ইতি, সান্না

এক. ‘আমাকে শেখাবে কী করে বাংলায় আমার নামটা লিখতে হয়!’ সান্না জানতে চাইল ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে।
বিছানায় গা এলিয়ে ইউএস ওপেন টেনিসের সেমিফাইনাল দেখছিলাম। বুড়ো আন্দ্রে আগাসির ফোরহ্যান্ড শটগুলো অসাধারণ। বেসলাইন ঘেঁষে মারা শটগুলো প্রতিপক্ষকে অসহায় করে দেয়।
আমি আগাসিকে শ্রদ্ধা আর ঈর্ষা—দুটিই করি। শ্রদ্ধা করি তাঁর লড়াকু মানসিকতার জন্য। সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে যাওয়া এক খেলোয়াড় আবার কী করে এই ২০০৫ সালে শীর্ষস্থানে ফিরে আসে, তা আসলেই এক বিস্ময়! জন ম্যাকেনরো বা ইভানিসেভিচের মতো তাঁর প্রকাশের ঔদ্ধত্য নেই; বরং আছে বিনয়াবনত অধ্যবসায়। সেই ছোটবেলায় আগাসি সম্পর্কে পড়েছিলাম, ‘বলবয় থেকে উইম্বলডন জয়’।
আর তাঁকে ঈর্ষা করি এক আপাতহাস্যকর কারণে। তিনি আমার স্বপ্নের রানি স্টেফি গ্রাফকে বিয়ে করেছেন বলে!
-‘হেই, কান্ট ইউ হিয়ার মি’? সান্নার খোঁচায় সংবিৎ ফিরে পেলাম।
-‘সরি। হ্যাঁ এবার বল।’
‘বলছি আমাকে দেখিয়ে দাও কী করে বাংলায় আমার নামটা লিখতে হয়। আমি শিখতে চাই। তোমাকে লেখা চিঠিতে সব সময় বাংলায় আমার নাম লিখব। তোমার ভালো লাগবে, তাই না?’
দুই. সান্না লেবানন থেকে এসেছে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের কী এক এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের আওতায় এক মাসের জন্য পাকিস্তানে থাকবে। লেবাননের মেয়েদের ভুবনমোহিনী রূপের প্রাচুর্য তাঁর আছে; যেটি তাঁর খামখেয়ালি স্বভাবের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
মেয়েটি আমার রুমে আসে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়ার জন্য। অথচ আমি সিগারেট খাই না। কী যে যন্ত্রণা! ওর রুমে ওর মা, তাই আমাকেই এই কড়া সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করতে হয়। দম বন্ধ করে দেখি বন্ধ এয়ারকন্ডিশন্ড রুমে এই তরুণীর আয়েশি ভঙ্গিতে ধূমপান। উপায়ান্তর না দেখে মাঝেমধ্যে জানালা খুলে দিই। কিন্তু এ যেন এক মহাপ্রলয় আহ্বান করা! মুহূর্তের মধ্যে আরব সাগরের বুক থেকে ধেয়ে আসা প্রবল বাতাসের এক তাণ্ডব বয়ে যায় আমার সাজানো-গোছানো হোটেল রুমের ভেতর। সাগরের উদ্দাম বাতাসে ভর করে আসে ধূলিকণার মিছিল। আমি অসহায় দৃষ্টিতে দেখি চোখের পলকে ধুলার প্রলেপ পড়ে যাচ্ছে সোফা, রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, বিছানা আর অন্য সব আসবাবের ওপর। তখন অদূরে আরব সাগরের সৈকত এবং আমার ঘরের মেঝেতে গুণগত কোনো পার্থক্য থাকে না। ধূলিকণা চিকচিক করে সর্বত্র।
সান্নার তাতে বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া বা ভাবান্তর নেই। সে নির্বিকার, ভাবলেশহীন। মুখের ওপর জড়ো হওয়া অবাধ্য চুলগুলো আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় সরিয়ে আবার ডুবে যায় সিগারেটের ধূম্রবেষ্টনীতে।
তিন. আমি লিখলাম, ‘সা-ন্‌-না’।
ওকে বললাম, ‘ইউ ট্রাই ফর আ হোয়াইল।’
সে মনোযোগী ছাত্রীর মতো বিছানায় ঝুঁকে পড়ে আমার লেখার ওপর বাঁ হাতে কলম ঘোরাতে লাগল। বারবার মুখের সামনে ঢলে পড়া রেশমি চুলগুলো ওর শার্টের ভেতর থেকে উঁকি মারা স্তনযুগলকে আড়ালের ব্যর্থ চেষ্টা করছিল।
আমি ওকে ঠিক বুঝতে পারি না।
নাকি সে আমাকে?
