছি। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো এর সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রযুক্তি মানুষের মধ্যে মানসিক পরিবর্তন এনে দিচ্ছে। নষ্ট করে দিচ্ছে আত্মিক সম্পর্কগুলো। মানুষ এখন আর কেউ কাউকে স্বচক্ষে দেখা কিংবা সামনা-সামনি যোগাযোগ করাটা অতীব প্রয়োজনীয় বলে মনে করে না।
আমরা ভাবি ইন্টারনেট এসেছে বিধায় আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার হচ্ছে হয়তো। কিন্তু আছে কি সেই পুরোনো ধাঁচের পুনর্মিলনী? পিতা-মাতার কাছ থেকে শুনেছি, তাঁরা ঈদ, কোরবানিসহ প্রতিটি উৎসবে রীতিমতো পালা করে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতেন। সে রীতি আজ আর বেঁচে নেই, নেই সেই সুখ। ভার্চ্যুয়াল জগৎটি আজ বাস্তব জগতের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে। মোবাইলে দু–চারটে ঈদ মোবারক বার্তা সেরে সবকিছু হাসিল হয় না। আমার সন্দেহ আছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থেকে আমরা আদৌ সামাজিক প্রাণী হিসেবে আছি কি না।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গজিয়ে উঠেছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগণিত গ্রুপ। যেগুলোয় বিভিন্ন সস্তা বিষয় নিয়ে চলে দিনভর আলোচনা। এক গ্রুপ থেকে আরেক গ্রুপে ঝাঁপাতে গিয়ে অনেকেই পিতা–মাতার সঙ্গে টুকটাক কথাবার্তা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। ফেসবুকে আসক্তির বিষয়টি একপ্রকার মাদকের মতো কাজ করে। এ ক্ষেত্রে আবার ঘিয়ে আগুন ঢালছে সিম কোম্পানিগুলো। ‘বন্ধু ছাড়া লাইফ ইম্পসিবল’ স্লোগানে কোম্পানিগুলো ফেসবুকের গীত গেয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে টেলিভিশনের পর্দায়। ফলস্বরূপ, কোনোমতে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পার হতে না হতেই শিক্ষার্থীরা খুলে ফেলে নিজস্ব ফেসবুক আইডি। বেশ কিছু পরিবারে খোদ পিতা–মাতাই এ কাজে সহায়তা করে থাকে।
এদিকে অনলাইন গেমগুলো বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে যুবক-যুবতীদের মাঝে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, আজকালকার দিনে এমনকি পরিণত বয়সী লোকজন ‘পাবজি’ নামক অনলাইন গেমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে দিনভর।
এযাবৎ চীনের বিদেশি শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণ করে যা দেখেছি, তা একপ্রকার অপ্রত্যাশিত ছিল। চীনে এসে প্রথম দুই–চার মাস শিক্ষার্থীদের চীনের জনপ্রিয় বেশ কিছু ‘ডেটিং অ্যাপ্লিকেশন’ ব্যবহার করে হন্যে হয়ে চীনা রমণী খোঁজা; তা ছাড়া সুযোগ পেলেই রমণীদের উইচ্যাট (চীনের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ্লিকেশন) আইডি নেওয়ার প্রতি বেশ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। ঘুরেফিরে মুখ্য উদ্দেশ্য থাকে একটাই, অবাধ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের বন্দোবস্ত করা। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বিবাহবহির্ভূত অবাধ যৌনাচার যে কতটা জঘন্য এবং এর ফলাফল কতটা ভয়াবহ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ধর্মের আলোচনা নাহয় বাদই দিলাম। কারণ, আজকালকার দিনে শুধু গুটি কয়েক মানুষ ধর্মকে বিশ্বাস করে তা যথাযথভাবে পালন করার চেষ্টা করে। অধিকাংশের কাছে ধর্মীয় রীতিনীতি অনেকটা বিষফোড়ার মতো। কিন্তু আশ্চর্য মনে হলেও সত্যি, এদের মধ্যে অনেকেরই জীবনের কোনো না কোনো একপর্যায়ে এসে ধর্মের কাছে নতজানু হতে হয়।