সে জেনে গেছে আমি একটি কাপুরুষ যে তাঁর সৌন্দর্য সহ্য করতে না পেরে একদিন হয়তো দম বন্ধ হয়ে মরেই যাব, তবু তাঁর দিকে কামনার হাত বাড়াব না। অথবা হয়তো সে তেমন কিছুই আদৌ ভাবছিল না। বন্ধ ঘরের বিছানায় অনভ্যস্ত বাঙালি তরুণের স্বর্গীয় সৌন্দর্য উপভোগের এ এক শাস্তি! এখানে কোনো ভোগের প্রাপ্তি নেই।
চার. অফিসের একটি প্রশিক্ষণে যোগ দিতে চার মাসের জন্য করাচিতে এসেছি। ইতিমধ্যে এক মাস কেটেছে। পাকিস্তান আমার কাছে মৃত্যু উপত্যকার মতো ভয়ের এক দেশ। এখানে অপঘাতে বা সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর সম্ভাবনা আমার মতো বিদেশিদের অহর্নিশি তাড়া করে ফেরে। বোমার আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকি রাত-দিন। শুধু অফিস-ট্রেনিং-হোটেল করে গত ৩০টি দিন কাটিয়েছি। টেলিভিশন ছাড়া বিনোদন বলতে জিম, সুইমিং পুল আর টেবিল টেনিস।
সান্নার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল লিফটে। একদিন সুইমিং পুল থেকে উঠে দেখি শাওয়ার রুমে রাখা আমার টি-শার্ট, ট্রাউজার গায়েব। আমারই আগের দিনের করা দুষ্টুমির প্রতিশোধ হিসেবে সহকর্মী বন্ধুরা কেউ নিশ্চয়ই লুকিয়ে রেখেছে যেকোনো একটা লকারে। এত লকারের মধ্যে কোনটায় খুঁজব! টাওয়েলে গা মুছে কিছুই হয়নি এমন ভাব করে আঁটসাঁট সুইমিং কস্টিউম পরেই হাঁটা দিলাম রুমের দিকে। একটু লজ্জা লাগছিল বটে! লিফট পর্যন্ত যেতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার আগ মুহূর্তে তা আবার খুলে গেল। মনে হলো স্বর্গের অপ্সরী আমার সামনে দাঁড়িয়ে। জিনস আর হালকা পিঙ্ক রঙের টি-শার্ট পরা এক তরুণী। পরিষ্কার বোঝা গেল সে পাকিস্তানি নয়। আধা ভেজা, প্রায় নগ্ন বনের রাজার পোশাক পরা এক তরুণের সঙ্গে একই লিফটে উঠবে কি উঠবে না বোধ করি খানিকক্ষণ চিন্তা করে কী মনে করে উঠেই পড়ল। হতে পারে আমার অসহায় করুণ চেহারা দেখে সে আশ্বস্ত হয়েছিল। সমস্যা ছিল, লিফটের সব দিকে আয়না। কোন গর্দভের মাথা থেকে যে এই আইডিয়া এসেছিল! আমার দিকে সরাসরি না তাকিয়েও সে আমাকে ঠিক দেখতে পাচ্ছিল।
আমি তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে একটু ঢোক গিলে বললাম, ‘হাই!’ উদ্দেশ্য, তাঁর মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানো।
সে জবাব দিল মৃদু হেসে। কিন্তু চোখে স্পষ্ট কৌতূহল। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি কারও ভয়ে এখানে এসে লুকিয়েছ?’ বলে কী মেয়েটা! আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘না না!’ শুধু যোগ করলাম, ‘আমি আসলে হোটেলে এভাবেই ঘুরে বেড়াতে বেশি পছন্দ করি।’ কী যে বললাম নিজেই বুঝলাম না।
সাধারণত সুইমিং পুল সাইডের এই লিফটে বাইরের কেউ, বিশেষ করে মেয়েরা আসে না। ভাবলাম হয়তো নতুন এসেছে তাই বুঝতে পারেনি। এই লিফটটি সাধারণত পুলের জন্য এবং এখন ছেলেদের সেশন।
সাহস করে তাকিয়ে দেখি চোখেমুখে রাজ্যের কৌতুক নিয়ে আমার দিকে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। লিফটও কেন জানি উঠছিল ধীরে ধীরে। এ দীর্ঘ-যাত্রা আর যেন ফুরাচ্ছে না!