যাহোক, আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক মারাত্মক রোগব্যাধি সৃষ্টির পেছনে সরাসরি দায়ী, পাশাপাশি এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিস্তর প্রভাব ফেলে। এমনকি, পরবর্তীকালে বৈবাহিক জীবনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করে এই কু-অভ্যাসটি। খেয়াল করে দেখুন, বিবাহবহির্ভূত অবাধ যৌন সম্পর্কগুলো তৈরির পেছনেও পরোক্ষভাবে কলকাঠি নাড়ছে এই ইন্টারনেট।
ইন্টারনেটের এ দুনিয়ায় সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কি সত্যি, কি মিথ্যা, তা ধরার সহজ কোনো উপায় নেই। রঙিন পর্দায় প্রচারিত বিষয়গুলো বাস্তবতা ভেবে থাকলে ভুল করছেন আপনি। টেলিভিশন কিংবা ইন্টারনেটে প্রচারিত চাকচিক্য সিনেমার পেছনের দৃশ্য দেখতে চেষ্টা করুন, সিনেমা দেখায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। সিনেমার এত অ্যাকশন আপনাকে ক্রেজি করে তুলছে, যার অধিকাংশই ভিএফএক্সের কারসাজি। বাস্তবতা দেখতে নিজের চারপাশের মানুষগুলোর দিকে তাকান। ইন্টারনেট, সিনেমায় মুখ থুবড়ে থেকে বাস্তবতা শেখা যায় না।
আজ ইন্টারনেট বা টেলিভিশনে কোনো ব্যক্তিকে দেখে তাঁর অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলেন আপনি; পাগলের মতো অনুকরণ করছেন তাঁর সবকিছু। পছন্দের আইডলকে অনুকরণ করতে গিয়ে অন্য রকম এক স্বাধীনচেতা ভাব চলে এল আপনার মধ্যে। কিন্তু ভুল পথে হাঁটছেন না তো? কখনো সেই ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবনের চিত্র সম্পর্কে ঘেঁটে দেখেছেন কি? সচরাচর দেখা যায়, রঙিন দুনিয়ার আপনার-আমার অধিকাংশ আইডল উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত। সুতরাং, আইডল নির্বাচনে আমাদের আরও বেশি সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
ইন্টারনেটের আইডলের প্রতি অন্ধ অনুকরণ বাদ দিয়ে সৃজনশীল চিন্তায় মনোনিবেশ করা উচিত। এতে কোনো একসময় দেখা যাবে যে আপনার-আমার মধ্যকার স্রষ্টা প্রদত্ত সৃজনশীলতা ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পেতে চলছে। নিজেকে মননশীল ও সৃজনশীল রূপে তৈরি করার পাশাপাশি ভেতরকার সৃজনশীলতাকে জাগ্রত করতে সচেষ্ট হোন। দেখবেন, নিজের অজান্তেই অন্য কারও আইডল হয়ে উঠেছেন আপনি।
গোল্ডেন টাইমকে কাজে লাগান
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সে আমাদের মস্তিষ্ক প্রথমবারের মতো উদ্ভাবনের জন্য উর্বর স্থল হয়ে ওঠে। প্রত্যেকের জীবনে এ সময়টাকে একপ্রকার গোল্ডেন টাইম বলা চলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে এই সময়টাতে, তরুণদের ইন্টারনেটে পছন্দের আইডলকে অন্ধ অনুকরণ এবং স্বকীয়তা ভুলে গিয়ে ওই ব্যক্তিটির সবকিছু নিজের বাস্তবিক জীবনে প্রতিফলনের নিমিত্তে ব্যর্থ প্রচেষ্টারত থাকতে দেখা যায়।
প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারনেট তার মধ্যকার প্রায় প্রতিটি বিষয়কে মেকআপে সুসজ্জিত যেকোনো কিছুর মতো করে আমাদের সম্মুখে উপস্থাপন করে। আর আমরা সেসব বিষয়ের প্রতি মোহের সমুদ্রে ডুবে থাকতে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে আপনার-আমার সুপ্ত প্রতিভাকে অতিসুকৌশলে নষ্ট করার ক্ষমতাও রয়েছে খোদ এই ইন্টারনেটের হাতে।
ইন্টারনেটের যুগে মানুষ মনে করছে, ভালো থাকা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, ভালো আছি, সেটা দেখানো আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমি যতবারই দেশের কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়েছি, দেখেছি খাবার গলাধঃকরণের থেকে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে ছবি তোলার দিকে মনোযোগ বেশি মানুষের। এসব লোকজন কি রেস্তোরাঁয় আদৌ ভালো–মন্দ খেতে যায়; নাকি সোশ্যাল সাইটে পোস্ট করার জন্য ছবি সংগ্রহ করতে যাওয়াটাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য?
আসলে, সোশ্যাল নামক বেশ কিছু ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগমাধ্যমের কাছে আমরা নিতান্তই অসহায়। ভার্চ্যুয়াল সামাজিক কারাগারে বন্দী আপনার-আমার নিজস্ব সত্তা।
আমরা এখন আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য স্বচক্ষে অবলোকন করার সময় ও সুযোগ কোনোটাই পাই না। আপনি কোথাও ঘুরতে গেলে ইন্টারনেট চালু করে চলে যান লাইভে। আমি কী করে আসলাম, সেটা অন্যকে দেখাতে গিয়ে মিস করে ফেলেন স্রষ্টার সৃষ্টি অপরূপ সৌন্দর্য স্বচক্ষে দেখার মধ্যকার প্রশান্তি। কোথাও বেড়াতে গেলে দৃশ্যের ভিডিও ধারণ, লাইভে যাওয়া এবং ফটোসেশান—এ তিনটি জিনিসের জগাখিচুড়ি যেন বেড়ানোর স্বাদটাই মাটি করে দিচ্ছে।
কোনোমতেই যেন আমাদের পিছু ছাড়ছে না অকালমৃত্যু। ইদানীং ছবি তুলতে গিয়ে যানবাহনের নিচে পড়ে, পানিতে ডুবে, উঁচু স্থান থেকে পড়ে মৃত্যু যেন অতিসাধারণ বিষয়। আর সিংহভাগ মানুষেরই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ছবি তোলার পেছনে সাধারণ উদ্দেশ্য থাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা। ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে, দু–চারটে লাইক-কমেন্টের সস্তা মানসিক প্রশান্তির আশায় নিজেকে মৃত্যুমুখে ফেলে দিচ্ছে মানুষ। নিশ্চিত বিপদ জেনেও এসব করা ঢের বোকামি ছাড়া আর কীই–বা হতে পারে!
ট্রলিং চলে গেছে সোশ্যাল হ্যারাসমেন্টের পর্যায়ে। ইউটিউব, ফেসবুক তথা ইন্টারনেট ব্যবহার করে একশ্রেণির মানুষ বর্তমানে ট্রলিং কিংবা রোস্টিং নিয়ে সদা ব্যস্ত। সমালোচক যেখানে নেতিবাচক এবং ইতিবাচক উভয় দিকই আলোকপাত করেন, সে ক্ষেত্রে ট্রলের মূল বিষয়বস্তু থাকে কটূক্তি–সম্পর্কিত। এর বিনিয়মে ইন্টারনেট আবার পয়সাও দিচ্ছে। দেবেই না কেন? ইন্টারনেট তো ভালো-মন্দের হিসাব বোঝে কম।
অ্যালগরিদম বেশ সুকৌশলে আমাদের মস্তিষ্কের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে চলছে। অ্যালগরিদম আমাদের মস্তিষ্ককে ওই সব খাওয়ায়, যা আমাদের মস্তিষ্ক চাচ্ছে। কারণ, প্রত্যেক মানুষ মনে করে তিনিই সঠিক এবং সবজান্তা। আর ইন্টারনেট আমাদের পছন্দসই জিনিস সামনে এনে সান্ত্বনা দেয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপনি যেসব বিষয় দেখতে চাইবেন বা টুকটাক খোঁজাখুঁজি করবেন, ইন্টারনেট আপনার সামনে ঠিক ওই বিষয়গুলো এনে তুলে ধরবে। ব্যস! যার দরুন আপনি ইন্টারনেট ছেড়ে সহজে আর উঠতে পারছেন না। আর ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের পেছনে চলে যাচ্ছে দিনের অধিকাংশ সময়। অ্যালগরিদম কখনোই চাইবে না যে তার ওয়েবসাইটে আপনার বিচরণ কম হোক। দৃষ্টিনন্দন এবং পছন্দসই জিনিস সামনে আনাটাই এর মূল লক্ষ্য; হোক তা সত্য কিংবা মিথ্যা।