আশ্চর্য! সে আমার একই ফ্লোরে উঠেছে। আমার এক রুম পরেই ওর রুম। যাওয়ার আগে একে অপরের নাম বললাম।
রুমে এসে মাথা আর শরীর মুছছিলাম, তখনই ফোন বেজে উঠল। রুম নম্বরেই প্রত্যেকের ফোন নম্বর। ওপাশ থেকে বলল, ‘দিস ইজ সান্না স্পিকিং। ডু ইউ হ্যাভ আ সিগারেট?’ আমার অবাক হওয়ার পালা শুরু। জানালাম, ‘দুঃখিত! আমি সিগারেট খাই না। তাই ওকে দেওয়ার মতো সিগারেট আমার কাছে নেই।’
বেশ বিরক্ত হলো বলে মনে হলো। বলল, ‘সিগারেট খাও না ভালো কথা। কিন্তু এভাবে প্রায় ন্যাংটা হয়ে হোটেলের লবিতে ঘুরে বেড়ানোটাও খুব ভালো দেখায় না।’ বলেই ফোন কেটে দিল। কীসের মধ্যে কী! তবু তেতো ওষুধের মতো ওর কথাগুলো গিললাম। এভাবেই শুরু।
পাঁচ. সে খানিকটা রুক্ষ। আদেশ করা তাঁর স্বভাব। এক বিকেলে হাঁটতে বের হচ্ছি দেখে আমাকে ওর জন্য সিগারেট কিনে আনতে বলল। আবার এ-ও বলে দিল, কখনো ওর রুমে নক করে ওর মায়ের সামনে সে সিগারেট তাকে দেওয়া যাবে না। আমার নিজের কাছেই রাখতে হবে।
সান্নার সঙ্গে তার মা-ও এসেছেন। এমন স্বর্গের অপ্সরীকে মর্ত্যের পৃথিবীতে একা ছেড়ে দেওয়ার দুঃসাহস করবেন না কোনো মা-ই। কিন্তু অন্য মায়েদের সঙ্গে তিনি বাইরে বের হলে সান্না হোটেলে থেকে যায় নানা অজুহাতে। মায়ের কাছে ধরা খাওয়ার ভয়ে নিজের বন্ধ ঘরে ধূমপান করার সাহস পায় না। চলে আসে আমার রুমে। এই সুন্দরী তরুণীর উপস্থিতি আর পারফিউমের মাতাল গন্ধ আমার শ্বাসযন্ত্রের পীড়নকে মুহূর্তেই ভুলিয়ে দেয়।
সাধারণত অফিস ডেগুলোয় ওর সঙ্গে তেমন দেখা হতো না। শুধু মাঝেমধ্যে ডিনারে দেখা হতো, এই যা। তখন ওর মা আর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ থাকে, তাই কোনো কথা হয় না। সান্না আর আমি পরস্পরকে চিনিই না এমন ভাব করি। অবশ্য বুফেতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে খাবার নিই। চায়নিজদের সঙ্গে বাঙালিদের একটা মিল আছে, তা হলো অদম্য কৌতূহল। সুন্দরের প্রশংসা করার গুণ তো আছেই। ফলে সাধারণত ভিনদেশি সুন্দরী তরুণীদের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতে আমাদের বাধে না। যদিও অনেকেই এটিকে প্রশংসা হিসেবে নেয় না, বিরক্ত হয়। আমরা অবশ্য একে আবার ‘দেমাগ’ বলি। একটা মজার ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারি। যদি কোনো মেয়ের দিকে তাকাই, তাহলে ওর চোখ আমাকে পাহারা দেওয়ার মতো করে অনুসরণ করে। আমার সহকর্মী-বন্ধুদের চোখ এড়িয়ে, ওর মায়ের চোখ এড়িয়ে ওর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করি। চলে আসার সময় হোটেলের গায়কের একঘেয়ে গান কানে বাজে:
‘রোখে জামানা চাহে
রোখে খুদা তুমকো
আ-না পাড়ে গা,
যো ওয়াদা কিয়া-ও-নিভানা পাড়ে গা...’