যখন আপনি গুগলে কিছু সার্চ করেন, গুগল আপনাকে সর্বাধিক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটটি সাজেস্ট করে। আর গুগল এটি করে ভিজিটরদের সংখ্যা, বাউন্স রেট, ভিজিটররা কত সময় ওই ওয়েবসাইটে কাটাচ্ছে এ রকম আরও বেশ কিছু উপায়ে। বলে রাখা ভালো, ওয়েবসাইটগুলো তাদের SEO (সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন) এক্সপার্টের পেছনে অতিরিক্ত পয়সা ঢালে, যাতে করে গুগলে কোনো কিছু সার্চ দিলেই ওই সব ওয়েবসাইটের কনটেন্টগুলো শুরুর দিকে আসে। তো বোঝা যাচ্ছে, গুগল আপনাকে সর্বাধিক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটটি সাজেস্ট করলেও, ওয়েবসাইটটিতে সর্বাধিক সত্য তথ্য থাকছে কি না, এ নিয়ে গুগলের কোনোরূপ মাথাব্যথা নেই। যার দরুন সহজেই ছড়িয়ে পড়ছে ‘গুজব’ নামক অতিপরিচিত শব্দটি।
এ সমস্যাটি প্রকট হচ্ছে বাংলাদেশে। কারণ, কোনো ব্যক্তি যখন তার ওয়েবসাইট বুস্ট করতে পয়সা ঢালবে, ইন্টারনেট তো তখন ওয়েবসাইটে থাকা তথ্যগুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে যাবে না। ফলে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ভুয়া তথ্য হরহামেশাই ঘুরছে। হয়তো আপনি-আমি ভুয়া শনাক্ত করতে পারলেও অধিকাংশ মানুষ সত্য ভেবে বিশ্বাস করে নিয়ে নিজের অজান্তেই গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বলাই বাহুল্য, দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ ইন্টারনেট দুনিয়ার যেকোনো জায়গায় কিছু দেখামাত্রই বিশ্বাস করে নেয়।
অধিকাংশ মানুষ এখন মস্তিষ্কের সদ্ব্যবহার করা বোঝে কম। বর্তমানে তারা সর্বাধিক জনপ্রিয় সাইটে সর্বাধিক নির্ভুল তথ্য খুঁজে বেড়ায়। অথচ জগতের শ্রেষ্ঠ এই মস্তিষ্কের মধ্যে স্রষ্টা ভালো-মন্দ বিচারের সক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। সুতরাং, আমাদের অসাড় মস্তিষ্ককে সঠিকভাবে চালনা করে বিচার-বিবেচনা করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলা জরুরি নয় কি?
যাহোক, লেখার ইতি টানতে হবে। লেখার শুরুর দিকে বলেছিলাম, একবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ মানুষ প্রতিটি বিষয়ের ইনস্ট্যান্ট সারমর্ম বুঝতে চান। বিষয়টি একদিক দিয়ে বেশ ভালো বলা যেতে পারে। এতে অতি অল্প সময়ে মানুষ তার মস্তিষ্কে অধিক তথ্য জমা রাখতে পারছে হয়তো।
ইন্টারনেট আমাদের ভালো-মন্দ অনেক কিছুই দিয়েছে; এখনো দিয়ে যাচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মতে ইন্টারনেটের খারাপ দিকগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে ভালোর দিকটাই বেশি। তবু আমাদের আরও অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। যাতে, সৃষ্টির এই সেরা জীবের মস্তিষ্ক কোনো এক ভার্চ্যুয়াল সিস্টেমের কাছে অসহায় হয়ে না পড়ে।
*লেখক: শিক্ষার্থী, মেকানিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল প্রকৌশল, চীন