(অর্থাৎ—
পৃথিবী বাধা দিলেও
ঈশ্বর বাধা দিলেও
তোমাকে আসতেই হবে
যে প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছিলে
তা রাখতেই হবে)
ছয়. আমি সারা সপ্তাহ বসে থাকি সপ্তাহের শেষ দুদিনের জন্য। আমার অপেক্ষার কথা সান্নাকে কখনো বুঝতে দিই না। প্রহর গুনি কখন এই অজুহাতে, সেই অজুহাতে আমার দরজায় নক করবে। এবং সে তা করতও।
সান্নাকে আমি মেঘনা নদীর গল্প শোনাই। তাতে আবার আরেক ঝামেলা। ‘নদী কী?’ এই ব্যাখ্যা দিতে দিতে আমি হয়রান। সাগর নয়, লেক নয়, সুইমিং পুল অথবা ড্রেনও নয়, বরং মেঘের কাছাকাছি পর্বতচূড়ায় জন্ম নেওয়া এক জলধারা, যা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে সাগরের সঙ্গে মিলনে। এ-ই নদী।
সান্নাকে মনের অজান্তেই এভাবে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করি। বলি, নদী আর নারীর মিল কবি-সাহিত্যিকেরা আমাদের দেশে এক কালোত্তীর্ণ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। সে চোখ বড় বড় করে বলে, ‘হাউ?’
আমি আর সেদিকে কথা বাড়াই না। এবার অন্যভাবে চেষ্টা করি।
‘সান্না দেখো, স্রষ্টা প্রতিটি মানুষকে তৈরি করেছেন অসম্পূর্ণ সত্তা দিয়ে। বয়স আর অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে কিছু পূর্ণতা আসে বটে। তবু একজন পুরুষ মানুষ একজন পুরুষই বা একজন নারী শুধুই একজন নারী। সে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠে যখন একে অপরের মধ্যে নিজের ছায়া দেখতে পায়। একজন পুরুষবিহীন নারী অসম্পূর্ণ এবং একজন নারীবিহীন পুরুষও অসম্পূর্ণ। সান্না নির্বিকার। শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কি আরেকটা সিগারেট খেতে পারি?’ বলেই আমার অনুমতির ধার না ধেরেই যথানিয়মে আবার আগুন ধরাল।
মন চাইছিল ওর সিগারেটের প্যাকেটে পানি ঢেলে দিই, যেন সিগারেট খাওয়ার সাধ মিটে যায়। এতক্ষণ একটা গাছের সামনে হাঁটু গেড়ে প্রেম নিবেদন করলেও সাড়া পেয়ে যেতাম।
সাত. আমাদের হোটেলটি একটি আবাসিক এলাকার প্রান্তে অবস্থিত। গাছপালায় ঘেরা শান্ত এলাকা। একদিন ওই আবাসিক এলাকার গাছের সারির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে ওকে শোনাই আমার শৈশব আর কৈশোরের কথা। ঝমঝম বৃষ্টিতে গ্রামের কাদামাঠে ভিজে ফুটবল খেলার গল্প। কাদার ভেতর থেকে কই মাছ ধরার গল্পটা তাকে যতটা না রোমাঞ্চিত করে, তার চেয়ে বেশি সে আগ্রহী হলো মাছের বর্ণনায়! বর্ষায় শালুক তোলার জন্য কাদায় আমার সারা শরীর মাখামাখি। এর মধ্যে কখনো এক হাতে ছোট সাপ ধরে দূরে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার গল্প শুনে সে একটু শিউরে ওঠে। সাপ বিষয়টাতে ওর খুব ভয়। তবে ওকে আশ্বস্ত করলাম, আমার বর্ণনার সাপের বিষ নেই। বহু বিনিদ্র রাতের পড়াশোনা আর কেরোসিনের সলতে পোড়ানোর পর গ্রাম থেকে শহরে পদার্পণ। আমার ফেলে আসা দিনগুলো বোধ হয় এবার তাকে কিছুটা হলেও আগ্রহী করে তুলল। ‘একদিন যাব তোমার গ্রাম দেখতে।‘ সে বলল।
আমি মনে মনে কল্পনায় ডুবে যাই, কী এক বিব্রতকর অবস্থা-ই না হবে যদি সত্যি সত্যি সে আমার গ্রামে চলে আসে। ভিনদেশি আরবীয় সুন্দরী আমার বৈঠকখানায় বসে আছে, আর ঘরের সব জানালায় জোড়ায় জোড়ায় অনেকগুলো কৌতূহলী বোবা চোখ তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে...! ভাবতেই যেন আমার গায়ে কাঁটা দিল! মনে মনে বাবার কাছে নতশিরে জবাবদিহির ছবি আঁকি। প্রেমের আকাঙ্ক্ষা মুহূর্তে উবে যায়। সত্যিই আমরা পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতার হাতে কতটা বন্দী, কতটা অসহায়! আবার পরমুহূর্তেই ভাবি, যদি এই মেয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে আমার কাছে আসতে পারে, তাহলে আমার সংকোচের কীই-বা থাকতে পারে? ভাবলাম, এই প্রথম বোধ হয় আমার মানবজীবন পুরুষ হতে শিখেছে। মনে মনে আওড়াই—‘কোনোকালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি/ প্রেরণা দিয়েছে শক্তি দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী’...
মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, যা-ই থাকে কপালে, পিঠে ছালা বেঁধে হলেও সান্নাকে প্রেম নিবেদন করব। জানি লেবাননের মানুষ খুব দুর্ধর্ষ হয়। কিন্তু আমিও তো বীর বাঙালি। বড়জোর একটা থাপ্পড়ই নাহয় খাব! খেলাম, তাতে কী। কিন্তু সমস্যা হলো প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার আগে জানা দরকার অন্য কেউ ওর জন্য তার দেশে অপেক্ষা করে আছে কি না।
আট. আমার আশঙ্কাই সত্য হলো। কীভাবে শুরু করব ভাবছিলাম, আর তখন সে নিজেই বোমাটা ফাটিয়ে আমার আশার বেলুন চুপসে দিল।
-‘আমার সঙ্গে তুমি কি একটু যাবে, পার্ক টাওয়ার মলে? আমার একটা গিফট কেনা দরকার।’
বললাম, ‘কার জন্য গিফট কিনবে?’
-‘সাইদের জন্য।’
তারপর জানলাম, সাইদ তার বয়ফ্রেন্ড! আমার খুব কষ্ট আর অভিমান হলো মনে মনে। ক্ষোভ চেপে রেখে বললাম, ‘চল, এখনই যাই।’ কিন্তু ওর সঙ্গে চললাম পা টানতে টানতে, দেখানো উৎসাহের সঙ্গে অমিল রেখে। মাঝে একবার ভাবছিলাম ট্যাক্সিক্যাব থেকে নেমে দৌড়ে হারিয়ে যাই, আর ও একা রাস্তায় কাঁদুক ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে! আসলে কী করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এত দিন ধরে নিজের থেকেই সান্না একটু একটু করে আমার মনের ভেতরে যে ঢুকেছে, তা আমি বুঝতে পারিনি।
শপিং মলে গিয়ে মনের দুঃখে ওকে ফাঁসানোর জন্য খুব সুন্দর আর সবচেয়ে দামি একটি হাতঘড়ি পছন্দ করলাম। বেচারির ছোট্ট পার্সটা ফাঁকা হতে দেখে মায়াই লাগল। ওকে খুশি করতে বললাম, ‘সাইদ এটা খুব পছন্দ করবে।’ সান্নার মুখেও পরিতৃপ্তির হাসি! তা দেখে আমার মনের ভেতরের জ্বলুনি দফায় দফায় বাড়তে লাগল। বৈরুতের কোনো এক গলির ভেতরে বা রাস্তার পাশে কফি শপে সান্না যখন বিরহকাতর প্রেমার্দ্র তরুণটিকে উপহারটি তুলে দেবে, ভূমধ্যসাগরের মৃদুমন্দ বাতাসে হয়তো তার রেশমি চুল উড়তে থাকবে আর ঠোঁটের কোণে থাকবে মিষ্টি হাসি। তখন একবারের জন্যও হাজার মাইল দূরের এই বাঙালি তরুণের দীর্ঘশ্বাসের কথা তাঁর ভাবনাতেও আসবে না!
নয়. যাওয়ার সময় হয়ে এল সান্নাদের।
সেই ভোরে ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। দরজা খুলে ওর রুমের দিকে তাকিয়ে দেখি লাগেজগুলো সব জড়ো করা। আমাকে দেখে ওর মা সালাম দিয়ে মৃদু হাসলেন। এত দিন আমার সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন কম, মাথা নেড়েছেন বেশি। ভাষার দূরত্ব থাকলে যা হয়। মানুষ তখন ইশারায় অনেক কথা বলতে চায়। হোটেলের বেল বয় লাগেজগুলো লিফটের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। সান্নার মা লাগেজের হিসাব রাখছিলেন তাঁর মতো করে। এমন সময় রুম থেকে সান্না বের হলো। সাদা আর বেগুনির কম্বিনেশনে খুব সুন্দর লাগছিল ওকে।
ওদের পুরো গ্রুপের দীর্ঘ যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। পুরো গ্রুপ বলতে ছয়জন। তিনজন বিভিন্ন বয়সী ছাত্রী এবং তাদের অভিভাবক। কারও কারও লাগেজ এগিয়ে দিলাম। সবাই যখন একে একে লিফটে নেমে যাচ্ছিল সেই স্বর্গীয় ভোরে এক নরকযন্ত্রণা ভোগ করছিলাম। এ যেন বিসমিল্লাহ খাঁর সানাই শুনতে শুনতে কারও ইহলোক ত্যাগ করার মতো বিষয়। ভালো লাগলেও আমার ধরে রাখার শক্তি নেই।
চাবির কার্ডটি নিতে রুমে এলাম। হোটেলের বাস পর্যন্ত ওদের এগিয়ে দেব। একবার অবশ্য ভেবেছিলাম এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাব। পরে ভাবলাম, কী দরকার কষ্ট বাড়িয়ে? রুম থেকে বের হচ্ছি, দেখি সান্না দাঁড়িয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জড়িয়ে ধরল আমাকে। চুমু খেল, যা আরবি রীতির চেয়েও বেশি কিছু। কানের কাছে রিনিঝিনি কণ্ঠে বলল, ‘তোমাকে খুব মিস করব।’
পরিস্থিতি হালকা করতে রসিকতা করলাম, ‘তোমার কাছে এখনো কয়েক শ রুপি সিগারেটের দাম পাই, মিস তো আমাকে করবেই।’
দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম।
মহান প্রাপ্তি মানুষকে কখনো কখনো মহৎ হওয়ার ইচ্ছা জাগায়। এই মুহূর্তে আমারও মনে হচ্ছিল, কী দরকার বাঁধনে জড়িয়ে? এই তো ভালো সুন্দর স্মৃতিটুকু থাকুক। ওকে বললাম, ‘একটু দাঁড়াও।’ ওর জন্য কেনা এক জোড়া কানের দুল, স্কার্ফ আর চকলেটের বক্স ঘর থেকে এনে ওর হাতে দিলাম। ‘সাইদ খুব লাকি। তোমার মতো একজনকে পেয়েছে সে’—বোধ হয় এই প্রথমবারের মতো ওর কাছে আমার ঈর্ষা বা কাতরতা প্রকাশ করলাম।
শুনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। গিফটের জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আবার বিদায়ী চুমু খেয়ে দ্রুত চলে গেল সে। আমি এয়ারপোর্টগামী হোটেল বাসের কাছে গেলাম ওদের বিদায় জানাতে। হোটেলের রুম সার্ভিসের লোকগুলো টিপসের জন্য হুড়োহুড়ি করছিল। সূর্যের আলো তখন ফুটতে শুরু করেছে পুব আকাশে। বাস স্টার্ট দিয়েছে। জানালার পর্দা সরিয়ে সান্না উঁকি দিল। ওর চোখে অশ্রু চিকচিক করছে। শেষবারের মতো হাত নাড়ল মিষ্টি হেসে। আমিও হাত নাড়লাম। কিন্তু বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
দশ. পরদিন খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। সারা রাত এপাশ-ওপাশ করেছি। রুমের সামনে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ভোরের বাতাসে দূরাগত আজানের ধ্বনি। নিজেকে আবার ভীষণ একা লাগতে শুরু করেছে। সান্না চলে গেছে গতকাল, এমনি ভোরে। সে থাকলেই বা কী হতো! করাচি শহরের রুক্ষ সৌন্দর্য, ইট-পাথরের ভিড়ে পাখির কিচিরমিচির আমাকে নস্টালজিক করে তুলল। বাংলাদেশে আমার গ্রামের শান্ত, স্নিগ্ধ এক ভোর এসে আমাকে টেনে নিয়ে গেল। সেখানে আছে কচি-কলাপাতার সবুজের আড়ালে উদীয়মান সূর্যের কিরণ। আছে পাখির কলরব, মোরগ-মুরগির ডাকাডাকি, পরিশ্রমী চাষির গরু ও লাঙল। আর আছে মায়ের ব্যস্ত দিনের সূচনা, উঠোনে ঝাড়ুর পরশ। নিয়ম সব জায়গায়ই আছে। শহর যদিও সাধারণত খুব গোছানো-পরিপাটি তবুও খুব যান্ত্রিক। গ্রামের নিয়ম সুপ্রাচীন, প্রতিষ্ঠিত ও অকৃত্রিম। শহরের নিয়ম আনকোরা, নিয়ত পরিবর্তনশীল। গ্রামের নিয়মের নাম ‘গ্রামীণ জীবনধারা’, শহরের নিয়মের নাম ‘অতি ব্যস্ততা, আইন’।
যা হোক, মনে মনে একটা সান্ত্বনা পেলাম, আমার পৃথিবীতে সান্নার জন্য আসলে কোনো জায়গা নেই। আমার মতো যত্রতত্র প্রেমে পড়া ওকে মানায় না। উপরন্তু মেয়েরা একটু বাস্তববাদী হয়। আর কেবল ধর্ম মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে না। সংস্কৃতি, সমাজ আর পরিবারকে উপেক্ষা করে কোনো মানুষ সহজে বেঁচে থাকতে পারে না। সান্না বোধ হয় জানে, আমাদের দুজনের পথ আসলেই আলাদা। আমিও জানি। তবু মন তো মানে না। মন বুঝতে চায় না যে আমি ওর সমাজে মানানসই নই, যেমন সে-ও আমার সমাজে মানানসই নয়। অথবা হয়তো এটাই সত্যি যে সে আমাকে কখনো ওভাবে কল্পনাই করেনি।
এগারো. দুদিন পর সন্ধ্যার দিকে হোটেলের রিসেপশন থেকে ফোন এল। আমার নামে একটা পার্সেল রাখা আছে কাউন্টারে, আমি যেন সেটা কালেক্ট করে নিই। বললাম, ‘প্লিজ, রুমে পাঠিয়ে দিন পার্সেলটা।’ রুম সার্ভিসের লোক এসে পার্সেলটা দিয়ে গেল। ওকে পঞ্চাশ রুপি বখশিশ দিলাম।
একটা আকাশি নীল রঙের ফুলেল সুন্দর রেপিং পেপারে মোড়া পার্সেল। খুলে অবাক হয়ে গেলাম। ভেতরে পার্ক টাওয়ার মলে সাইদের জন্য আমার পছন্দ করা সেই সুন্দর হাতঘড়িটা। তার সঙ্গে সান্নার একটা ছোট্ট চিঠি।
সান্না লিখেছিল, ‘আমি চলে যাওয়ার দুদিন পর এই পার্সেলটা তোমাকে ডেলিভারি দেওয়ার জন্য হোটেল রিসেপশনকে রিকোয়েস্ট করেছি। তুমি ঘড়িটা পছন্দ করেছিলে, ওটা আমি তোমার জন্যই কিনেছিলাম। সাইদ বলে আমার কেউ নেই।’
এটুকু পড়ে বুকের ভেতরে কোথায় যেন একটা হু হু কান্না টের পেলাম। আমার ভেতরের এই আমি যে সান্নাকে জয় করেছিল, অনেক আগেই তা বাইরের আমির কাছে ধরা পড়ল এইমাত্র!
চিঠির শেষ লাইনটুকু পড়তে পড়তে কান্নায় চোখ ধরে এল:
‘...দূর আকাশের তারার মতো আমি থাকব, কিন্তু একদিন ধূমকেতুর মতো আছড়ে পড়ব তোমার পৃথিবীতে।’
ইতি। সান্না।
চিঠির ভাষা ছিল ইংরেজি। কিন্তু স্বাক্ষরটি ছিল বাংলায়। বহুবার চর্চিত বাংলা স্বাক্ষরে নিজের অধ্যবসায়ের পরিচয় দিয়েছিল মেয়েটি।